ডায়াং রানার বুলেট ১০০ এর মালিকানা রিভিউ লিখেছেন তনয়
This page was last updated on 11-Jul-2024 01:36pm , By Shuvo Bangla
ডায়াং রানার বুলেট ১০০ সিসি - অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম বাইক টি নিয়ে একটা রিভিউ লিখবো। কিন্তু কতদিন চালিয়ে একটি বাইক পুরোপুরি চেনা যায়? গতো পাঁচ মাসে ১০,০০০ কিলোমিটার চালিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম এবার সময় হয়েছে কিছু লিখার। এটাই আমার জীবনে চালানো প্রথম বাইক, এর আগে আমি কোন দিন বাইক ধরেও দেখিনি। বাইক কোনকালেই আমার প্রিয় বাহন ছিল না। রাস্তায় বাইক চালিয়ে কেউ যাচ্ছে দেখলেও ভয় লাগতো।
ডায়াং রানার বুলেট ১০০ এর মালিকানা রিভিউ
আর দুরের পথে বাসে উঠে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখতেই ভালো লাগতো। আমি ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে চাকরি নেবার আগে চিন্তা করে দেখলাম ছোট হলেও একটা বাইক লাগে, আজীবন সাইকেল নিয়ে ঘুরে এখন লোকাল বাসে চড়া নতুন করে আর শুরু করতে চাই না। নগদ অর্থ না থাকায় রানারের দিকে মন দিলাম ওদের ইন্সটল্মেন্ট সুবিধার জন্য। প্রথমে ডায়াং রানার ডিলাক্স এডি ৮০ নিতে চাইলেও পরে ডায়াং রানার বুলেট ১০০ নিলাম। শুধুমাত্র এর আউটলুক দেখে। বাইকটির দাম ১০৫০০০ টাকা হলেও আমি একটা অফার চলায় ৯৯০০০ এ পেয়েছি। যদিও ইন্সটল্মেন্ট এর জন্য অনেক বেশি পরেছে।
যদিও ভেবেছিলাম বাইকটি নিয়ে আমি বাসা অফিস যাতায়াত করব, এটি নিয়ে দেশের অর্ধেকটা ঘুরে ফেলেছি। ১০০০০ কিলোমিটার হবার পরও আমার বাইকের কোন সমস্যা হয় নি। নিয়মিত সারভিসিং করি আমি। সার্ভিসিং বলতে ইঞ্জিন ওয়েল চেঞ্জ, এয়ার ফিল্টার ক্লিন, চেইন টাইট, টায়ার প্রেসার চেক......এইত। প্রথম দিকে মাইলেজ অনেক খারাপ ছিল। প্রথম দিকে আমি ২৮-৩৫ কিমি/লিটার পেয়েছি। পরে একবার রানার থেকে সার্ভিসিং এর পরে প্রায় ৭০ এর মতো পেলাম।
এখন সাধারনভাবে ৪৫-৫৫ এর মাঝে থাকে। ইঞ্জিন অয়েল রানার থেকে সারভো বা ইউনিকর্ন সাজেস্ট করলেও আমি ভালো পারফরমেন্স পাচ্ছি হ্যাভোলিন ২০ ডাব্লিও – ৪০ এবং র্যাভেনল ১০ ডাব্লিও – ৪০ দিয়ে। র্যাভেনল নিয়ে আমি একটু চিন্তিত এই জন্য যে, আমার ইঞ্জিন এর জন্য রিকমেন্ডেড ২০ ডাব্লিও – ৪০ বা ২০ ডাব্লিও – ৫০। আর ২০ ডাব্লিও – ৫০ লাগালে বাইক চলতেই চায় না।
