স্কুটার নিয়ে আমাদের ধারণা, অতীত, বর্তমান ও বাস্তবতা
This page was last updated on 07-Oct-2024 11:04am , By Badhan Roy
আমরা যারা বাইকার আছি, তারা সবাই স্কুটার সেগমেন্টটির সাথে বেশ পরিচিত। অনেকেই স্কুটারকে সংক্ষেপে স্কুটি অথবা বিখ্যাত ইতালিয়ান স্কুটার ব্র্যান্ডের নামে ভেসপা বলে ডাকেন বা চিনেন। আমাদের অনেকেরই ধারণা, স্কুটার কেবলমাত্র নারীরা ব্যাবহার করেন অথবা এটি নারীদের জন্য বানানো। কিন্তু যে কোন বয়সের নারী-পুরুষ উভয়েই স্কুটার বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাবহার করতে পারেন।
বাংলাদেশের রাস্তায় সাধারণ বাইকের অনুপাতে স্কুটার তুলনামূলক কম দেখা গেলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতের জন্য অন্যতম নির্ভরযোগ্য মাধ্যম স্কুটার। গত শতকের ৯০ দশক থেকে ২০০০ এর প্রথম দিকেও আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে বেশ জনপ্রিয় বাহন ছিল স্কুটার। বর্তমানে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আরো বেশি প্র্যাক্টিকালিটি এবং নতুন ফিচারসের সাথে ফ্যাশনেবল লুক থাকার কারনে স্কুটার সেগমেন্টের এখন বেশ ভাল জনপ্রিয়তা লক্ষণীয়।
তো এই লেখায় আমরা স্কুটার নিয়ে অনেক জানা অজানা ও প্রচলিত ধারণার সাথে বাস্তবতা নিয়ে আলোচনা করব।
স্কুটার নিয়ে আমাদের ধারণা - ইতিহাস
স্কুটারের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ এবং বৈচিত্র্যময়, যা ১৯ শতক থেকে বর্তমান পর্যন্ত চলমান। ১৯১৫ সালে মোটোপেড নামে প্রথম মোটরচালিত স্কুটার তৈরি করা হয়, যা আজকের স্কুটারের আদি সংস্করণ। এটি ছিল ছোট চাকার একটি সহজ টু হুইলার, যেখানে ১৫০ সিসি ইঞ্জিন ছিল। এটি ব্যক্তিগত যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করা হতো।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর স্কুটার প্রস্তুতকারক এবং ডিজাইনের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ব্রিটিশ - এবিসি মোটর স্কুটামোটা , কেনিলওয়ার্থ এবং রেনল্ডস রানাবউট 1919 সালে আত্মপ্রকাশ করে। 1920 সালে গ্লুচেস্টারশায়ার এয়ারক্রাফ্ট কোম্পানি তার ইউনিবাসের সাথে অনুসরণ করে। প্র্যাক্টিকালিটি এবং ইকোনমিকাল হওয়ায় ক্রমেই এই টু-হুইলার গুলো জনপ্রিয় হতে থাকে।
কেনিলওয়ার্থ স্কুটার এর বৈদ্যুতিক আলোর জন্য এবং রেনল্ডস রানাবউট তার তৎকালীন সময়ের উন্নত ফিচার যেমন সামনের সাসপেনশন, 2-speed গিয়ারবক্স, সাসপেনশন স্প্রিংস সহ সিঙ্গেল এবং ফোল্ডেবল ডুয়েল সিট এবং কয়েল স্প্রিংস থাকার কারনে দ্রুতই ব্যাবহারকারীদের আগ্রহের শীর্ষে পৌছে যায়।
ইতালিয়ান ভেসপা ও স্কুটার সেগমেন্টের বিপ্লব
স্কুটার সেগমেন্টে বিপ্লব নিয়ে আসে বিশ্ববিখ্যাত ইতালিয়ান ব্র্যান্ড Piaggio Vespa. তাদের ৯৮ সিসি স্কুটারটির ডিজাইনে বেশ পরিবর্তন আনা হয় এবং এর চ্যাসিস ও সাসপেনশন ছিল অধিক চাপ বহন ক্ষমতা সম্পন্ন। সহজে রাইড করার জন্য গিয়ার শিফট লিভার হ্যান্ডেলবারে সরানো হয়েছিল। ইঞ্জিনটি পিছনের চাকার কাছে স্থাপন করা হয়েছিল এবং বডির পেছন দিকে স্পেয়ার টায়ার হোল্ডার বসানো হয়েছিল।
