মৌলভিবাজার, সিলেট এবং সুনামগঞ্জে আমাদের যেভাবে কেটেছে ৩ দিন

This page was last updated on 06-Jul-2024 05:43am , By Shuvo Bangla

ঢাকা থেকে আমি এবং শাওন ১৬ই সেপ্টেম্বর ২০১৪ তে রওনা হই। আমাদের উদ্দেশ্য শ্রীমংগল- মৌলভিবাজার হয়ে সিলেট যাওয়া এবং । নতুন বাইক এখনো নাম্বার হয়নি, এভাবে দূর দুরান্তে নাম্বারবিহীন মোটরবাইক নিয়ে যাওয়া খুব রিস্কী হয়ে যায়। তাই ঐ দিন নাম্বার করেই রওনা হই। নাম্বার পেতে পেতে বিকেল হয়ে যায়। তবুও তৃপ্ত মনে শাওনকে আই ডি বি ভবনের সামনে থেকে পিক করে রওনা হয়ে যাই। পথে জাতীয় শহিদ মিনারের সামনে দারিয়ে দুজনের একখানা ছবি তুলে।……………… আবার শুরু করি। প্রচন্ড ট্রাফিক জ্যাম ভেদ করে পার হয়ে আসি কাচপুর ব্রিজ, সময় সন্ধ্যা ৬ টা ৩০।

সিলেট ভ্রমন

শাওন খুব ভালো বাইক চালায়, আমিও কম যাই না। আমরা দুজনই দুইটা বাইক নিয়ে বান্দ্রবান এক্সট্রিম রাইড করেছি সো আমাদের আত্মবিশ্বাসের কোন কমতি নেই। কিন্তু চারপাশে ধিরে ধিরে যে রাত নেমে আসছে, আর পথ ও অজানা এবং প্রায় ২০০কিমি। ভেতরে যতই আত্মবিশ্বাস থাক না কেন বাস্তব পরিস্থিতি তো বাস্তবতা দিয়েই রুখতে হবে। আর বাইকার দের কাছে সবচেয়ে অপছন্দের সময় হচ্ছে গোধুলিবেলা থেকে রাত ৮/৯ টা পর্যন্ত। কেন এই সময় খারাপ তা আর এক্সপ্লেইন করলাম না।

যা হোক, আমরা চা শেষ করে রওনা হয়ে যাই। অপরিচিত রাস্তা, অপোজিট সাইড থেকে আসা হেড লাইটের আলো, আমরা এক বাইকে দুজন ও আমার সহযাত্রির কাধের ব্যাগ সব মিলিয়ে এডজাস্ট হতে বেশ কিছুটা সময় নিয়ে ধিরে ধিরে চালাতে থাকি। আমরা দুজন ই বিশ্বাস করি যে, ট্যুরের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বেরোনোর চেয়ে সুস্থভাবে ঘরে ফেরা বেশী জরুরি। একটানা বেশ কিছুটা পথ এসে, সময়ের সাথে পুর্ন এডজাস্ট হয়ে এবার একটা ব্রেক নিই। শাওন খুব চেয়েছিলো ওর বাইক নিয়ে আসতে। কিন্ত শেষ পর্যন্ত আমরা একসাথেই আসি। ওর কাছে কোন বাইকের সহযাত্রি হওয়াটা নতুন, আর একজন ভালো বাইকার যে কতটা ভালো সহযাত্রি হতে পারে তা এই ট্যুরে বুঝেছি।

আমরা রাত ১১টায় মৌ্লভিবাজার আসি, এখানে আমার ছোটবেলার বন্ধু রাসেল এর পিড়াপিড়িতে ওর বাসায় ডিনার করে, পরের দিনের প্লান সেট করে অল্প সময়ের মদ্ধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ি। প্লান সেট করতে আমাদের যারা হেল্প করেছেনঃ আমার কলিগ তাস্ফিন ও আসিফ ভাই, সিলেটের শাহীন ভাই, কুমিল্লার রোহিত ভাই, সিলেটে আমার বন্ধু রাসেল ও শাওন, এছাড়া বিভিন্ন অনলাইন পেজ।

