মোটরসাই্কেল নিয়ে কাশ্মীর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা (পর্ব-২)
This page was last updated on 08-Jul-2024 04:31am , By Saleh Bangla
কাশ্মীর যাওয়ার জন্য যখন বাংলাদেশ থেকে ভারতের মাটিতে ঢাকা মেট্রো-ল এর চাকার ছাপ পড়ার সাথে সাথে দূরন্ত পথিকের মত চলা শুরু করি শিলিগুরির উদ্দেশ্যে। দুঃখজনক ভাবে আমি যেই দুইটি মোবাইল সিম কার্ড দেশ থেকে নিয়ে এসেছিলাম তার একটিও কাজ করছে না। নেভিগেশনের জন্য অফলাইন ম্যাপ ম্যাপস.মি ম্যাপটির অফলাইনেও দুর্দান্ত একুরেসি যা আমার পূর্ববর্তী দুইবারের বিদেশ সফরে পরিক্ষিত।গন্তব্য অনিশ্চিত কারন বুকিং ডটকম এ যেই হোটেলে বুকিং দিয়েছিলাম ফোনে নেট না থাকার কারনে তার এক্সেস এখন আর আমার নেই। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নেমে আশবে কোথায় যাব কি খাব কিছুই এখন আমার যানা নেই।
মোটরসাই্কেল নিয়ে কাশ্মীর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা
হোমওয়ার্ক সব ছিল ফোন এ যা ইন্টারনেট ছাড়া অচল। এই ব্যাপারটা দেশে যখন ছিলাম খুব সহজভাবে নিয়েছিলাম কারন দুই দুইটি সিম হাতে একটিও চলবে না তা কি করে হয় পরে খবর পেলাম ভারতে নতুন নিয়ম করেছে যে, আধার কার্ড এবং বায়োমেট্রিক ছাড়া সব সিম বন্ধ করে দিয়েছে। বেদিশার মত ঘুরতে ঘুরতে দেখি আমার সামনে চাকা কাপাকাপি করছে। মনে মনে ভাবা শুরুকরি এততো ঠান্ডা পরে নি তাহলে কেনই আর কাশ্মীর যাবার আগেই এত কাপোনি। বুঝতে পারলাম তার আয়ুকাল ঘনিয়ে এসেছে। সামনেই এক MRF Tyre এর শোরুম পেলাম।
তৎক্ষণাৎ শোরূমে ধুকে দেখি আমাদের মতই বয়স্ক এক ইয়ং স্মার্ট একটা ছেলে। আমি ইয়ং স্মার্ট এনার্জেটিক মানুষ পছন্দ করি এর কারন হচ্ছে এরা আমাদেরকে খুব সহজেই বুঝতে এবং আমরা যে ধরনের সহযোগিতা কামনা করি তার জন্য তারাই পারফেক্ট। তারপর তাকে কাশ্মীর ভ্রমনের পূরো বেপারটা বলি, সে টায়ার চেঞ্জ করার জন্য তার দোকানের লোক সাথে করে পাঠিয়ে দেয়। পরবর্তীতে উনি আমার থাকার জন্য মাত্র ৪০০ রুপিতে একটি হোটেল ঠিক করে দেন।
সিম এর বেপারে বলেন যে আপনি এয়রটেল অফিসে যান তার কথা মত এয়ারটেল অফিসে যাই কিন্তু সিম আমাকে দিতে পারবে কিনা তার সম্ভাবনা খুব কম আর হলেও ৪-৫দিন সময় লাগবে। কিন্তু আমিতো সকালে নেপাল যাব। আর নেপাল এর পর আমার সিডিউল খুব টাইট একটু এদিক সেদিক হলেই মহাভারত হয়ে যাবে। আমার অর্ধাঙ্গীনি উনি দিল্লী আসবে ডিসেম্বরের ৮ তারিখ ফ্লাইটে। তারপর আমাদের কাশ্মীর যাত্রা শুরু হবে। এয়ারটেল অফিস থেকে যেই ইনফো পেলাম তা খুবই হতাশাজনক। আর আমি যদি নেপাল যাইও ৫তারিখের মধ্যে ব্যাক করা লাগবেই কারন শিলিগুরি থেকে কলকাতা হয়ে দিল্লী যেতে তো আর ঢাকা চট্টগ্রাম না যে মন চাইল চলে গেলাম।
