সাজেক ট্যুর টিম সাওয়ারি - প্রথম পর্ব
This page was last updated on 16-Jul-2024 05:15am , By Saleh Bangla
সাজেক ট্যুর টিম সাওয়ারি
বাইক নিয়ে টুকটাক ট্যুর করার বাতিক অনেক আগের থেকেই ছিলো।কিন্তু কোনো ভাবেই সাজেকের সাথে ব্যাটে বলে মিলছিলোনা। এদিকে বাইকার ভাইদের স্বপ্নের সাজেক ভ্যালিতে একের পর এক চেকিং আর ইউটিউবে সাজেকের অপরুপ সৌন্দর্য দেখে আমার মাথা নষ্ট। অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকলাম যে কবে যাবো সেই স্বপ্নের স্বর্গ রাজ্যে সাজেক ট্যুর দিতে। ব্যক্তিগত জীবনের জটিলতা কিংবা পারিবারিক নিষেধাজ্ঞা দুটোই ছিলো। আমার আম্মুর কিছুটা সম্মতি থাকলেও আব্বু এই ক্ষেত্রে পুরোই আয়রন ম্যান। তার একটাই কথা যত টাকা লাগে নাও ভালো বাসে যাও কিন্তু বাইক নিয়ে অত দূর যাওয়া যাবেনা। কিন্তু একজন বাইক ট্রাভেলারের কি আর অন্য কোনো যানবাহনে মন টেকে? তাই অপেক্ষা করতে থাকি।
আব্বু প্রায়-ই অফিসিয়াল কাজে দেশের বাইরে যান আমিও এমন একটি সুযোগের অপেক্ষায় থাকি। এদিকে বন্ধু খালিদ একদিন আমাকে জানালো সে সাজেক ট্যুরের প্লান করছে, সে লিফান কেপিআর রাইডার। মনের কথাটাই যেনো সে আমাকে বলে ফেলল আমাকে আর পায় কে। দুজনে মিলে প্লান করা শুরু করলাম। কিন্তু নানান জটিলতার কারণে আমি একটু দোলাচলে ছিলাম। বন্ধু খালিদ আর কিছু ছোট ভাই প্লান করলো যে তারা ফেব্রুয়ারির ২৩ তারিখ সাজেকের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে।
কিন্তু আমি তখনো একটু ঝামেলায়। আমি বললাম তোমরা যাও আমি পরে সুযোগ পেলে যাবো। কিন্তু ওরা আমাকে রেখে যেতে চাইলোনা।তাই তারিখ পিছিয়ে দিলো। মনটা কৃতজ্ঞতায় ভরে গেলো পাশাপাশি একটু টেনশনে পরে গেলাম যে আমার জন্য যদি ওদের না যাওয়া হয়। অবশেষে আল্লাহর রহমতে ঝামেলামুক্ত হলাম আরো শুনলাম যে আব্বু মার্চের ৭ তারিখ সপ্তাহ খানেকের জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছে। ব্যস সোনায় সোহাগা আমাকে আর পায় কে সবাইকে জানিয়ে দিলাম।
সবাই ৭ তারিখ সাজেক ট্যুর দেয়ার ব্যাপারে একমত হলো। এর ভেতরেই আমার আর খালিদের সাথে আরেক ছোটো ভাই ইমরান তার কেপিয়ার নিয়ে যুক্ত হলো। আরেক ছোটো ভাই মেহেদী কিছুটা দোলাচলে থেকে সেও যোগ দিলো তার কেপিয়ার নিয়ে, সাথে যোগ হলো তার আরেক বন্ধু আকাশ তার পালসার এ এস নিয়ে। আর আমার পিলিয়ন বরবারের মত ছোট ভাই আতিক।
