Lifan KPR150 ৩১,০০০ কিলোমিটার রাইড রিভিউ - আব্দুল্লাহ
This page was last updated on 16-Jul-2024 03:26pm , By Raihan Opu Bangla
Lifan KPR150 ৩১,০০০ কিলোমিটার রাইড রিভিউ
আমি মোঃ আবদুল্লাহ । আমার জীবনের প্রথম বাইক হচ্ছে Lifan KPR150 । আজ আমি আপনাদের কাছে আমার Lifan KPR150 এর সাথে প্রায় ৩ বছর পথ চলার অভিজ্ঞতা তুলে ধরবো। আমার বাইকটি বর্তমানে ৩১০০০+কিলোমিটার চলছে।
আমি কেনো বাইকিং ভালোবাসি? আসলে সত্যি কথা বলতে, ছেলে হয়ে জন্ম নিলে বোধহয় মেশিনের ওপর সৃষ্টিকর্তা মস্তিষ্কে একটা আলাদা আকর্ষণ তৈরি করে দেন। তাই এরকম ই কিছু কৌতূহল ছোটবেলা থেকেই বাইকের উপর কাজ করতো। দ্বিতীয়ত, সাইকেল চালানো শিখেছিলাম বেশ ছোট থাকতেই । তাই মোটরবিশিষ্ট দুই চাকার দিকে তাকিয়ে থাকতাম এই ভেবে যে , কবে এটাকে বশে আনা যেতে পারে। আর তাই, সুযোগ পেলেই বাবা/মামার বাইকে চড়তে আবদার করতে ভুল হতো না । তাছাড়া বি.আর.টি.এ থেকে যে বাইকিং প্রাক্টিক্যাল পরীক্ষা নেওয়া হতো। তার ভেন্যু ছিল আমার শিক্ষাজীবনের হাই-স্কুলের পাশের মাঠে। যার কারনে, কখনও কখনও স্কুল ফাঁকি দিয়েও মিশে যেতাম উৎসুক জনতার ভিড়ের মাঝে ।
Also Read: All Bike Price In Bangladesh
২০১৪ তে এইচএসসি শেষ করি। কিন্তু তখনো সাহস হয়নি বাসায় বাইক কেনার জন্য আবদার করার। অবশ্য মধ্যবিত্ত পরিবারে আবদার করলেই সর্বক্ষেত্রে সব ইচ্ছে পূরণ করার ক্ষমতা রাখে না। তাই তখন থেকেই মনে মনে স্বপ্ন দেখতাম যে নিজের স্বপ্ন নিজেই পূরণ করবো। অনার্স ২য় বর্ষে অধ্যায়নরত অবস্থায় বেশ কিছু টাকা জমিয়ে ফেলি ।
তখন থেকেই বাজেট টার্গেট করে বাইকার বন্ধুদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে থাকি । কিন্তু বিভিন্ন লোকের ভিন্ন ভিন্ন মতামত । এরপর আমার এক বেস্টফ্রেন্ড LIFAN KPR150 বাইক কেনার পরামর্শ দিয়ে আমার সব জড়তা দূর করে দেয়। লুকিং, কনফিগারেশন, প্রযুক্তি, রিভিউ, বিল্ড কোয়ালিটি, ভালো মন্দ ইত্যাদি দিক বিবেচনা করে আমি বেছে নিই LIFAN KPR 150 বাইকটি। LIFAN KPR এর যে জিনিসটি আমার সবথেকে ভালো লাগে তা হলো এর প্রিমিয়াম লুকিং। এরপর যখন এর টর্ক, হর্স-পাওয়ার, ব্রেকিং লিকুইড কুল্ড ইঞ্জিন ও অন্যান্য স্পেসিফিকেশন সম্পর্কে জানলাম তখন তো নিজেকে আসলেই ধরে রাখা মুশকিল বলে মনে হচ্ছিল । কিন্তু একটা ব্যাপারে বেশ সংশয় হচ্ছিল । আর তা হলো - "এটি একটি চায়না বাইক" । এই বাক্যটিকে আমাদের দেশে কিভাবে নেওয়া হয় তা নিশ্চয় বলার অবকাশ রাখে না। তাছাড়া যশোরে তখনো এটি সুবিস্তার লাভ করেনি। যার ফলে টেষ্ট রাইড দেওয়ার সুযোগ হয়নি । তবে সবকিছু চিন্তা দূর করতে পেরেছিলাম বাইকবিডিতে শুভ্র সেন দাদার Lifan KPR150 এর রিভিউ দেখে।
