বাইকারদের জন্য নতুন গতিসীমা ও বাস্তবতা

This page was last updated on 14-Jul-2024 11:18am , By Saleh Bangla

আমরা জানি বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে রাস্তায় চলাচলকৃত যানবাহনসমূহের জন্য নতুন গতিসীমা প্রণয়ন করেছে। নতুন এই গতিসীমা অনুযায়ী ব্যক্তিগত গাড়ি ও বাসের সর্বোচ্চ গতি নির্ধারণ করা হয়েছে ঘণ্টায় ৮০ কি.মি। কিন্তু মোটরসাইকেলের জন্য এক্সপ্রেসওয়েতে সর্বোচ্চ গতি হবে ৬০কি.মি/ঘন্টা। অপরদিকে আঞ্চলিক মহাসড়কে ৫০কি.মি/ঘন্টা ও সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এলাকায় মাত্র ৩০কি.মি প্রতি ঘন্টা গতিতে চলবে মোটরসাইকেল ও থ্রি-হুইলার। 

কিন্তু আসলেই কি এই গতিসীমা মোটরসাইকেলের জন্য যথাযথ? বিশেষজ্ঞদের মতে এই গতিসীমা যথাযথ নয়। যথাযথ না হওয়ার পিছনের কারনগুলো প্রকৌশলগত (ইঞ্জিনিয়ারিং) এবং যান্ত্রিক (মেকানিক্যাল) কাঠামোর আলোকে ব্যাখা করার চেষ্টা করা হবে আজকের এই আলোচনায়।

প্রকৌশলগত যেসব কারনে এই গতিসীমা অযৌক্তিকঃ

পুরকৌশল বা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের ট্রাফিক সিস্টেম ব্যবস্থার নাম Non-Lane Based Heterogeneous Traffic system. সহজ কথায়, বাংলাদেশের ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট বাহনের ধরন অনুযায়ী নির্দিষ্ট লেনে ভাগ করা নেই। এবং এর একটি বড় অসুবিধা হচ্ছে এলোপাতাড়ি ভাবে সবরকম যান্ত্রিক এবং অযান্ত্রিক যানবাহন একই রাস্তায় চলাচল করে। ফলে প্রত্যেকের গতিবেগ, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা ব্রেকিং ডিস্টেন্স একরকম হবেনা এটাই স্বাভাবিক।

পদ্মা সেতুতে যেরকম বাইকারদের জন্য আলাদা লেন করে দেওয়া আছে এবং ৬০ কি.মি এর গতিসীমায় তুলনামূলক সহজে বাইক চালানো যায়, ঢাকা শহরে বা আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোতে কিন্তু সেই সুযোগ একেবারেই নেই। এরসাথে অযান্ত্রিক বা ৩-চাকার যানবাহনের উলটা দিকে আসার প্রবণতা তো রয়েছেই। এছাড়াও অন্যান্য গাড়িগুলো যখন বেশি গতিতে চলাচল করবে তখন পিছন থেকে আঘাত (rear collision) এর মত দূর্ঘটনা ব্যাপক হারে ঘটবে এবং প্রাণহানীর আশংকা থাকবে। এর ফলে একটা জিনিস স্পষ্ট, এই বেধে দেওয়া গতিসীমায় দূর্ঘটনা তো কমবেই না, বরং বাড়বে।

তাই আলাদা নির্দিষ্ট গতিসীমা যদি বেধে দিতেই হয় তবে সবার আগে দরকার অযান্ত্রিক যান ও মোটরসাইকেলের জন্য পৃথক দুটি লেন করা। এর সাথে সড়কের ধরন ও নির্মাণকাঠামো অনুযায়ী Improved road sign and marking নিশ্চিত করা। তাহলেই এই বেধে দেওয়া গতিসীমা যৌক্তিক হতে পারে।

 

যান্ত্রিক যেসব কারনে এই গতিসীমা অযৌক্তিকঃ 

সাধারণত বাইকের গিয়ার সংখ্যা মডেল ও ধরন ভেদে ৪-৬ টি হয়ে থাকে। ধরা যাক, গড়ে প্রত্যেকটি বাইকে ৫ টি গিয়ার রয়েছে। এক্ষেত্রে নির্ধারিত গতিসীমা ব্যাবহারের ফলে বেশকিছু সাধারণ ও দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা হতে পারে। যেমন- 

১) গতি কম রাখতে হলে ঘন ঘন গিয়ার শিফটিং করতে হতে পারে। গিয়ার রেশিও সঠিক না থাকার কারনে যা গিয়ারবক্সে বাজে প্রভাব ফেলবে। 