৫ টি বাইক আর ৬ জন সদস্য নিয়ে আমাদের একটি টিমও হয়ে গেলো। কিন্তু টিমের তো একটা নাম চা, এক্ষেত্রে সম্পূর্ন কৃতিত্ব বন্ধু খালিদের। তিনি আমাদের টিমের নাম রাখলেন "টিম সাওয়ারি"। অত্যান্ত পছন্দ হলো সবার নামটি। আমরা একটি গ্রুপ মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম ৭ তারিখ মাগরিবের নামায পড়েই রওনা দিবো। আমরা রাতের বেলা পাহাড়ে রাইড করতে চাইনি আর খাগড়াছড়ি রাত যাপন করতে চাইনি তাই এই সিদ্ধান্ত। যাই হোক, সবাই বাইকের টুকটাক কাজ করিয়ে ফেললাম আর কাঙখিত দিনটির অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকলাম। অবশেষে চলে আসল সেই কাংখিত ৭ মার্চ যে দিন আমারা সাজেক ট্যুর এ রওনা হব।সবাইকে বলা ছিলো সারাদিন বিশ্রাম করতে কেননা পরবর্তী ২৪ ঘন্টা আমাদের রাইড করতে হবে।
কিন্তু গোছগাছের কাজ আর উত্তেজনায় কারোর-ই ঘুম এলোনা। ব্যস্ততায় কেটে গেলো সারাটা দিন।বিকালের দিকে ইমরান ফোন দিলো যে সে রেডি একটু পর খালিদের ফোন। সেও রেডি। আমিও দ্রুত তৈরি হয়ে আতিক কে নিয়ে পূর্ব নির্ধারিত চেকিং পয়েন্ট রুপসা ব্রীজের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়লাম। রুপসা ব্রীজ-ই আমাদের আড্ডাস্থল। প্রতিদিন সেখানে না গেলে কেমন যেনো একটা অপূর্নতা থেকে যায়।কিন্তু আজ যেনো কেমন এক আলাদা অনুভূতি হচ্ছিলো যা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। ব্রীজ পার হয়ে কিছুদূর যেতেই দেখি খালিদ আর ইমরান উপস্থিত।
এদিকে মেহেদী মোবাইলে জানালো যে সে আর আকাশ বাসা থেকে বের হয়েছে। ওদের বাসা আবার ব্রীজ থেকে একটু দূরে। এদিকে মাগরিবের সময় হয়ে আসছিলো তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে নামায পড়েই রওনা দেবো।এর ভেতরেই বাকী দুইজনও চলে আসল।আমরা নামায পড়ে খাজুরার আল আরাফা ফুয়েল পাম্প থেকে সবাই ট্যাংকি ফুল করে নিলাম। এর পর আল্লাহর নামে ঠিক ৭:১৫ তে আমাদের যাত্রা শুরু করলাম আমাদের সাজেক ট্যুর। বয়সে সিনিয়র হবার কারনে আমি আর খালিদ সামনে আর পেছনে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম।প্রথমে লিডে আমি গেলাম আর একেবারে পেছনে থাকল খালিদ।
বাকী ৩ রাইডারো যথেষ্ট পরিপক্ক আর খুব ভালো মানের রাইডার ছিলো কিন্তু সিনিয়র হিসেবে আমাদের তো একটা দায়িত্ব থেকেই যায়। আগের থেকেই বলা ছিলো আমরা সহনীয় স্পিডে চালাবো আর কেউ সিরিয়াল ভঙ্গ করতে পারবেনা। আমরা খুব শৃঙ্খল ভাবেই প্রায় ৭০+ কিলো পাড়ি দিলাম আর ১০ মিনিটের ছোট একটা চা পানের বিরতি দিলাম।কিন্তু চা খেতে খেতে কখন যে প্রায় ২০ মিনিট কেটে গেলো টের-ই পেলাম না। দ্রুত সবাই আবার বাইকে উঠলাম আর সিদ্ধান্ত নিলাম যে কাঠালবাড়িয়া ঘাটের আগে আর বিরতি নয়। আমরা মোটামুটি রাত ১০ টার ভেতর প্রায় ১৫০ কিলো পাড়ি দিয়ে ঘাটে পৌছে গেলাম।কিছুটা ভীড় ঠেলে মোটামুটি রাত ১২:০০ টার ভেতর ওপার পৌছে গেলাম।