হ্যাভোলিন আমি ৩৫০ টাকা দিয়ে আর র্যাভেনল ৪১০ - ৪২০ টাকা দিয়ে কিনি। হ্যাভোলিন ১২০০-১৩০০ কিমি আর র্যাভেনল ১৫০০-১৬০০ কিমি পর্যন্ত চালাই। এর বেশি চালালে ইঞ্জিন অনেক ভারি হয়ে আসে। মডিফাই বলতে আমি ২ টা জিনিস চেঞ্জ করেছি। পেছনের টায়ারঃ চাইনিজ কেন্ডা ৯০/৯০-১৮ চেঞ্জ করে পিরেলি ১১০/৯০-১৮ লাগিয়েছি। পেছনের ব্রেক ধরে এখন অনেক শান্তি পাচ্ছি, আগের টায়ার অনেক বেশি স্কিড করতো। পেছনের টায়ার এখন টিউব্লেস, আর সামনের টাও জেল ভরে টিউব্লেস করেছি। হেডলাইটঃ সাধারন হ্যালোজেন চেঞ্জ করে প্রথমে ৬০০ টাকার একটা এল ই ডি বাল্ব লাগাই।
ওটায় আলো অনেক ছড়িয়ে যাচ্ছিল যা অপর দিকের ড্রাইভার দের জন্য বিরক্তিকর ছিল। পরে ফিলিপ্স এর একটা এল ই ডি লাগাই, ২৩০০ টাকা পরেছে। এর পারফরমেন্স অনেক বেশি মাত্রায় ভালো। সাস্পেনশনঃ এর পর আমি পেছনের সাস্পেনশন চেঞ্জ করে হিরো হাঙ্ক বা হিরো এক্সট্রিম স্পোর্টস এর টা লাগাবো। আমি কখনো হায়েস্ট স্পিড এর দিকে নজর দেই নি। কিন্তু আমি সাধারন ভাবেই ৭০-৮০ কিমি/ ঘন্টা বেগে চালাই। আর আমি এতে সর্বোচ্চ ১০০-১০২ কিমি/ ঘন্টা র মতো তুলেছি।
ডায়াং রানার বুলেট ১০০ - বাইকটির ভালো দিকগুলোঃ
- ওজন: অন্যান্য ১০০ সিসি বাইক যেখানে ৮০-১০০ কেজি, সেখানে এটি ১২৫ কেজির মতো। বাড়তি ওজন এটিকে অনেক বেশি আরামদায়ক ও নিরভরযোগ্য করেছে।
- লুকঃ বাইকটি দেখতে অনেক সুন্দর ১০০ সিসি সেগমেন্ট এর অন্য যে কোন বাইক থেকে।
- হেডলাইট: এর হেডলাইট অনেক পাওয়ারফুল এবং বীম প্যাটার্ন ভালো যা বিপরীত দিক থেকে আশা ড্রাইভার দের সাময়িক অন্ধ করে দিবে না।
- সীট: এর সীট অনেক লম্বা, ২ জন উঠার পারমিশন থাকলেও অনায়াশে ৩ জন চড়া যায়। (আমি ৩ জন নিয়ে একনাগারে ২৫০ কিলোমিটার চালিয়েছি)
- বিশস্ত: একসাথে আমি প্রায় ৬০০ কিলোমিটার চালানোর পরেও বিন্দুমাত্র সমস্যা পাইনি।
- শক্তিশালি ইঞ্জিন: ১০০সিসি বাইক হলেও এটি অন্য যে কোন ১০০সিসি র বাইক থেকে শক্তিশালি। এর ইন্সট্যান্ট এক্সিলারেশন অনেক বেশি।
- টায়ার : অন্য যে কোন ১০০সিসি বাইক থেকে এর টায়ার মোটা।
- মিটার: অনেক বাইকেই দেখি আর পি এম দেখায় না, আবার কিছু বাইক এ ফ্যুএল দেখায় না। গিয়ার না দেখানো একটা কমন সমস্যা। এই বাইকে এই সব ইনফরমেশন দেখায়।
- সিটিং পজিশন: বাইক টির সিটিং পজিশন খুব ভালো, সারাদিন ড্রাইভ করেও কোন সমস্যা হয়নি।
- হর্ন: এর স্টক হর্ন অনেক ভালো।
ডায়াং রানার বুলেট ১০০ বাইকটির কিছু নেগেটিভ দিকও রয়েছেঃ
- গতি: বাইক টির ইন্সট্যান্ট এক্সিলারেশন অনেক বেশি হলেও টপ স্পিড তুলনামুলক ভাবে কম। ৯৫-১০০ কিলোমিটার/ঘন্টা তোলা গেলেও সাভাবিক ভাবে ৮০-৮৫ তে চালানো যায়। এর বেশি গতিতে দীর্ঘ সময় চালানো যায় না।
