সেতু মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন: কয়েক হাজার মানুষের পেটে লাথি

This page was last updated on 07-Jul-2024 07:51am , By Shuvo Bangla

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) আইনে মোটরসাইকেলে চালকসহ দুই জন আরোহী বহনের অনুমতি থাকলেও সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে অনির্দিষ্টকালের জন্য তা নিষিদ্ধ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই দ্বিচক্রযানটি ব্যবহার করে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটানোর পরিপ্রেক্ষিতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যদিও এ পদক্ষেপ কতোটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

সেতু মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন

তারচেয়ে বড় কথা হলো- এই নিষেধাজ্ঞার ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কয়েক হাজার খেটে খাওয়া মানুষের পেটে লাথি মারা হলো! বরিশাল, নেত্রকোনাসহ বেশক’টি জেলায় এখন মোটরসাইকেলে যাত্রী বহন একটি বেশ ভালো পেশা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। অসংখ্য বেকারের এতে কর্মসংস্থান হয়েছে। কয়েক হাজার পরিবার তাদের উপার্জনের উপর নির্ভরশীল। এই নিষেধাজ্ঞা যদি টানা এক সপ্তাহ বলবত থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে তাদের অভুক্ত থাকতে হবে।

এছাড়া বিশেষ করে নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ এলাকায় এমন সব এলাকায় এই পরিবহন ব্যবহার করা হয় যেখানে অন্য কোনো বাহন পাওয়া যায় না। তাহলে ওইসব এলাকার যাত্রীরা এখন কী করবেন।

বৃহস্পতিবার সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিককালে কিছু দুর্বৃত্ত মোটরসাইকেল ব্যবহার করে বিভিন্ন যানবাহনে বোমা হামলাসহ ব্যাপক সহিংসতা ও নাশকতা চালাচ্ছে। এ ধরনের নাশকতা ও সহিংসতারোধ এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে ১৯৮৩ সালের মোটর ভেহিক্যালস অধ্যাদেশ (১৯৮৩ সালের ৫৫ নম্বর অধ্যাদেশ) এর ৮৮ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত সরকার সারাদেশে মোটরসাইকেলে চালক ব্যতিত অন্যকোনো যাত্রী বা সঙ্গী বহন করা যাবে না।

আমাদের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কম বিনিয়োগের সুযোগে দেশে গত পাঁচ বছরে বাণিজ্যিকভাবে ভাড়ার বাহন হিসেবে মোটরসাইকেলের ব্যবহার ব্যাপকহারে বেড়েছে।

আমাদের বরিশাল প্রতিনিধি হাসিবুলের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, শহরের প্রাণকেন্দ্র কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে থেকে সদর উপজেলার শায়েস্তাপুর, লামছড়ি, তালতলি বাজারসহ এর আশপাশের এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে যাত্রীবাহী মোটরসাইকেল চালাচল করে। এছাড়াও নতুনবাজার মোড়ক খোলার পুল থেকে বাবুগঞ্জ উপজেলার সদর ও এর আশপাশের এলাকাতে চলাচলেরও অন্যতম যান এই মোটরসাইকেল। বিশেষ করে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে যাতায়াতের জনপ্রিয় বাহন এই মোটরসাইকেল।

বরিশাল মোটরসাইকেল ইউনিয়নের সভাপতি কালাম হোসেন বাংলামেইলকে বলেন, ‘জেলখানা মোড় থেকেই বাণিজ্যিকভাবে দেড়শ’ মোটরসাইকেল চলে। বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় এমন আরো অন্তত ১০ পয়েন্টে বাণিজ্যিকভাবে মোটরসাইকেল চলে। এ পেশায় জড়িতদের সংখ্যা হাজারখানেকের বেশি। এদের প্রত্যেকের দৈনিক উপাজর্ন ৮শ’ থেকে হাজার টাকা। সরকারের এমন সিদ্ধান্তে বরিশালের প্রায় হাজারখানেক খেটেখাওয়া মানুষ বেকার হতে চলেছেন।’

আমাদের নেত্রকোনা প্রতিনিধি মনিরুজ্জামানের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, জেলা সদরের উপজেলা পরিষদের সামনে একটি বাণিজ্যিক মোটরসাইকেলের স্ট্যান্ড রয়েছে। এছাড়াও বারহাট্টা রোড, সাতপাই লেভেল ক্রসিং, কাজুবাজার এলাকায় রয়েছে আরো ৩টি মোটরসাইকেল স্ট্যান্ড। এখান থেকে অন্তত ২’শটি মোটরসাইকেল বাণিজ্যিকভাবে চলাচল করে। সরকারের এমন প্রজ্ঞাপনে নেত্রকোনা এলাকায় অন্তত ৩শ’ কর্মজীবী বেকার হতে চললেন।