আগের থেকেই জানা ছিলো যে রাতের ঢাকা কিংবা চিটাগাং হাইওয়ে মোটেই নিরাপদ নয়।তাই আমরা কিছু সময় ঘাটেই কোনো রেস্টুরেন্টে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের আগেই সিদ্ধান্ত ছিলো যে চলতি পথে ভারী কোনো খাবার খাবোনা। কিন্তু পদ্মার পাড়ে এসেছি আর যদি পদ্মার ইলিশের-ই স্বাদ না নিলাম তাহলে ক্যাম্নে কি? গেলাম সব বাধা নিষেধ ভূলে। তাজা পদ্মার ইলিশ ভাজা,বেগুন ভাজি,ডিম ভাজি,ডাল আর ভাত দিয়ে চরম ভূরিভোজন হলো। সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম মধ্যরাতের পর আবার আমরা রওনা দেবো।নদীর পাড়ে আড্ডা গল্পে সময় পার করে দিলাম।ঠিক রাত ৩:৩০ মিনিটে আমরা আবারো যাত্রা শুরু করলাম।
ভোর ৫ টার ভেতর যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার পার হয়ে একটি ফুয়েল পাম্পে বিরতি নিলাম।যে যার মত ফ্রেশ হয়ে নামায পড়ে আবার রওনা দিতে দিতে ৬ টা বেজে গেলো। এর পর-ই শুরু হলো ভয়বাহ আকারের জ্যাম। মাইলের পর মাইল বাস,ট্রাক ইত্যাদির সারি! আমরা কখনোবা দুই ট্রাকের ফাক গলে কখনোবা ফুটপথের উপর দিয়ে মন্থর গতিতে এগিয়ে চললাম। জ্যাম এত-ই ভয়বাহ ছিলো যে আমরা প্রায় ২.৫ ঘন্টায় মাত্র ৩০ কিলোর মত এগোতে পেরেছিলাম। আমাদের চক্ষু তো চড়কগাছ এভাবে এগোতে থাকলে আজ আর দুপুরের স্কট ধরে সাজেক যাওয়া লাগবেনা। কিন্তু সামনে আস্তে আস্তে জ্যাম কমতে থাকে আর আমাদের গতিও বাড়তে থাকে। অবশ্যই সেটা সহনীয় মাত্রায়। আমাদের দুই একজন জুনিয়র সদস্যের আবার এই প্রথম এত বড় ট্যুর ছিলো তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটু ঘন ঘন বিরতি নিতে হচ্ছিলো। অবশেষে আমরা দুপুর ১১:৪৫ এর দিকে বরৈয়ারহাটে পৌছে গেলাম।সেখান থেকে আমরা খাগড়াছড়ির পথ ধরলাম দুপুর ১২:৩০ এর দিকে। এর পর -ই শুরু হলো পাহাড়ি রাস্তা।
পাহাড়ি রাস্তা তাই স্পিডো হাইওয়ের মত তুলতে পারছিলাম না আর চার পাশের অপরুপ প্রকৃতি উপভোগ করতে করতে আমরা একটু বেশি-ই সময় নষ্ট করে ফেললাম। যার জন্য দুপুরের স্কট টাও মিস করে ফেললাম। বাঘাইছড়ি আর্মি ক্যাম্প যেখান থেকে প্রতিদিন সাজেকের উদ্দেশ্যে দুইটা আর্মি স্কট যায় মূলত ওই স্কটের সাথেই পর্যটক দের যাবার নিয়ম। এটা মূলত আমাদের নিরাপত্তার খাতিরেই। কেননা পাহাড়িরা অনেক সময় পর্যটক দের সাথে ঝামেলা করে। যাই হোক,দিনের শেষ স্কট টা দুপুর ৩:৩০ মিনিটে আর আমরা সেখানে পৌছাই বিকাল ৪:২০ এর দিকে। আর্মীর সদস্যরা আমাদেরকে কিছুতেই আর যেতে দিবেনা।