কি করি উপায় আন্তর না দেখে আঞ্জন দার সাথে দেখা করতে শিলিগুরি থেকে রাতেই রউনা দিয়ে দিলাম। অনেক্ষণ বৃষ্টির জন্য অবশ্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল পরে বৃষ্টি উপেক্ষা করেই রউনা দিয়ে দেই। অফলাইন ম্যাপ দেখে যাচ্ছি তো যাচ্ছি ধীরে ধীরে কাশ্মীর এর দিকে এগিয়ে চলেছি। রাস্তায় অনেক ঠান্ডা আর কুয়াশা মাঝে মাঝে তো মনে হচ্ছিলো এর থেকে চোখ বন্ধ করে চালানো ভালো। কুয়াশার তান্ডব দেখে এক জায়গাই থামিয়ে সকালের নাস্তা সেড়ে ফেলি পুরি আর ডাল দিয়ে সাথে ছিল গরম গরম এককাপ চা।
কিছুদূর যাওয়ার পর একটা ব্রিজের উপর হটাৎ থেমে যাই বাইক থেকে নেমে খুজা শুরু করি শব্দ আসছে কথা থেকে পিছনে গিয়ে দেখি আমার অমূল্যবান ঢাকা মেট্রো-ল এর বিল বোর্ড এখন বিধ্বস্ত তার সাথে যুক্ত হয়েছে সামনের ফর্কের ওয়েলসীল লিক করে ফর্ক ওয়েল বের হয়ে যাচ্ছে। হবারই কথা গত কয়েকশ কিলোমিটারে যে ধকল গেছে। পরে গুনার তার দিয়ে কোন রকমে চিকিৎসা সেরে সামনে বাজাজ শোরুম খুজতে থাকি। শোরুমে গিয়ে নাম্বার প্ল্রেট এর নাট, ইঞ্জিন ওয়েল, ফর্ক ওয়েল সব চেঞ্জ করে নিই।
বাংলাদেশী মোটরসাইকেল দেখে দারুন সমাদর পেলাম। কাশ্মীর যাচ্ছি শুনে তারা একটু অবাক হলো, তাদের বিদায় দিয়ে ততক্ষণে ভালোই বেজে গেছে। সকালে রাস্তা ভূল করে ভূল পথে প্রায় ৬৫কিমি চলে গিয়েছিলাম তো আবার আমাকে সেই ৬৫কিমি ব্যাক করতে হয়েছে। ট্যুরের শুরু থেকেই খুব ধকল যাচ্ছে বুঝতে পারছিলাম যে ট্যুরের শেষ পর্যন্ত টিকে থাকাটা একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দারাবে। দুপুরের খাবারের পর বাসায় ফোন করবো বলে এক ফোনের দোকানে গিয়ে এক বাচ্চাছেলের সাথে পরিচয় হলো তাকে দুক্ষের কথা বলতে বলতে সে বলে উঠলো আপনার সিম লাগলে আমার এইটা নিতে পারেন আবার আপনি যাওয়ার সময় দিয়ে যেয়েন অথবা সিমটা ভেঙ্গে ফেলেন আমি নতুন একটা তুলে নিব।
তারপর একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। জনে জনে ফোন করা শুরু করি বাসায় জানিয়ে দেই আমি ভালো আছি। অঞ্জন দার সাথে কিছুক্ষণ পর পর কথা বলি। আরও কয়েক জন আমার নাম্বার নিয়ে একটু পর পর খোজ খবর নেওয়া শুরু করে দিয়েছে। শিলিগুরি থেকে ঢালখোলা হয়ে মালদা থেকে কলকাতার রাস্তা কেমন সেইটা যানা ছিল না। বহরমপুরের পর থেকে রাস্তা দেখে মনে হচ্ছিলো ভাই দেশে ফিরে যাই আর যাব না। রানাঘাটের আগে একটা চা বিরতি দেওয়ার জন্য রাস্তায় থেমেছিলাম।