- টায়ার: ১০০ সিসি বাইক হিসেবে অনেক মোটা টায়ার দেয়া হলেও গ্রিপ খুব বেশি ভালো না। কিন্তু হিরো হানক এর টায়ার খুব ভালোভাবে লেগে যায় এতে।
- পাস লাইট: যারা আমার মতো হাইওয়ে তে চালাতে পছন্দ করেন তারা জানবেন পাস লাইটের গুরুত্ত। এটা কেনো দিলনা আমার মাথায় ই আসে না।
- গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স: আমি খুব বেশি বাইক চালাইনি। তাই খুব ভালোভাবে বলতে পারছি না। তবে অনেক স্পীড ব্রেকারে নিচে বাড়ি লাগে।
- কিট: বাইক টির সাইড প্যানেল খুব বাজে কোয়ালিটির। অল্পদিনেই ভেঙে গেছে।
- সাস্পেনশান: পেছনের সাস্পেনশান খুব বেশি ভালো না, অবশ্য কম দামি বাইকে খুব ভাল আশাও করা ঠিক না। চাইলে হিরো এক্সট্রিম স্পোর্টস বা বাজাজ পালসার এর টা লাগানো সম্ভব।
- ব্রেক: আসলে সমস্যা পেছনের স্টক টায়ারের। তুলনামূলক বেশি স্কিড করে। আমি চেঞ্জ করে পিরেলি লাগানোর পর ভালো পারফরমেন্স পাচ্ছি।
- পার্টস : চাইনিজ/বাংলাদেশি বাইক হবার কারনে এর পার্টস সহজলভ্য না, তাই দাম ও বেশি।
- মাইলেজ: বাইকটির কারবুরেটর খুব নিম্নমানের, মাইলেজ অনেক বেশি ভ্যারি করে। আমি ২৮-৭০ কিমি/লিটার পেয়েছি। তবে বেশি সমস্যা করলে মনে হয় ভালো মানের কারবুরেটর লাগিয়ে এই সমস্যা দূর করা যাবে।
একটি দূরের জার্নি শেয়ার করছি ১লা মে সরকারি ছুটিটাকে কাজে লাগাতে সকাল ৬ টায় চলে গেলাম সোনারগাঁ। এখানে নদীর ধারে বসে সকালের খাবার খেলে মেঘনা ব্রিজ হয়ে চলে গেলাম গৌরীপুর, সেখান আরো এক দফা খেয়ে আবার বেড়িয়ে পরলাম। গৌরীপুর থেকে নারায়নপুর বাজার, নায়েরগঞ্জ, ধোনারপার হয়ে মতলব আসলাম। মতলব শহর টা ঘুরে চাঁদপুর একেবারে মেঘনা ঘাটে। আমার জীবনে এমন কোন নদি নাই যেখানে আমি গিয়েছি কিন্তু নামিনি। কাজেই যথারীতি নেমে পরলাম। কিছুক্ষন সাঁতরে ক্ষুধায় যখন জান যায় যায়, চাঁদপুর লঞ্চ টার্মিনালএ গিয়ে ইলিশ মাছ, মুরগি র মাছ ভরতা দিয়ে পেত পুরে খেলাম। ততক্ষণে বিকেল ৪ টা, আমাদের প্ল্যান ঢাকায় ফেরা।
তিনটা অপশন আমাদের হাতে-
(১) তখন ই ঢাকার জন্য রউনা দেওয়া।
(২) নোয়াখালী গিয়ে ঘুরে এসে রাতের লঞ্চ এ বাইক নিয়ে ঢাকায় ফেরা (রাতে এই রাস্তাগুলোতে বাইক নিয়ে ফেরার সাহস পাচ্ছিলাম না)
(৩) একটু সাহস করে নোয়াখালী ঘুরে রাতেই বের হয়ে পরা। আমরা অপশন
৩ কে বেছে নিলাম। নোয়াখালী না গেলে কেমন হয়? যেই কথা সেই কাজ, লক্ষ্মীপুর হয়ে নোয়াখালী যাব ঠিক করলাম।