তার উপর খুলনা থেকে সাজেক ট্যুরে বাইক নিয়ে গিয়েছি শুনে আরো কড়াকড়ি। কিন্তু অনেক অনুনয় বিনয়ের পর অনেকক্ষন পর অনুমতি মিলল আর আমাদেরকে বলে দেয়া হলো যে পথে যেনো আর সময় নষ্ট না করি। এর পর-ই মূলত আসল এডভেঞ্চার শুরু। সাজেকের পাহাড়ের অসাধারণ সৌন্দর্য আর কখনো কখনো ৬-৭ তালা সমান উচু রাস্তা,কখনোবা হটাৎ অনেক ঢালু রাস্তা,কখনোবা ইংরেজি "S" অক্ষরের মত বাকানো রাস্তা পার হয়ে এগিয়ে চললাম।তবে সবচেয়ে উপভোগ্য আর একটু চ্যালেঞ্জিং রাস্তা মনে হয়েছে শেষের ৪-৫ কিলো।বেশির ভাগ সময়েই ২ অথবা ১ গিয়ারে উঠতে হয়েছে।
যারা গিয়েছেন তারা তো জানেন-ই আর যারা এখনো যান নি তাদেরকে বলছি ভয়ের কিছুই নেই শুধুই উপভোগ করুন শুধু স্টার্ট যেনো বন্ধ নাহয় এদিকে খেয়াল রাখবেন। অবশেষে আমরা সন্ধা ৭ টার কিছুটা আগে পৌছে গেলাম স্বপ্নের সাজেক ভ্যালিতে আল্লাহর রহমতে কোন সমস্যা ছাড়াই। আমাদের প্রায় ১ দিনের টানা জার্নি আর প্রায় দুই দিনের নির্ঘুম থাকার ক্লান্তি যেনো নিমিষেই দূর হয়ে গেলো। এর আগেও খুলনা থেকে ২-৩ জন রাইডার সাজেক গিয়েছেন কিন্তু খুলনা থেকে কোনো টিমের সাজেক ভ্রমণ এই প্রথম। দ্রুত সুন্দর একটা রিসোর্টও পেয়ে গেলাম! ডাবল বেডের দুই রুম ২ হাজার টাকা।নাম হিমালয় রিসোর্ট।হটাৎ সবাই পেটের ভেতর ছুচোর নাচুনি টের পেলাম।
সেই গতরাতে ঘাট পার হয়ে খেয়েছি এর পর থেকে পেটের ভেতর চা আর পানি ছাড়া আর কিছুই পড়েনি। দিয়ে দিলাম খাবারের অর্ডার। এই ফাকে আমরা একটু ফ্রেশ হয়ে আশেপাশে ঘোরাফেরা করে নিলাম। এর ভেতর খাবার তৈরি হয়ে গেলো। ৬ জনে যেনো ঝাপিয়ে পড়লাম খাবারের উপর। সাদা ভাত,সবজি,ডাল,ডিম মামলেট,স্থানীয় নদীর বড় মাছ দিয়ে অস্থির ভূরিভোজন শেষ হলো। বিশেষভাবে আলাদা করে সবজির কথা বলতেই হয়।পাহাড়ি সবজি আর মাছের মিশেলে তৈরি সেই সবজি রান্নার স্বাদ আজো ভূলতে পারিনি! ভূড়িভোজ তো হলো এবার শরীর জানান দিলো তার বিশ্রাম দরকার।আমরা আর দেরি করলাম না।যে যার রুমি গিয়ে ১০ টার ভেতর ঘুমিয়ে পড়লাম।সারাদিনের ক্লান্তিকর ভ্রমনের পরেও ঠিক ফজরের সময় ঘুম ভেঙে গেলো।ফ্রেশ হয়ে নামায পড়ে সবাইকে ডাক দিলাম।কেউ উঠলো আবার কেউ ঘুমাতে চাইলো আরো।কিন্তু আমার চিন্তা যত-ই ঘুম আসুক সাজেকের সূর্যোদয় আর সকালের সৌন্দর্য মিস করা যাবেনা......( চলবে )
লিখেছেনঃ মঞ্জুরুল আল হাসান মুন্না