চায়ের দোকানের পাসে কয়েকজন মিলে আগুন তাপাচ্ছিলো। আসলে চা খাওয়াটা ছিল একটা বাহানা মাত্র। এতরাতে আমাকে এই রাস্তায় দেখে দুইজন উৎসুক সামনে এসে নানান প্রশ্ন। আমি চুপচাপ বসে আছি আর চায়ের কাপে একটু একটু করে চুমুক দিচ্ছি। একজন আমাকে প্রশ্ন করে বসলো আমার কাছে গাড়ির ডকুমেন্ট আছে কিনা উত্তরে আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনি কে? পুলিশের কেউ? তার পাশের জন উনাকে ঝারি মেরে বলা শুরু করল যে “তুই উনাক এত্ত প্রশ্ন করছিস কেন? উনার সিগনাল দেখে বুজতে পারছিস না উনি কে? এইতো দুজন লেগে গেলো তুমুল এক ঝগড়া। শুধু হাতা হাতিটাই বাকি ছিল তাদের মাঝে। তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে আর নাক না গলিয়ে আমি আমার গন্তব্যের দিকে চলা শুরু করি আবার।
রাতে গিয়ে উঠি স্কুলের বন্ধু জুনায়েদের এক ছোটভাইয়ের বাসায় কলকাতাতে। বাসায় গিয়ে তার হাতে করা কিছু পেইন্টিং দেখে মনে হচ্ছিল পিকাসোর কোন পেইন্টিং এর সামনে আমি। সকালে ঘুম থেকে উঠতে উঠতে দুপুর হয়ে গেল। সকালের নাস্তা আর দুপুরের খাবার একসাথে খাওয়ার মজাও অন্য রকম। দুইজন মিলে ভর পেট খেয়ে বান্টি দার দোকানে যাই বাইকের টুকটাক শপিং করতে । সন্ধায় অঞ্জন দার সাথে দেখা করতে গেলে উনি আমার ঠান্ডার প্রস্তুতি দেখে খুব অবাক বলে “তুমি এগুলি নিয়ে নেপাল আর কাশ্মীর গেলেতো ঠান্ডায়ই মারা যাবে তো” এই বলে উনার ক্লোজেট থেকে এক গাদা পলিথিনের ব্যাগ, থার্মাল গ্লোবস, পাতলা ইনার, থার্মাল নেক গার্ড আর কিছু অমূল্যবান পরামর্শ। যা আমার কাশ্মীর ভ্রমনে অনেক মুল্যবান ছিল।
অঞ্জন দা আমার দেখা একজন অসাধারন মানুষ। এতটা আন্তরিক উনি তা বলার আর বাকি রাখে না। গায়ে জ্বর নিয়েও আমার জন্য উনি যেভাবে মানুষের সাথে যোগাযোগ করছিলেন। চলে আসার আগে উনার একটি পোস্টপেইড সিম কার্ড দিয়ে দিলেন বললেন এইটা জাম্মু-কাশ্মীর এ তোমার কাজে লাগবে। দাদার দেওয়া থারমাল গ্লাবস কলকাতা থেকে যখন বের হই তখনই কাজে লেগে যায়। রাতের বেলা শীতের সময় তাপমাত্রা কম থাকে আর তার উপর মোটরসাইকেলে আরও বেশি ঠান্ডা লাগে। আমরা গরম দেখে অভ্যস্ত শীতকাল তো আমাদের দেশে এখন বিয়ের দাওয়াত খেতে আসে।
কলকাতায় নেমে বাইকের টেঙ্ক ফুল করিয়েছিলাম। কলকাতা থেকে আসানসোল পার হতে না হতেই আমার বাইক রিজার্ভে চলে যায়। তারপর টনক নড়ে উঠে, একি ১২ লিটার তেলে ২২৫ কিমি? এত সকালে কারে ফোন দিবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না ফোন দিলাম আবু সাইদ ভাইকে। উনি বলল “আপনি এখন কোথায়” ? আমি তখন আসানসোল পার করেছি ২৫ কিমি হবে। তারপর আসানসোল ফিরে এসে দেখি একদল বাইক প্রেমিক যুবক আমার জন্য হাজির। তারপর তারাই সব কিছুর দায়িত্ব নিয়ে নিল আমার আর কষ্ট করে কিছুই করতে হই নি।