আমি বাইকটি কিনেছিলাম ২০১৭ সালে। তখন এর মূল্য ছিল ১,৮৫০০০/- বর্তমানে এর মূল্য ১,৭৫০০০/- । আমি বাইকটি ক্রয় করি "যশোর ভেনাস অটো" থেকে। দিনটি ছিলো ২০১৭ সাল এর জুন মাসের ১৭তারিখ। রোজার মাস। আগে থেকেই ঠিক ছিলো যে বাইক কিনব । কিন্তু বাসায় জানত যে, ঈদে কিনব । যথারীতি বাসা হতে আম্মার দোয়া সাথে নিয়ে সকাল সকাল বাবাকে তার কর্মক্ষেত্র থেকে নিয়ে গেলাম ভেনাস অটোতে ।
Also Read: Lifan Bike Price In Bangladesh
বাবাকে সবকিছু বলার পর তিনি বেশ কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে বাইকটি পর্যালোচনা করলেন। কিন্তু প্রথমে অমত করলেন "চায়না" তে আটকে গিয়ে। যা হোক আমি বুঝানোর পরে মোটামুটি আমার কথার উপর ভিত্তি করে রাজি হলেন । বাইক কেনা হয়ে গেল। আমি তখনো পুরোপুরি ভাবে বাইক চালাতে জানিনা । তাই বাবা তার দোকানের এক কর্মচারী (আমার জুনিয়র) কে আমার সাথে পাঠালেন বাসার উদ্দেশ্যে । বাসায় এসেই মা কে বাইক দেখানোর পরে বেশ খুশি দেখতে পেলাম তাই আমার সব চিন্তা দূর হয়ে গেলো।
ততক্ষণে সেই জুনিয়র ভাইটি দোকানের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গিয়েছে । আধঘণ্টা পরে বাবার ফোন । "বাইকটা নাকি ভালোই? ব্রেক আর কন্ট্রোলিং - ও নাকি অনেক ভালো?" আসলে আমি তখনো বাইকটি চালাইনি, তাই হ্যা-সূচক বলেই ফোন রাখলাম । তবে এতটুকু বুঝেছি যে, সেই জুনিয়র এতক্ষনে তার টেষ্ট রাইড সম্পর্কে বাবা কে যথেষ্ট-ই বলেছে। আরেকটি কথা না বললেই নয়, এই দিনটি ছিল আমার জন্মদিন । প্রথম দিনে বাইক কেনার পর, দিনের বাকি অংশ পরে থাকা সত্ত্বেও বাইক নিয়ে বাইরে বের হইনি। কি ভাবছেন, ব্যস্ত ছিলাম? মোটেও না। আসলে টুকিটাকি যে বাইকটি চালিয়ে আমার হাতে খড়ি হয়েছিল তা ছিল Bajaj Discover 125 (DOUBLE DRUM)। যেহেতু, ডিস্ক ব্রেকে কখনো পা রাখা হয়নি। তার উপর এটা নিয়ে আমার ঐ বন্ধু এত এত সাবধানতা ঘোষনা করেছে যে, আমি এটা নিয়ে টোটালি প্যানিক হয়ে গেছিলাম।
Also Read: Lifan KPR 150 টেস্ট রাইড রিভিউ