স্কুটারটির ডিজাইন বাতাস এবং রাস্তার ময়লা প্রতিরোধে সক্ষম ছিলো। ছোট চাকা এবং ছোট হুইলবেসের কারনে সরু রাস্তা এবং যানজটের মধ্য দিয়ে সহজে চলাচল করতে পারত। ১৯৪৬ সালে এই মডেলটির পেটেন্ট করার আগে Piaggio প্রেসিডেন্ট প্রোটোটাইপ দেখে ইতালীয় ভাষায় মন্তব্য করেন “সেম্ব্রা উনা ভেস্পা”, যার অর্থ- “এটা দেখতে বোলতার মত”। তারপর থেকে Piaggio তাদের স্কুটার সেগমেন্টের নাম দেয় Vespa, যা আজ পর্যন্ত কালজয়ী নাম হিসেবে পরিচিত রয়ে গেছে।
1947 সালে প্যারিস মোটর শোতে ল্যামব্রেটা ব্র্যান্ড আত্মপ্রকাশ করে। ল্যামব্রেটা ‘এ’ এক বছরে 9,000 ইউনিট বিক্রি হয়েছিল। 123 cc এর ফ্যান-কুলড ইঞ্জিন থেকে এটির সর্বোচ্চ গতি ছিল ৭২ কি.মি/ঘন্টা। ভেস্পার সাথে ভাল প্রতিদ্বন্দিতা করে ল্যামব্রেটা।
দক্ষিণ এশিয়ায় স্কুটারের প্রসার
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে স্কুটার প্রস্তুত এবং ব্যাবহারকারীর দিক থেকে ভারত শীর্ষে অবস্থান করছে। 1950-এর দশকে ল্যামব্রেটা ছিল ভারতে প্রথম স্কুটার নির্মাতা। বাজাজ অটো 1972 থেকে 2009 পর্যন্ত তার স্কুটার লাইনআপ তৈরি করেছিল। ইতালীয় ভেসপা স্প্রিন্টের উপর ভিত্তি করে বাজাজ তাদের স্কুটারগুলো তৈরি করা হয়েছিল। বাজাজের স্কুটার প্রোডাকশন 2009 সালে বন্ধ হয়ে যায়।
ইতালিয়ান ভেসপা এর ম্যানুফ্যাকচারিং পার্টনার ছিল LML মোটরস। ১৯৮৩ সালে Piaggio এর সাথে যৌথ-উদ্যোগে উৎপাদন শুরু করে তারা। ১৯৯৯ সালে Piaggio এর সাথে দীর্ঘ বিরোধের পর পার্টনারশিপটি বন্ধ হয়ে যায়।
বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে ৮০ এর দশক থেকে স্কুটারের ব্যাপক ব্যাবহার লক্ষ করা যায়। সাধারণত স্কুটারগুলোর টার্গেট কাস্টমার ছিল অফিস যাতায়াতকারী মধ্যবয়সী চাকুরিজীবি পুরুষ। এখানেই “স্কুটার শুধুমাত্র নারীদের জন্য বানানো হয়”- আমাদের প্রচলিত এই ভুল ধারণার অবসান ঘটে। আজ ও আমাদের অনেকের বাসায় পূর্বপূরুষের স্মৃতি হিসেবে সেই পুরাতন স্কুটারগুলো এখনো পরম যত্নে সংরক্ষণ করা আছে।
বর্তমানের স্কুটারের পরিসর
বর্তমান যুগের স্কুটারগুলি আধুনিক প্রযুক্তি এবং ব্যবহারকারীর চাহিদার উপর ভিত্তি করে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে স্টাইলিশ লুক দিয়ে নির্মান করা হয়েছে। বর্তমানে কয়েক ধরনের স্কুটার পাওয়া যায় যা ব্যাবহারকারীর ধরণ অনুযায়ী বানানো হয়ে থাকে।
কমিউটার স্কুটার: শহরে যাতায়াতের জন্য ছোট এবং সাশ্রয়ী স্কুটার। ইলেক্ট্রিক স্কুটারগুলো সাধারণত কমিউটার ক্যাটাগরিতেই ফেলা হয়।
স্পোর্টস স্কুটার: হাই স্পিড পারফরম্যান্সের জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়। এটি মূলত তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়।
ম্যাক্সি স্কুটার: শক্তিশালী ইঞ্জিন ও বড় সাইজের স্কুটার, যা দীর্ঘ যাত্রার জন্য আরামদায়ক।
অফ-রোড স্কুটার: অফ-রোডিংয়ের জন্য তৈরি বিশেষ ধরণের স্কুটার, যা খারাপ রাস্তা বা কাঁচা রাস্তায় চালানোর উপযোগী।
স্কুটারের ভাল দিক