লক্ষ্মীপুর পৌঁছুতেই বাজলো ৫ টা। শহর টা ঘুরতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, শহর টা মারাত্তক সুন্দর। ছোট ছোট খুব সুন্দর সুন্দর রাস্তা। শহরের একটু বাহিরেই গ্রামের মতো বাড়িঘর, শহরের সব সুবিধা সহ। সব বাড়িতে একটা করে পুকুর আছে। শহর টা এত বেশি ভালো লেগে গেল যে সিদ্ধান্ত নিলাম রাতটা এখানেই থাকব। রাতে ফিরছি না ভেবেই অনেক এনারজেটিক লাগছিলো। রহমত আলির ঘাট থেকে ফেরি করে চলে গেলাম ভোলা। ভোলায় গিয়ে নদীর পার দেখে আবার সিদ্ধান্ত নিলাম গোছল করার। নদীতে নেমে গেলাম সন্ধ্যা ৬ টায়।
তারপর চা টা খেয়ে আবার আসলাম লক্ষ্মীপুর। রাত ১০ টা পর্যন্ত এদিক ওদিক ঘুরে চলে গেলাম এক বড় ভাই এর বাসায় (ক্যাডেট কলেজ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে সাড়া বাংলাদেশ জুড়েই বড়-ছোট ভাই ছড়িয়ে আছে) । সকালে লক্ষ্মীপুর থেকে ঢাকায় এসে অফিস ধরবো, ভাবতেই কেমন যেন লাগছিল। সকাল ৫.৩০ য়ে বের হয়ে একটানা বাইক নিয়ে সোজা চলে আসলাম পলাশী।
তখন ঘড়িতে সকাল ৮.৩০ বাজে। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে অফিসে গেলাম ১০ টায়। যে যে সমস্যা গুলো ফেস করেছি রানার বুলেট ১০০ নিয়ে সকালে অনেক জোড়ে বাইক চালাতে হয়েছে একটানা অনেক্ষন, (৯০ কিমি/ঘণ্টা), এখন কেমন যেন একটা শব্দ হচ্ছে, কিছু একটা বারি খাচ্ছে এমন। এ ছাড়া বাইকটি অসাধারণ পারফরম করেছে।
একটি আনওয়ান্টেড ঘটনা শেয়ার করছি। কাল আমি বঙ্গ বাজার হয়ে আসছিলাম, এর একটু আরে ২ ঘন্টা ধরে চলা বৃষ্টি শেষ হয়েছে। রাস্তায় কিছুটা পানি দেখেও এগিয়ে গেলাম। আস্তে আস্তে বাড়তে থাক্লো পানি। এক সময় পুরো বাইক ডুবে গেলো পানিতে। এয়ার ফিল্টার পুরোপুরি পানির নিচে থাকলেও বাইক বন্ধ হোল না। ৫০০-৭০০ মিটার এভাবে চলার পরও বাইক চলছিল।
আমার সাথে আরো ১০-১৫ টা বাইক থাক্লেও আমি একাই বের হয়ে আসতে পেরেছি। সবার বাইক বন্ধ হয়ে গিয়েছে এবং ১-২ জনের টা কাত হয় ডুবে গেছে পানিতে। সব মিলিয়ে আমি ডায়াং রানার বুলেট ১০০ বাইকটি নিয়ে বেশ খুশি।
লেখকঃলোবান রহমান তনয়
আপনিও আমাদেরকে আপনার বাইকের মালিকানা রিভিউ পাঠাতে পারেন। আমাদের ব্লগের মাধ্যেম আপনার বাইকের সাথে আপনার অভিজ্ঞতা সকলের সাথে শেয়ার করুন! আপনি বাংলা বা ইংরেজি, যেকোন ভাষাতেই আপনার বাইকের মালিকানা রিভিউ লিখতে পারবেন। মালিকানা রিভিউ কিভাবে লিখবেন তা জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন এবং তারপরে আপনার বাইকের মালিকানা রিভিউ পাঠিয়ে দিন articles.bikebd@gmail.com - এই ইমেইল এড্রেসে।