ট্যুর ডে-১

ভোর ৫টা ৩০এ বের হয়ে আমরা প্রথমে সিলেট উপশহরে শাওনের কাছে যাই। ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে খুব একটা দেখা হয় না, এজন্যে আমাদের ট্যুর প্লানের মদ্ধ্যে সিলেটে থাকা সব বন্ধুদের সাথে দেখা করি। শাওন সিলেটে এয়ারটেল নেটওয়ার্ক সার্ভার নিয়ে কাজ করছে, আর রাসেল প্রান গ্রুপের সিলেট রিজিওনাম ম্যনেজার। ওদের সাথে দেখা করাকালীন সময়ে ঐতিহ্যবাহী কীন ব্রিজ ও শ্রী চৈতন্য দেভ টেম্পল দেখে আমাদের আজকের গন্তব্য নির্ধারন করি জাফলং এর জৈন্তা হিল রিসোর্ট। লোবাছড়া চা বাগান, লোবাছড়া কোয়ার, লোবাছড়া- সুরমা নদীর মোহনা, জৈন্তা মেগালিথিক হিলস ও রাজবাড়ির, লালা খাল, জাফলং, জাফলং জিরো পয়েন্ট, গোয়াইন নদি,

তামাবিলঃ 

কানাইঘাট রোড দিয়ে কিছুটা এগোনোর পর পথে পুলিশের টহল কার দেখতে পেয়ে তাদের কাছে দাড়াই এবং পথের নমুনা, রিস্ক ফ্যাক্টর গুলো জেনে নিই। তারা আমাদের কে অনেক হেল্প করে। হাতের মুঠোয় জিপিএস, ম্যাপস আর লোকাল মানুষের সাথে সমন্বয় করে ছুটে চলেছি, একসময় একটা ৩ রাস্তার মোড় পেয়ে সেখানে জিঞাসা করতেই তারা লোভাছড়া হয়ে কানাইঘাট হয়ে আবার এই পথে জাফলং যেতে গাইড করে। আমরা সেভাবেই আগাই।

লোবাছড়া চা বাগানঃ 

এই বাগানটি শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বৃটিশ মালিকানাধিন। একজন বৃটিশ ভদ্রলোক এটা মেইন্টেন্যান্স করছেন, শুনেছি দির্ঘদিন বাংলাদেশে থাকার জন্যে তিনি বাংলা ও সিলেটি বাংলা ভাষা বলতে পারেন। চা বাগান টি খুব বেশী সুন্দর না হলেও, এই বাগানে সোজা ঢোকা ও বেরোনোর পথে বৃটিশ দের বানানো এবং অদ্ভুত রকমের ২ টা লোহার ব্রীজ রয়েছে। সেই সাথে আছে একটি অদ্ভুত সুন্দর বাড়ি…………

লোবাছড়া কোয়ারী পাথর ঘাটঃ

লোভাছড়া টি স্টেট অতিক্রম করে আমরাপাথর ঘাটে যাই, তেমন সুন্দর না হলেও পাহাড় চা বাগান, লোভাছড়া নদীর নীল পানি, পানিতে পাথর সব মিলে ভালো লাগবে। এখান থেকে আমরা আবার অদ্ভুত সুন্দর বাড়িতে এসে বিশ্রাম নেই।এই রাস্তাগুলো পাহাড়ি মাটির, এবং আরো ভেতরে এগুলে ইন্ডিয়া পর্যন্ত যাওয়া যাবে।এবার আমরা যাবো লোভাছড়া – সুরমা নদির মোহনা হয়ে কানাইঘাট। 

সিলেট 

লোভাছড়া  

সুরমা নদির মোহনা হয়ে কানাইঘাটঃ এ পথে যাতে হলে নৌকাই হচ্ছে একমাত্র বাহন। লক্ষে পৌছাতে আমরা লোভাছড়া চা বাগানের ঘাটে আসি। জায়গাটা বেশ সুন্দর, রেস্ট নিতে নিতে একটা নৌকা ঠিক করি কানাইঘাট পর্যন্ত, ভাড়া ৪০০ টাকা।নৌকাতে যেতে যেতে আমরা বেশ কিছু ছবি তুলি, পানি স্বচ্ছ হওয়ায় গোসল করি, শুকনা কিছু খাবার খেয়ে নিই। এখানে আমরা উল্লেখিত জায়গা গুলোর পাশাপাশি নদীর কিছুটা দূর ঘেষা ইন্ডিয়ান পাহাড় গুলো দেখি। বিপত্তি বাধে এবার বাইক উপরে ওঠাতে। মানুষ পারাপারের রাস্তা থাকলেও কানাইঘাটে বাইক উপরে পাড়ে তোলার তেমন জায়গা নেই। কিছুদুরে আমরা কাদার মধ্যেই বাইক নামাতে বাধ্য হই। উঠে আসি কানাইঘাট।