বেপক আতিথেয়তাই কাটল একটা দিন। রাতে অমিত দা নিয়ে গেলো বিপ্লব ভাইয়ের কাছে। উনি একজন সনামধন্য গায়ক। বাংলাদেশেই তার জন্ম শৈশব কিশোর কাল কেটে গেছে। গল্পে গল্পে আর উনাদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে যাই। ইচ্ছে ছিল ফিরার সময় আসানসোল দুই একটা দিন থাকবো সবার সাথে আড্ডা দিব। বিপ্লব ভাইও অনেক করে বলেছিল যে আসার সময় অবশ্যই যেন তার ঐখানে দু এক দিন থাকি। কিন্তু দুর্ভাগ্য বসত হাতে সময় সল্পতার কারনে কার সাথেই আর দেখা করা সম্ভব হয় নি।
বাঙ্গালী জাতি আমরা একসময় আমাদের মধ্য কোন ভেদাভেদ ছিল না। এখন শুধু আমাদের মাঝে একটা কাটাতারের বেড়া অনেক দূর করে দিয়েছে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে অওরঙ্গাবাদের উদ্দেশ্য রওনা দেই। রাতের অওরঙ্গাবাদ পৌছে পরদিন নেপালের উদ্দেশ্য রওনা হবার কথা। সবকিছু ঠিকঠাক পরদিন রাত ৪টা ৩০ মিনিটে ফোনে এলার্ম দিয়ে রেখে ঘুমিয়ে যাই। ঠিক সময় মতই উঠে বেড়িয়ে পরি। সকাল বেলা ঠান্ডা আর কুয়াশা উপেক্ষা করেই নেপালের রাক্সোল বর্ডারের দিকে যেতে থাকি। ১০০ কিমি পর ম্যাপ এ দেখেছিলাম চার লেনের রোড কিন্তু গিয়ে দেখি রাস্তার কাজ চলছে।
শর্টকাট মারতে গিয়ে চলে যাই গ্রামের ভিতর দিয়ে অফ রোডে। এভাবে পুরোটা পথের বেশীরভাগই ছিল অফ রোড। বর্ডারের আগে প্রায় ৮০-৯০ কিমি রাস্তা খুবই বাজে ছিল। বর্ডারের দেখি প্রচন্ড জটলা পেকে আছে। তারপরও হর্ণ বাজিয়ে রাস্তা খালি করে এগিয়ে যাচ্ছি। বর্ডারে দেখি সবাই আপনমনে চলে যাচ্ছে আমিও পারতাম চলে যেতে কিন্তু আমার যে ভাই অফিসিয়াল পাসপোর্ট একবার ধরা খাইলে জামিন নাই। বর্ডারে নেমে জিজ্ঞেস করলাম কাস্টমস অফিস কোথায় দেখিয়ে দেওয়ার পর বলে আগে ইমিগ্রেশনে যান, ইমিগ্রেশন অফিসে গিয়ে দেখি পুরো ইমিগ্রেশন অফিস খালি।
একটুপর এক ভদ্রলোক এলো। তাকে বললাম আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। নেপাল যাব। বলে আমাদের এই বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশীদের যাওয়ার অনুমতি নেই। তারপর তাকে অনেক কিছু বুঝিয়ে বলার পর সে তার উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করে পরে আমাকে বিনয়ের সহিত অপারগতা এবং কষ্ট করে এত দূর এসে ফিরে যাওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে দপুরের মধ্যাহ্ন ভোজের দাওয়াত দিয়েছিল কিন্তু মনে এরকম কষ্ট নিয়ে কি আর গলা দিয়ে খাবার নামে? যেতে হবে এখন আমাকে বহুদূর কারন বিহারে রাতে থাকা যাবে না। পরে সিদ্ধান্ত নিলাম যে করেই হোক লাখনো যেতে হবে।