২) লো আরপিএম এ কম গিয়ার বজায় রেখে ঘনঘন শিফটিং করে দীর্ঘসময় চালালে ইঞ্জিন অতিরিক্ত গরম হবে যা ইঞ্জিনের জন্য ক্ষতিকর ও ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল কমিয়ে দিবে। 

৩) অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ হবে, যা বর্তমান জ্বালানি তেলের দাম বিবেচনায় অর্থনৈতিক ভাবে অযাচিত। 

৪) বাইকের মেইন্টেইন খরচ অতিরিক্ত বেড়ে যাবে কিন্তু এর বিপরীতে বাইক চালানোর অভিজ্ঞতা মোটেও স্বস্তিদায়ক হবেনা।

কমপক্ষে ৬৫-৮০ কি.মি গতিসীমা নির্ধারন করা হলে বাইক চালানো যেমন হবে আরামদায়ক, জ্বালানীর সঠিক ব্যবহার ও ক্ষেত্রবিশেষে সাশ্রয় সম্ভব, বাইকের ও তেমন একটা ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা কম।


সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সম্ভাব্য করণীয়ঃ 

উপরের আলোচনা থেকে মোটামোটি সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে বাইকের জন্য স্বল্প গতিসীমা নির্ধারণের আইন কোনভাবেই সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাবেনা বা সড়কপথ নিরাপদ করবে না। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতি আমরা যেসব যৌক্তিক আহবান জানাতে পারি – 

১) পুরকৌশল অথবা পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে একটি জনবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। 

২) সকল ধরনের যানবাহন চালকদের সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে নজর দেওয়া যেতে পারে। পর্যাপ্ত কাউন্সেলিং বা নিরাপদ সড়ক বিষয়ক সভা সেমিনারে সব স্তরের চালকদের নিয়মিত আমন্ত্রণ জানিয়ে সোচ্চার করা যেতে পারে।

৩) বেপরোয়া ও উশৃঙ্খল চালকদের বিরুদ্ধে কঠোর থেকে কঠোরতর আইনানুগ ব্যাবস্থা নেওয়া নিশ্চিত করার ব্যাপারে কাজ করা যায়। 

৪) সম্প্রতি ট্রাফিক গুলশান বিভাগ যেমন পুর্বাচল ৩০০ ফিট এক্সপ্রেসওয়ে সড়কে নিয়মিত অভিযান চলমান রেখেছে সেরকম প্রতিটি সড়কেই দিনে ও রাতে উভয় সময়েই অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে। বিশেষ করে অধিকাংশ এলাকায় রাতের দিকে ট্রাফিক আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা লক্ষ্য করা যায় এই দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। 

৫) দূর্ঘটনার প্রভাব ও পরিণতি সম্পর্কে প্রত্যেক নাগরিক কে সঠিকভাবে অবহিত করতে হবে। 

৬) ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং ট্রাফিক আইন ভঙ্গের কারনে ব্ল্যাকলিস্টেড বা লাইসেন্স বাতিলের প্রথা চালু করা যেতে পারে। 

৭) ডিজিটাল নাম্বার প্লেটের দ্বারা যানবাহনের বেপরোয়া গতি ট্র্যাকিং ও আটক খুব সহজেই সম্ভব। প্রযুক্তিগত দিক থেকে সেক্ষেত্রে বিআরটিএ, ট্রাফিক বিভাগ বা অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা কে এগিয়ে আসতে হবে।

 

পরিশেষে, স্বাধীনতার পর থেকে এযাবৎকাল পর্যন্ত বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সড়ক নেটওয়ার্ক সবচেয়ে উন্নত ও আধুনিক পর্যায়ে এসে পৌছেছে। জীবনযাত্রায় স্বস্তি ও গতি এসেছে, আগের থেকে অনেক আরামদায়ক হয়েছে যাত্রা। উন্নয়নের এই অগ্রযাত্রায় দেশে উচ্চ সিসির বাইক এবং গাড়িও আমদানির বৈধতা ইতিমধ্যে সরকার দিয়েছে। সেখানে বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ ব্যাতিত এই অযৌক্তিক নীতিমালা সড়কে আরো দূর্ঘটনা বাড়াবে ও বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি করবে। তাই নীতিনির্ধারকদের কাছে আমাদের আকুল অনুরোধ, অনুগ্রহ করে নীতিমালা পূনঃবিবেচনা করুন।