প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর মধ্য দিয়ে মাধবকুণ্ড ট্যুর - লিখেছেন তন্ময়
This page was last updated on 11-Jul-2024 02:33pm , By Shuvo Bangla
বাইক নিয়ে একবার সিলেট গিয়ে অনেক জায়গা ঘুরলেও মাধবকুণ্ড যাওয়া হয়ে উঠেনি। তাই এবার শুধু মাধবকুণ্ড কে সামনে রেখে ট্যুর প্লান করেছি। মিথ্যা কথা বলে ফেললাম। কোন প্লান করিনি। অফিসের কাজে মাধবপুর যেতে হবে, বাইক নিয়েই গেলাম। ঢাকা থেকে প্রায় ১২০ কিমি দূরে। ৬ টায় বাসা থেকে বের হয়ে ৯ টার মাঝেই চলে গেলাম মাধবপুর। সাথে এক ভাই ছিলেন যার বাড়ি মৌলভীবাজার। তো ৩ টার মাঝে আমাদের কাজ শেষ হয়ে গেলে ডিসিশন নিলাম আজ মৌলভীবাজার যাই, পরের দিন তাহলে বড়লেখার মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত দেখা যাবে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর মধ্য দিয়ে মাধবকুণ্ড ট্যুর
এর মাঝে আরেকটি ব্যপার বলতে ভুলে গেছি, আমার অফিসের কাজ ছিল মুলত হরিপুর ইউনিয়নে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর থানার মাঝে পরেছে এটি। গ্রামটি নিয়ে একটা কথাই বলবো, পুরো হাওড়ের মাঝে পরেছে গ্রামটি। বর্ষায় কেমন লাগছে দেখতে তা আর নাই বলি। ছবিতে দেখে নিলেই হবে।
৩ টায় মৌলভীবাজারের দিকে রউনা হলাম আমরা দুই জন। কিছুদুর যেতেই আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেলো। কালো মেঘ মানে মহামারি আকারের কালো মেঘ। ওই ভাইকে একটা লোকাল বাসে তুলে দিলাম রাস্তা থেকেই। কয়েক মিনিট পরেই শুরু হোল তুমুল বৃষ্টি। আমি আমার ২৫ বছরের জীবনে এমন বৃষ্টি দেখিনি।
রাতের মতোই অন্ধকার, হেড লাইটের আলোতে সর্বোচ্চ ২০-২৫ ফুট দেখা যায়। বৃষ্টি যেন না, আকাশ থেকে কেউ অনবরত পানি ঢেলে যাচ্ছে। রাস্তার দুই ধার নিচু হলেও বৃষ্টিতে ৮-১০ ইঞ্চি পর্যন্ত উচু হয়ে যাচ্ছিল পানির লেয়ার। কোথাও দাঁড়ানোর মতো জায়গা না পেয়ে তীরবেগে সোজা এগিয়ে চললাম। আমার রেইনকোট এমন বৃষ্টির জন্য তৈরি ছিল না, তাই পুরোটা ভিজে ভারী হয়ে যাচ্ছিল। শ্রীমঙ্গলের দিকে পৌঁছুলে কিছুটা কমে এলো বৃষ্টি। যেটুকু হচ্ছিল, তাকে উপেক্ষা করা না গেলেও আমি উপেক্ষা করে ছবি তুলতে লাগ্লাম। মন খারাপ লাগছিলো ক্যামেরা নেই নি বলে। পাহাড়ের ছবি ফোন দিয়ে তোলা যায় না।
ইফতারির কিছুটা আগে পৌঁছুলাম মৌলভীবাজার। ফ্রেশ হয়ে ইফতার করে আর কিছু মনে নেই, সেহেরীর সময় ভাই ডেকে তুল্লেন খেতে। উঠে খাওয়া শেষ করে আবার ঘুম, একবারে উঠলাম সকাল/দুপুর ১২টায়। এর মাঝে আগের দিন বিকেলে শুরু হওয়া কালো ঘন বৃষ্টি বয়েই যাচ্ছিল তখন পর্যন্ত। বৃষ্টি কমে এলো ২.৩০ নাগাদ।