যাই হোক, পরদিন ১৮জুন ২০১৭ তে একটু সাহস জয় করে পেছনে ছোট ভাইকে নিয়ে বের হলাম। মনেই হলো না যে এই বাইক আমি আমার লাইফে প্রথম রাইড করছি। আমি মোটেও বাড়িয়ে বলছি না। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি সেদিন বেশ কনফিডেন্স ফিরে পেয়েছিলাম এবং প্রায় ২ - ৩ ঘন্টা থেমে থেমে প্রচুর রাইড করেছিলাম। আর ব্রেকিং? আমি রেয়ারঃফ্রন্ট = ৭০:৩০ মেনে নিয়েই রাইড করি যেটা LIFAN KPR এ আমাকে একটা দৃঢ় সখ্যতা এনে দিয়েছিল।
এক নজরে বাইকের ফিচারসমূহঃ
- এটি ১৫০সিসি বিশিষ্ট একটি স্পোর্টস ক্যাটাগরি বাইক
- ইঞ্জিন পাওয়ার 14.8 BHP
- টর্ক ১৪ নিউটন মিটার
- লিকুইড কুল্ড ইঞ্জিন
- ফোর স্ট্রোক বিশিষ্ট ইঞ্জিন
- ৬টি গিয়ার
- প্রজেকশন হেডলাইট
- ১৭.৫ লিটার আয়তন বিশিষ্ট ফুয়েল ট্যাংক
- ওজন ১৪০কেজি
- সামনের টায়ার ৯০/৯০-১৭
- পেছনের টায়ার ১২০/৮০-১৭
- ডাবল ডিস্ক ব্রেক
এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ বছরে ৩১০০০+কিলোমিটার চালিয়েছি, যেখানে প্রথম সার্ভিসিং টি ১৫০০কিলোমিটার তে যশোর থেকে রনি সার্ভিস সেন্টারে করিয়েছিলাম। তাছাড়া ঢাকা থেকে সার্ভিস টীম আসলে আমি কখনো তাদের সহযোগিতা নিতে মিস করিনি।
তাছাড়া কিছু কিছু খুঁটিনাটি কাজ আমি নিজেই করে থাকি। যেমন সময়মত ইঞ্জিন ওয়েল পরিবর্তন, রেডিয়েটর ওয়াটার রিফিল/ড্রেইন করা, স্পার্ক প্লাগ পরিষ্কার, এয়ার ফিল্টার+ক্লাচ কেবল ও এক্সিলারেটর কেবল পরিষ্কার করা ইত্যাদি । প্রথম ৬০০কিলোমিটার পর ইঞ্জিন ওয়েল ড্রেইন দেই। ব্যবহার করি Castrol Active 20w40 (মিনারেল)। এটি ৮০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ব্যবহার করতাম এবং ১০-১১ বার ব্যবহার করেছিলাম। এরপর মতুল 10w40 সিন্থেটিক এ সিফট করি। প্রায় ২৫০০০+ কিলোমিটার পর্যন্ত ব্যবহার করার পর পেট্রোনাস F300 20w40 mineral ব্যবহার করি এবং এখনো এটিই ব্যবহার করতেছি । প্রথম দিকে মাইলেজ চেক করতাম না। পাম্প থেকে তেল নিতাম আর চালাতাম । ৫০০০কিলোমিটার এরপর থেকে আমি যতবার মাইলেজ চেক করছি এভারেজ ৪০কিমি/লি পেয়েছি যার মধ্যে সর্বনিম্ন পেয়েছি ৩৭.৬কিমি/লি. এবং সর্বোচ্চ পেয়েছি ৪৪.৪কিমি/লি ।
বাইকের যত্নের ক্ষেত্রে কয়েকটি টিপসঃ
- ইঞ্জিন ওয়েল সময়মত ড্রেইন দেওয়া।
- ব্রেক প্যাড সময়মত পরিবর্তন করা।
- স্পার্ক প্লাগ, ক্লাচ ক্যাবল, এক্সিলারেশন ক্যাবল, এয়ার ফিল্টার, ব্রেক-ফ্লুইড, টায়ার প্রেসার ইত্যাদি সর্বদা তদারকি ও সময়মত পরিবর্তন করা।
- চেষ্টা করি, ১৫ দিন পরপর বাইক ধৌত করা।
- সময়মত চেইন লুব করা।
- ভালো পাম্প থেকে তেল নেওয়া।
Also Read: Lifan KPR 150 Price In Bangladesh