সেখানে আছে বাবলা দা। রাক্সোল বর্ডার থেকে লাখনো প্রায় ৫০০ কিমি। প্রথম ১০০ কিমি পার করতেই জান বের হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। তার উপর দুপুর পর্যন্ত তেমন কিছুই খাই নি শুধু মাত্র চা আর ধুম্রশলাকা ছাড়া। এখন আর কিছু খাওয়ার সময়ও নেই যে করেই হোক সন্ধ্যা হবার আগেই হাইওয়েতে উঠা লাগবে। প্রত্যেকটা গন্তব্য যেন এক চ্যালেঞ্জ। তবে এই রকম চ্যালেঞ্জ, রমাঞ্চকর পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে বেশ ভালো লাগে। স্নায়ু উদ্দিপনা অনেক। সন্ধার পর এশারের সময় তখন গিয়ে উঠি এন এইচ ২৭ এ।
ভারতে একটা জিনিস ভালো যে মোটামুটি ওদের হাইওয়ে গুলি তুলনামুলকভাবে নিরাপদ তারপরও এইটা বিহার। ভয় মনের মধ্য যেন লুকোচুড়ি খেলছে। আমার সাথে সাথে রাস্তায় নতুন এক সঙ্গী পেলাম চাঁদ মামা কে। ঠান্ডা ভালই প্রায় ৮-১০ ডিগ্রি হবে। গোরাখপুর পার করে ভাল একটা ধাবা পেয়ে যাই হাইওয়ের পাশেই। ওদের হাইওয়ের পাশে একটু পর পর অনেক ধাবা পাওয়া যায়। খাওয়া এবং বিস্রামের জন্য এর থেকে ভালো জায়গা অর হতে পারে না তার উপর আবার সস্তাও। ৯০ রুপি দিয়ে ডাল আর রুটি আর দুই কাপ চা। খেয়ে একটু রেষ্ট নিয়ে আবার চাঁদ মামার সাথে চলতে থাকি।
কাশ্মীর যাওয়ার পথে রাস্তা এবার বেশ ভালো। পারলে তো ১২০ এ টানতাম কিন্তু আমার তো ট্পই হচ্ছে এখন ১০৬ তাও ৪নাম্বার গিয়ারে ৫নাম্বার গিয়ার কোন কাজই করছে না। ৫ নাম্বারে দেওয়ার সাথে সাথে আরপিএম নেমে যাচ্ছে স্পীড ৭৫-৮০ তাও অনেক কষ্টে। কি আর করার ৭০-৮০ তে টানলে তো আর আমার গন্তব্যে যাওয়া লাগবে না তার আগেই আমি রাস্তায় ঘুমাই যাব। তাই ৪নাম্বারেই টানতে থাকি। একেতো তেলের কোন হিসাব নাই হিসাব ছাড়া তেল যাচ্ছে। পানির মত তেল খাইতেছে তার উপর আবার পার্ফোর্মেন্সেও অনেক দুর্বল। সকালে ভোরের একটু আগে ঠান্ডা প্রচন্ড চালানো খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
একটা টোলবুথের আগে দেখতে পাই কিছু লোক আগুন জ্বালিয়ে বসে আসে। বাইক থামিয়ে তাদের কাছে যেতেই আমাকে চেয়ার দিল বসার। একজন বলে উঠলো “কাহাছে আয়া”(আপনি কোথা থেকে আসসেন ?) উত্তরে বললাম “ঢাকা, বাংলাদেশ”। বাংলাদেশ!!! খুব বিস্ময়ের সাথে বড় একটা শ্বাস নিলো। সবাই জ্যাকেট আর কেও কেও চাদর পরা ছিল। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম তারা পুলিশ। একটু পর তাদের বড়মশাই আমকে দেখে পাঠালেন। যাওয়ার পর অনেকক্ষণ আড্ডা হল চা খাওয়ালেন। চা খেতে খেতে বলতেছিল আমরা আপনাকে আগেই দেখেছি হাইওয়েতে আপনার বাইকে বাংলাদেশের পতাকা দেখে খুব অবাক হই কারন বাংলাদেশ থেকে সচারচর কাউকে আসতে দেখি না। জবাবে আমি বললাম না আমার আগেও আরও কয়েক জন কাশ্মীর ঘুরে গেছে।