স্কুটারের বিভিন্ন ভাল ও প্র্যাক্টিকাল দিক নিচে বর্ণনা করা হলো-
১) প্ল্যাটফর্ম বা ফ্ল্যাট ফ্লোরবোর্ড থাকায় চালক তার পা সমতলে রাখতে পারে। এটি আরামদায়ক রাইডিং নিশ্চিত করে।
২) স্কুটারে সাধারণত গিয়ার পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয় না, কারণ এতে অটোমেটিক গিয়ার থাকে যা নতুন চালকদের জন্যও সহজ।
৩) স্কুটারে সাধারণত কম শক্তি সম্পন্ন ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয় যা জ্বালানি সাশ্রয়ী এবং শহরের ট্রাফিকে চলাচলের জন্য উপযোগী।
৪) স্কুটার মোটরসাইকেলের তুলনায় হালকা তাই এটি সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং বিশেষ করে ট্রাফিক জ্যামে চালানো সহজ।
৫) অধিকাংশ স্কুটারের সিটের নিচে একটি স্টোরেজ স্পেস থাকে যেখানে হেলমেট বা অন্যান্য অনেক জিনিস রাখা যায় যা এর প্র্যাক্টিকালিটির একটি অপরিহার্য দিক।
৬) স্কুটারের জন্য কম জায়গা লাগে ফলে পার্কিং খুঁজতে কম সমস্যা হয়।
৭) স্কুটারের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ মোটরসাইকেলের তুলনায় কম হয়ে থাকে।
৮) বর্তমানে অনেক ইলেকট্রিক স্কুটার বাজারে এসেছে যা পরিবেশবান্ধব ও কার্বন নির্গমন কমাতে সাহায্য করে, নিজের বাড়িতেই চার্জ করা যায় অল্প খরচে।
স্কুটারের সীমাবদ্ধতা
১) স্কুটারের ইঞ্জিনের ক্ষমতা সাধারণত মোটরসাইকেলের তুলনায় কম হয়ে থাকে, যা উচ্চ গতিতে চলাচলের জন্য উপযুক্ত নয়। এটি সাধারণত শহরে বা স্বল্প দূরত্বের জন্য ভাল কিন্তু হাইওয়েতে স্কুটার চালানো কিছুটা অনিরাপদ।
২) স্কুটারের চাকা মোটরসাইকেলের তুলনায় অনেক ছোট হয়ে থাকে যা খারাপ রাস্তা, গর্ত বা অসমতল স্থানে চালানোর ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ। ছোট চাকায় ব্যালান্স রাখতে সমস্যা হতে পারে।
৩) স্কুটার হালকা এবং ছোট হওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটলে রাইডারের বেশি আঘাতের সম্ভাবনা থাকে।
৪) স্কুটারের গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স মোটরসাইকেলের তুলনায় কম যা খারাপ বা উঁচুনিচু রাস্তায় চালানোর সময় তলায় ধাক্কা লাগতে পারে।
৫) স্কুটির মাইলেজ এবং জ্বালানী ধারণ ক্ষমতা খুবই কম। অকটেন হোক বা ইলেক্ট্রিক, এর মাইলেজ যেমন কম তেমনি এর ট্যাংক এবং ব্যাটারি ক্যাপাসিটি ও কম হওয়ার কারনে ঘন ঘন রিফুয়েলিং ও চার্জিং করতে হয় যার কারনে খুব একটা বেশি দূরত্ব এর দ্বারা পাড়ি দেওয়া সম্ভব নয়।
৬) স্কুটারের দাম ক্ষেত্রবিশেষে মোটরসাইকেল থেকে অনেক বেশি হয়ে থাকে, যা একটি বাজে দিক।
পরিশেষে, স্কুটার একদিকে যেমন প্র্যাক্টিকাল, অপরদিকে এর কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। শহরে এবং স্বল্প দূরত্বে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই স্কুটার একটি অন্যতম সেরা অপশন। আমরা আশাবাদী, আমরা শীঘ্রই আরো অনেক অপশন স্কুটার সেগমেন্টে রিজনেবল প্রাইস এবং স্পেয়ার পার্টস এর সাথে বাংলাদেশের রাস্তায় দেখতে পাবো।
বাইক বিষয়ক সকল জানা অজানা তথ্যের জন্য বাইকবিডির সাথেই থাকুন।