ভাই কে বললাম মাধবকুণ্ড যাব, উনি আমাকে বোঝালেন মাধবকুণ্ড অনেক দূর, গিয়ে ফিরতে পারব না ইত্যাদি ইত্যাদি। আমিও নাছোড়বান্দা, উনি হার মানলেন। ৩ টায় বের হলাম মাধবকুণ্ডর পথে। আমি জানতাম ইফতারির আগে আসা প্রায় অসম্ভব, তাও উনাকে বললাম আমরা চলে আসতে পারবো।
মৌলভীবাজার থেকে মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত ৬৫ কিলোমিটার, তাও পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ, বন আর চা বাগানের মাঝে দিয়ে। যতটুকু জোড়ে চলা যায় চললাম। বিনা বাধায় ৫০ কিলোমিটার চলে আসলাম। এই ৫০ কিমি রাস্তার দুপাশে অথই পানি। প্রায় রাস্তা ছুই ছুই করছে, আগের রাতের একটানা ১৫ ঘণ্টা ভারী বর্ষণের ফল।
কিন্তু এর পর বাঁধ সাধলো এই পানি। হাকালুকি হাওর থেকে উপচে পানি চলে এসেছে রাস্তায়, কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও কোমর পানি। অনেকটা এগিয়ে গেলাম পানির মধ্যে দিয়েই। শেষে আর ৬-৭ কিমি বাকি, এক জায়গায় অনেক বেশি পানি, কোমর পানি মুলত এখানেই। আগের মত হাঁটু পানি ভেবেই বাইক নিয়ে ভিজে ভিজে দুইজন পার হয়ে গেলাম কোনমতে। ওপারে গিয়ে এয়ার ফিল্টার পরিস্কার করে, প্লাগ চেঞ্জ করে ফেললাম। সত্যি বলতে এত ঝামেলার পর মাধবকুণ্ড যাবার ইচ্ছা চলে গিয়েছিল। যাইহোক, আর বাকি ৫-৭ কিলোমিটার পারি দিয়ে চলে গেলাম ঝর্ণা যাবার ফটকে।
আটকে দিলো পুলিশ। কাল রাতের ভারী বর্ষণে ভিতরের রাস্তা ঘাট ভেঙ্গে গেছে পাহাড়ি ঢলে। আর পানির চাপে কিছুক্ষন পর পর ঝর্ণার উপর থেকে পাথর খসে পড়ছে। অনেক রিকুয়েস্ট করে উনাদের রাজি করিয়ে চললাম ঝর্ণা দেখতে। ইচ্ছা ছিল ঝর্ণার পানিতে গোছল করব। পানির তোরে আসে পাশের সবকিছু ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলছে। প্রতি সেকেন্ডে যে পরিমান পানি পরছে ওই পানি আমাকে মেরে ফেলতে ১ সেকেন্ডও লাগবেনা। কিছু ছবি তুলে উলটো পথে রউনা হলাম।
পানিতে ডুবে যাওয়া পথগুলো পেড়ুতে এবার কষ্ট কম হচ্ছিল, জানা হয়ে গেছে কোথায় কতটুকু পানি। কিন্তু সেই বেশি পানির স্থানে এসে পরে গেলাম বিপদে। পানি আরো বেড়েছে। নৌকা চালু হয়েছে ততক্ষনে। আমি ভাইকে নৌকাতে দিয়ে ফুল স্পিডে এসে পানিতে নেমে গেলাম। দেখতে দেখতে কোমড় পর্যন্ত ডুবে গেলো। এমন অবস্থায় বন্ধ হয়ে গেলো ইঞ্জিন। স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছিলাম আমি বাইক সহ। নামতেও পারছিলাম না, নামতে গেলে বাইক ভেসে যায়। আমার এমন দুরবস্থা দেখে কাছের একটি নৌকা আসতে থাকে আমাকে উদ্ধার করতে। ততক্ষনে আমার অবস্থাও কাহিল, ভেসে ভেসে রাস্তার একদম শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। আর একটু গেলেই হাকালুকি হাওড় আমাকে আমার বাইক সহ টেনে নিবে। কি মনে করে সেলফ স্টার্ট এ চাপ দিলাম। পানির মাঝে বুদবুদ তৈরি করে বাইক চালু হয়ে গেলো। ফুল থ্রটল ধরে গিয়ার দিলাম। বাইক বেশ বড় একটা ঝাকি খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল আমার অপেক্ষায়, আসতে করে ক্লাচ ছারলাম, বাইক এগুতে থাকলো। নির্বিঘ্নে পানিতে ডুবে থাকা বাকি পথ পেরুলাম।
পানি থেকে উঠে ১৫-২০ মিনিট বাইকটাকে শুকানোর চেস্টা করলাম, থ্রটল ঘুরালাম, ইঞ্জিন গরম করলাম। কারবুরেটরে সম্ভবত কিছুটা পানি রয়ে গেছে, বাইক একটু পর পর ধাক্কাছিল। যাইহোক, বাকি পথ নির্বিঘ্নে চলে আসলাম। ইফতার আর আমাদের ঘরে করা হয়ে উঠেনি।
ইফতারের পর বাইক নিয়ে গেলাম লোকাল এক দোকানে, ইঞ্জিন ওয়েল চেঞ্জ করলাম, এয়ার ফিল্টার পরিস্কার করে শুকালাম, প্লাগ চেঞ্জ করলাম। দীর্ঘ সময় পানিতে ডুবে ডুবে চালানোয় সামনের ব্রেক শু শেষ হয়ে গিয়েছে। ব্রেক শু চেঞ্জ করলাম।
সকাল ৬ টায় উঠে বেড়িয়ে পরলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। আগের দিন যাবার পথে যেখানে মানুসের বাড়ি, ঘর, খামার, দোকান দেখেছি, সেখানে অথই পানি। পাহাড়ি ঢলের লালচে ঘোলা পানি। স্রোতের টানে ভেসে যাচ্ছে মানুষের বাড়ি ঘর, গাছ পালা ভেসে আসছে খড়কুটোর মতো।
এসব দেখতে দেখতে চলে আসলাম মাধবদি পর্যন্ত। এখানে ৮০ কিমি বেগে বাসের পেছনে থাকার দরুন এক বিশাল গর্তে পরে গেলাম। পরেই ৫-৬ ফিট উপরে উঠে গেলাম। আমার পেছনের বাস ব্রেক করে থেমে গিয়েছে আমার অবস্থা দেখে। বাইকের সামনের চাকায় ল্যান্ড করলাম, কিন্তু কন্ট্রোল রাখতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। টার্গেট ছিল বাইকটি রাস্তার পাশে নিয়ে ফেলা, ওদিকটায় নরম মাটি, কোন গাছ নেই। আবার ভাবছিলাম বাইক থেকে লাফ দিব পাশের জমিতে। এভাবে কিছুক্ষন ধস্তা ধস্তির পর বাইক সুন্দর করে থেমে গেল পাশের মাটির পথে। পেছনের বাসটি এসে থেমে গেল, হেল্পার নেমে বলল কিছু লাগবে কি না। বাইকটি চেক করে দেখে বলল ঠিক আছে সবকিছু, একটু বিশ্রাম নিয়ে রউনা হতে। আমি বাইক রেখে কিছুটা হেটে চা খেয়ে আবার রউনা হলাম, কিছুক্ষনের মাঝে ঢাকায় পৌঁছুলাম।
লেখকঃ তন্ময় লোবান রহমান