উনাদের সাথে আড্ডা শেষে রউনা দেই আর বেশি দূর নাই আর মাত্র ৭০ কিমি বাকি লাখনো যেতে। প্রচন্ড ঘুম আসতেছিল। ঘুমিয়েছিও আমি রাস্তায়। আমি নিজেও অবাক এ কি করে সম্ভব। কতবার হবে তা খেয়াল নেই। থ্রোটল ধরে বসে আছি তো বসে আছি। একটু পর পর চোখের পাতা ফেললে আর খোলে না। হটাৎ যখন বাইক রাস্তার কোনায় চলে যাচ্ছিলো তখন ঝাকিতে চোখ খুলে নেড়ে চেড়ে উঠি। শেষমেষ লাখনো এসেই শহর দেখেই শহরের প্রেমে পড়ে যাই। খুব সুন্দর মোঘল আমালের ডিজাইনে খুব শৈল্পিকভাবে বানানো প্রতিটি রাস্তা ঘাট। এবং শহরের বাড়ি ঘর গুলির টেক্সারও একই। বাবলাদার কাছে শুনলাম যে এগুলি আসলে বানানোর সময় পাথড় গুলি সবাইক ফ্রী দেওয়া হয় যাতে সবাই সবার বাড়ি ঘরে সেই পাথড়, টাইলস ব্যবহার করে।
সব চেয়ে অবাক হয়েছি ফ্লাইওভারে উঠে দেখি আরেকটা শহর। তাজ্বব বেপারে প্রথমে ভেবেছিলাম এই গুলি হয়তো মোঘল আমলের রাজা বাদশারা বানিয়ে গেছে পরে বাবলা দার বলেন এই গুলি হয়েছে মাত্র ৭-৮ বছর আগে। নিজের দেশের কথা ভেবে খুব খারাপ লাগলো। সকালে লাখনো পৌছেই চলে গিয়েছিলাম বাজাজের শোরুমে। তাদের কাছে যাওয়া মাত্রই তারা আমাকে বিশাল একটা লিষ্ট ধরিয়ে দিল বলল ৩০০০ হাজার রুপি লাগবে। বললাম ভাই আমার বাইকটা অনেক ময়লা হয়ে গেছে শুধু ধুইয়ে দিন তাতেই চলবে। পরে ৮০ রুপি দিয়ে বাইক ওয়াশে দিয়ে একটা জম্পেশ ঘুম দিলাম বাজাজ সেন্টারে ২ ঘন্টা পর ঘুম ভেঙ্গে দেখি আমার বাইক আমার সামনে এনে রেখে দিসে।
আমার বাইকের নাম্বার প্লেট দেখে কাপিল মাদান, বলিউড ফিল্মের প্লেব্যাক সিংগার রিতু পাঠাক এর ম্যানেজার উনি নিজে থেকেই এসে পরিচিত হয়ে অনেক অভিনন্দন জানালেন ও বাংলাদেশে বাইক নিয়ে আসার তীব্র ইচ্ছা পোষন করলেন। এদিকে বাবলা দা আমার জন্য হোটেল রুম ঠিকঠাক করে রেখেছিলেন ফোনে আমাকে লোকেশন বুঝিয়ে দিলেন। বিকেলে শুনলাম এক জার্মান দম্পতি এসেছে দুইটা বিএমডব্লিউ মোটরসাইকেল নিয়ে। দেখা করতে গেলে সেখানে লাখনোর তিন ফিমেল রাইডার আসে আমাদেরকে স্বাগত জানাতে।
পরের সারাদিন হল্গার আর বাবলাদার সাথে মোটরসাইকেল মেরামত নিয়ে লাখনোর লালবাগ এ। লালবাগ হচ্ছে ঢাকার বংশালের মত। সেখানে গাড়ি মোটরসাইকেলের পার্টস পাওয়া যায়। সেখানে বাবলাদার পরিচিত এক মেকানিককে দিয়ে মোটরসাইকেলের টুকটাক কাজ করিয়ে নেই। পরের দিন দিল্লীর উদ্দেশ্য জার্মানদের সাথে আগ্রাপর্যন্ত যাওয়ার প্ল্যানিং হয়ে যায়। কথা ছিল সকাল ৮টায় বের হব।
আমি ঘুম থেকে উঠে ব্যাগ গুছিয়ে রেডি তখন বাজে ৭টা ৪৫মিনিট হটাৎ মনে হল জার্মানরা যে হোটেলে উঠেছে তার লোকেশনতো আমি ভুলে গেছি কারন রাতের বেলা গিয়েছিলাম। জার্মানদের কাছে নেই কোন সিম। পুরাই অফ গ্রীডে তারা। পরে গুগলে আসে পাশের হোটেল সার্চ দিয়ে যেই কয়টা পাই তার ছবি দেখে দেখে বের করে ফেলি। হোটেলে গিয়ে দেখি অরা নেই চলে গেছে।