৩১০০০+কিমি রাইডিং এ আমি যে সকল পার্টস পরিবর্তন করেছিঃ
- ক্লাচপ্লেট ও প্রেসারপ্লেট(৩০০০০কিমি তে)
- পেছনের টায়ার (২৪০০০ কিমি তে)
- সামনের টায়ার (২৯০০০ কিমি তে)
- চেইন স্প্রোকেট (১৭০০০ কিমি তে)
- স্পার্ক প্লাগ (১০০০০কিমি পরপর)
- এয়ার ফিল্টার (৮০০০কিমি পরপর)
এছাড়া ব্রেক প্যাড , ক্লাচ কেবল, এক্সিলারেশন কেবল, বল রেসার ইত্যাদি প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন করেছি । বাইকটি দিয়ে আমার তোলা সর্বোচ্চ স্পিড ১২৬ কিমি/ঘন্টা (পিলিয়নসহ)।
বাইকটির কিছু ভালো দিকঃ
- লুকিং ও স্টাইল
- সিটিং পজিশন
- স্মুথনেস
- ব্রেকিং পার্ফরমেন্স
- বড় সাইজের টায়ার
- LED প্রজেকশন হেডলাইট
- অসাধারন ব্যালেন্সিং
- লিকুয়েড কুল সিস্টেম
- হেল্পফুল সার্ভিস
বাইকটির কিছু খারাপ দিকঃ
- এর পেছনের সাসপেন্সনটা বেস হার্ড
- চেইন দ্রুত লুজ হয়
- টার্নিং রেডিয়াস কম
- পার্টস সাধারণত ঢাকা থেকে অর্ডার করতে হয়, ফলে দুইদিন অপেক্ষা করতে হয়
- সিট-টা একটু নিচু
Lifan KPR150 দিয়ে আমার সবচেয়ে লম্বা দূরত্বের ভ্রমন ছিল কাচপুর-যশোর ২০৭ কিলোমিটার। পিলিওয়নসহ আমি নিজে একাই চালিয়ে এসেছিলাম। সময় লেগেছিল ৪ঘন্টা ৪৯মিনিট। বেশিরভাগ সময় গতি ছিল ৯০+ । এত লম্বা জার্নি সত্ত্বেও কোনো ব্যাক পেইন ছিলো না । যাত্রাপথে ফেরিঘাট ছাড়া কোনো বিরতি ছিল না এবং সর্বোমোট তিনবার রেডিয়েটর-ফ্যান চালু হয়েছিল । সর্বপরি, বাইকটি নিয়ে আমি বেশ সন্তুষ্ট । এখনো পর্যন্ত মেজর কোনো ইস্যু পায়নি । ১,৮৫,০০০ টাকায় এই স্পেসিফিকেশন বাংলাদেশের আর কোনো কোম্পানি বাজারে আনতে পারেনি । বর্তমানে আমার বাবাও সময় পেলে বাইকটি নিজেই রাইড করে যেখানে এক সময় তিনি নিজেও বাইকটি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তাছাড়া বাংলাদেশের ১৫০সিসি সেগমেন্টে যেকোনো এয়ার কুল্ড ইঞ্জিনের বাইককে রেসে হারাতে এটাকে কোন রকম বেগ পেতে হয় না। ধন্যবাদ সবাইকে।
লিখেছেনঃ আব্দুল্লাহ
আপনিও আমাদেরকে আপনার বাইকের মালিকানা রিভিউ পাঠাতে পারেন। আমাদের ব্লগের মাধ্যেম আপনার বাইকের সাথে আপনার অভিজ্ঞতা সকলের সাথে শেয়ার করুন! আপনি বাংলা বা ইংরেজি, যেকোন ভাষাতেই আপনার বাইকের মালিকানা রিভিউ লিখতে পারবেন। মালিকানা রিভিউ কিভাবে লিখবেন তা জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন এবং তারপরে আপনার বাইকের মালিকানা রিভিউ পাঠিয়ে দিন articles.bikebd@gmail.com – এই ইমেইল এড্রেসে।