আমাদের ঝালকাঠি প্রতিনিধি তরুণের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, ঝালকাঠি সদরের হাসপাতাল মোড়, কলেজ মোড়, নবগ্রাম, রাজাপুর উপজেলার বাঘরি বাজার, মেডিকেল মোড়, বাইপাস মোড়, কাঁঠালিয়া উপজেলার বাসস্ট্যান্ড, আমুয়া ফেরিঘাট, নলসিটি থানার সামনেসহ ঝালকাঠিতে অন্তত আরো ২৫টি পয়েন্ট থেকে বাণিজ্যিকভাবে মোটরসাইকেল চলাচল করে। সরকারের এমন সিদ্ধান্তে ঝালকাঠিতে অন্তত ৪শ’ জন বেকার হতে হবেন। যাদের প্রত্যেকের বাণিজ্যিকভাবে মোটরসাইকেল চালিয়ে উপার্জন হতো ৮শ’ থেকে দেড়হাজার টাকা।

আমাদের সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি আমিনুল ইসলামের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, হাওড় বেষ্টিত জেলা সুনামগঞ্জ। এ জেলার বিভিন্ন উপজেলার সাধারণ মানুষের চলাচলের জনপ্রিয় মাধ্যম মোটরসাইকেল। বিশেষ করে তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারাবাজার, ধর্মপাশা ও জামালগঞ্জ উপজেলায় যাত্রী পরিবহনে কাজে নিয়োজিত রয়েছে অন্তত দুই হাজার মোটরসাইকেল। এসব মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহন করে জীবিকা নির্বাহ করে দুই হাজারেরও বেশি পরিবার। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি এ উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় যাত্রী পরিবহনের মাধ্যমে তাদের দৈনিক উপার্জন হয় ৮শ’ থেকে এক হাজার টাকা। মোটরসাইকেলে সঙ্গী বহন করা যাবে না- সরকারের এমন সিদ্ধান্তে সুনাগঞ্জেই দু’ হাজারেরও বেশী কর্মজীবী বেকার হতে চলেছেন।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার জিনারপুর গ্রামের মোটর সাইকেল চালক রিপন মিয়া বাংলামেইলকে বলেন, ‘আমি প্রতিদিন হোন্ডা চালাইয়া ৭-৮শ’ টাকা আয় করি। এ দিয়ে আমার সংসার চলে। পাশপাশি বইনের লেখা পড়ার খরচ চালাই। হোন্ডায় যাত্রী তোলা না ওইলে আমাগো মরতে ওইব।’

ধর্মপাশার আরেক মোটরসাইকেল চালক জনি মিয়া বলেন, ‘আমরার এলাকায় সাড়ে ৩শ’ মোটরসাইকেল চলে। এই পেশায় বহুত লোক আছে। এইডা বন্ধ হইলে সবাই বেকার হইয়া যাইবো।’

প্রতিদিন মোটরসাইকেলে ভাড়ার বিনিময়ে যাতায়াত করেন জামালগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা নাসিরুল হক। তিনি বলেন, ‘আমরা বেশিরভাগ সময়েই জেলা শহরে যাইতে মোটরসাইকেল ব্যবহার করি। হরতাল অবরোধ থাকলেও আমাদের যাতায়াতে তেমন সমস্যা হয় না। কিন্তু সরকার মোটরসাইকেলে যাত্রী নেয়া বন্ধ কইরা দিলে আমরা ক্যামনে হরতালে অফিস যামু। আর এই পেশায় জড়িত লোকগুলায় বা কেমন তাদের সংসার চালাইবো।’

সরকারের এ সিদ্ধান্তে রাজধানীতেও অনেকে বিপাকে পড়েছেন। বিশেষ করে কর্মজীবী স্বামী-স্ত্রী যারা মোটরসাইকেলে যাতায়াত করেন অথবা যারা এই বাহনে করে বাচ্চাদের স্কুলে আনানেয়া করেন।

আজমাইন মাহতাব নামের এক মটোরসাইকেল আরোহী বলেন, ‘সকালে বউকে মহাখালী অফিসে নামিয়ে দিয়ে আমি আমার উত্তরার অফিসে গিয়েছি। অফিস শেষে ফেরার সময় বউকে মহাখালী থেকে নিতেই পুলিশ আমায় সিগনাল দিয়ে জানালো মোটরসাইকেলে নাকি চালক চাড়া কাউকে বহন করা যাবে না। এখনকি আমি মোটরসাইকেলে আর বউকে সিএনজিতে পাঠাবো?’

উল্লেখ্য, গত ৫ জানুয়ারি কর্মসূচি পালনে বাধা পেয়ে সারা দেশে লাগাতার অবরোধ দিয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। এর মধ্যে দেশজুড়েই চলছে সহিংসতা। সবচেয়ে ভয়াবহ নাশকতাগুলো হচ্ছে যাত্রীবাহী যানবাহনে। পেট্রোলবোমায় ঝলসে গেছে অনেকে, অনেকের মৃত্যুও হয়েছে। আর এসব নাশকতায় অনেক সময় ব্যবহার করা হচ্ছে মোটরসাইকেল।

এর পরিপ্রেক্ষিতে নাশকতা ঠেকাতে সরকার প্রথমে ইন্টারনেটে ফ্রি কল ও কনটেন্ট আদানপ্রদানের ব্যবহৃত ভাইবারসহ পাঁচটি অ্যাপস দুই দিন বন্ধ রেখেছিল। সবশেষ বৃহস্পতিবার থেকে মোটরসাইকেলে চালক ছাড়া কোনো আরোহী পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করলো সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।