তখন ৮টা ২০ মিনিট। পরে একাই রউনা দেই। এক সাথে যাওয়ার প্ল্যানিং ছিল কারন লাখনো-আগ্রা-দিল্লী রোড পুরাই এয়ারপোর্টের রানওয়ের মত। যাতে রাস্তায় ঘুমিয়ে না যাই তাই কারও সঙ্গ দরকার ছিল। একা একা রাস্তায় প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছিলো। ঝিমুতে ঝিমুতে আগ্রার কাছা কাছি আমি হটাৎ বৃষ্টি। পরে ঠিক করলাম আজকে আর না। আগ্রাতে এক হোস্টেলে গিয়ে উঠলাম। হোস্টেলের একটা জিনিস খুব ভালো লাগে সেখানে বিভিন্ন দেশের লোকজন পাওয়া যায় আর তারা খুবই বন্ধুসুলভ হয় তার উপর ভাড়াও কম। মাত্র ২৫০ রুপি।
রাতের খাবারের পর হোস্টেলের ছাদে পরিচিত হলো তিন ব্রিটিশ নাগরিকের সাথে। তাদের সাথে মুহুর্তেই আড্ডা জমে উঠলো । আমার রুমে আরও দুই বন্ধু ছিল যারা পেশায় ব্যবসায়ী বয়স খুবই কম। তারাও আমাকে অনেক কম সময়েয় আপন করে নিয়ে তাদের বাসা আমন্ত্রণ জানালো। সকালে চলে আসার সময় ৩ ব্রিটিশকে বিদায় দিয়ে ব্যাগ বাধা শুরুকরেছি।আমার বাইক দেখে আরেকটা ছেলে আসলো এমন ১৫০ সিসির বাইকে ইন্টারন্যাশনাল ট্যুর তাও আবার কাশ্মীর দেখে খুব অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তাকে চাবি দিয়ে বললাম ট্রাই করে দেখতে পারও। বাইকে উঠার পরই তার থ্রোটোল টুইস্টিং আর গিয়ার সিফটিং দেখে বুঝার আর বাকি রইলো না যে যে যেখানকারই হোক উনি একজন বাইকপ্রেমিক বটে। পরে কথায় কথায় জানতে পারলাম ও মাথুরা যাবে যেটি দিল্লী যাওয়ার পথে। ভাবলাম একা একা যাচ্ছি একজন সঙ্গী হলে খারাপ হয় না। বললাম যে আমার সাথে যেতে পারও। সেও প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলে না হয়েই যাবে কোথায় হাজার হলেও বাইকপ্রেমিক মানুষ। রাস্তায় তার সাথে পরিচয় হল।
নিউজিল্যান্ড থাকে প্রেশায় একজন বৈমানিক। আস্তে আস্তে কথায় কথায় তাকেও বাংলাদেশ আসার আমন্ত্রণটা দিয়ে দিলাম। তাকে লিফট দেওয়ার জন্য দুপুরের মধ্যাহ্ন ভোজের নিমন্ত্রণ দিলো । ততক্ষনে আমরা ভালো বন্ধু হয়ে গেছি। সে এখনও সিঙ্গেল বাংলাদেশী বিয়ে করতে আগ্রহী বাংলাদেশী মেয়ে নাকি অনেক ভালো। এরা একবার বিয়ে করে সচারচর ডিভোর্স এ যায় না ওদের দেশের মেয়েদের মত। তারপর তাকে বললাম যে তাহলে তোমার একটা বায়ো দিও জবাবে বলে এইটা দিয়ে কি হবে আমি বললাম এইটা আমাদের কালচার বিয়ে করতে হলে বায়ো লাগে। হেসে বলল আচ্ছা পাঠিয়ে দিব। খাবার দাবার শেষে টমকে বিদায় দিয়ে চলে এলাম দিল্লীতে এয়ারপোর্টের কাছা কাছি ১২ কিমি দূরের এক হোষ্টেলে।
পরদিন হোষ্টেল চেঞ্জ করে এয়ারপোর্টের একদম কাছাকাছি এক হোটেলে গিয়ে উঠলাম কারন রাতের ফ্লাইটে আমার অর্ধাঙ্গীনি আসছে। ট্যুরের আগেই দিল্লীর এক্সট্রিম মটো এডভেঞ্চারের দিপক গুপ্তা ভাইয়ের সাথে ইউটিউবের মাধ্যমে পরিচয় তাকে আমার প্ল্যান জানানোর পর বললেন দিল্লী গিয়ে যেন অবশ্যই উনাকে নক দেই। তো পরদিন দুপুরে দিপক গুপ্তার সাথে দেখা হলো জানাকপুরী সেন্ট্রাল মার্কেটে। দুজন বসে সেই আড্ডা হলো। উনার অনেক ইচ্ছা বাংলাদেশে আসার তো প্রসেস জানতে চাইলে তাকে বললাম এই বেপার গুলি আপনাকে ফেস করতে হবে আর বাংলাদেশ বর্ডারে বাংলাদেশ কাস্টমস ঝামেলা করবে ঐটা আমরা ব্যবস্থা করব আপনি আসার সব কিছু ঠিক ঠাক করেন।
রাতে দেখা করতে এলো হিমানশু তিওয়ারি দেখতেও হিন্দি মুভির তিওয়ারীর মতই ছোট খাট মোচ অনেক বিশাল। খুবই হাস্যউজ্জল। তাকে বললাম যে আমার বউ আসবে রাত ১ টার ফ্লাইটে এর আগে চলেন কোথাও ঘুরে আসি। শহরের আসে পাসেই গেলাম হালকা চা নাস্তা করে এয়ারপোর্টের দিকে যেতে লাগলাম। হটাৎ এয়ারপোর্টের সামনে এক চেকপোষ্টে আমাদের বাইকে থামাতে বলে পুলিশ।
বাইক থামানোর পর ইন্সেপক্টর নিজেই এলো এসে বলে আপনারা এই অতিরিক্ত লাইট গুলি কেন লাগিয়েছেন জানেন না সিটিতে এই লাইট নিষিদ্ধ। জবাবে তিওয়ারী বলে তিওয়ারীঃ দারাছাল বাত ইয়ে হে কে হাম যাদাতার হাইওয়ে পেই রেহতা হু। ইন্সপেক্টরঃ (আমার দিকে ইশারা করে বলে) ইয়ে ভি হাইওয়ে পেই রেহতা হে? (উনিও কি হাইওয়েতেই থাকে?) । তিওয়ারীঃ ইয়ে বাংলাদেশ সে আয়া, আজ ইনকা বিবি আরাহিহে। ইন্সপেক্টর চোখ বড় করে। একটু হাসি মুখে আমার নাম জানতে চাইলে নাম বলার পর। আমাকে বলে ওয়েলকাম টু ইন্ডিয়া স্যার। ইন্সপেক্টরঃ ইনকো ছোরিয়ে ইয়ে তো হামারা গেষ্ট হে। তিওয়ারী জি আপ এক কাম কারো, আপ লাইসেন্স লেকার আজাও। পরে অবশ্য তিওয়ারীর এক ফ্রেন্ড নাকি সহকারী পুলিশ কমিশনার। তার কথা বলার পর ইন্সপেক্টটর আর কোন চালান না দিয়েই ছেড়ে দিয়ে ছিল। পার্কিং এ আমাদের দেখে পার্কিং এর একজন জিজ্ঞেস করল যে এত রাতে কোন ভি আই পি আসবে নাকি ? একটু হেসে বললাম জি ভি আই পি না ভি ভি আই পি আসতেছে।
এয়ারপোর্টে যেতে যেতেই দেশ থেকে ফ্রেন্ড জানিয়ে দিল এই ফ্লাইটটী প্রায় সময়ই ৩০ আগে চলে আসে। গিয়েই নোটিশ বোর্ডে দেখলাম ফ্লাইট ল্যান্ডেড। অপেক্ষা করতে করতেই আমার ভি ভি আই পি চলে আসে দেখে খুবই অবাক হলাম যে কিনা একা কোন দিন খিলগাও থেকে উত্তরা পর্যন্ত যায় নি সে আজ ঢাকা থেকে দিল্লী। এরপরে শুরু হবে কাশ্মীর যাত্রা। আজকের মত এখানেই। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন। বাইকে উঠার সময় হেলমেট অবশ্যই ব্যবহার করুন।
লিখেছেনঃ সাজেদুর রহমান মাহি