এবার পানি এবং চা খেয়ে আমরা রওনা হই জাফলং। সিলেটের বাইরের এইসব জায়গার চা খেতে বেশ ভালো লেগেছে। এবার আবার গ্রামের পথ ধরে আসি জাফলং রোডে।

লভাছরা

জৈন্তা মেগালিথিক হিলস ও রাজবাড়িঃ 

জাফলং রোডে সামনে আগাতেই ২ টা রোড দেখাযায়, যার একটা জাফলং অন্যটা জৈন্তার দিকে গিয়েছে। যেহেতু এই পথে আর আসা হবে না, তাই ঢুকে পড়ি জৈন্তার রাস্তায়। জৈন্তা মেগালিথিক হিলস ও রাজবাড়ির অনেক ইতিহাস রয়েছে, যা ইন্টারনেটে আছে তাই এখানে লিখা বাড়ালাম না। তবে আমাদের কাছে এগুলো এতটা ভালো লাগেনি। এখানে কিছু ছবি তুলে, গ্রামের ভেতরের মাটির রাস্তায় ছুটতে থাকি লালা খালের দিকে।

জৈন্তাহিল

লালা খালঃ

জৈন্তা মেগালিথিক হিলস ও রাজবাড়ির পর আমরা গ্রাম্য মাটির রাস্তা ধরে এগিয়ে চলি লালাখাল এর পথে। তবে এখানে আমাদের কিছুটা ভুল ছিলো রাস্তা নির্ধারনে, আগে লালাখাল দেখে পরে রাজবাড়ি গেলে রাস্তা কিছুটা কমে আসতো। যা হোক আমরা লালাখাল ঘাট পার হয়ে বিজিবি ক্যাম্পে এসে পানির কাছে কিছু ছবি তুলে ফেলি এবং দুজনেই ২/৩ মগ করে পানি খাই। প্রচুর পানির তেষ্টা পেয়েছিলো। লালাখাল বেশ সুন্দর জায়গা, সময় নিয়ে দেখার মত প্লেস। আমাদের মাথার উপর জাফ্লং যাওয়ার চিন্তা থাকায় এখানে আর সময় না দিয়ে বেরিয়ে পড়ি।

জৈন্তা হিল রিসোর্টঃ

এইখানে আসার মেইন রোড অনেক রিস্কি এবং পাহাড়ি ঢালের, যার উপর প্রচুর পাথরের টুকরো ছড়ানো, তাই অনেক স্পিডে রাইড করলেও অনেক সাবধান ছিলাম। সারাদিন অনেক যায়গা দেখে এখানে এসে আমরা বুঝতে পারি যে আমরা সময়ের চেয়ে এগিয়ে আছি।রিসোর্ট থেকে মেঘালয় পাহাড় এবং ২ টা ঝরনা সরাসারি দেখা যায়। আপুর্ব সুন্দর মনোরম দৃশ্য। লোভাছড়া নদীর গোসল আমাদের ক্লান্তীহিন রেখেছে। এবার রিসোর্টে রুমে কোন দেরী না করে পড়ন্ত বিকেলেই আমরা বেরিয়ে পড়ি জাফলং পয়েন্টে।

জৈন্তা হিল রিসোর্ট জাফলং

জাফলং জিরো পয়েন্টেঃ

ইন্ডিয়ার ডাওকি ঝরনার সহ অন্যান্য ঝরনার পানি জাফলং এর এই গিরো পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।বাংলাদেশে এই বহমান পানির পথ কেই আমরা জাফলং এর গোয়াইন নদী বলে থাকি।যা হোক, আমরা বাইক নিয়ে ডিরেক্ট জিরো পয়েন্টে যাই এবং সাথে সাথে বিজিবি ক্যাম্পে জিয়ে বাইক এখানে রাখার পারমিশন নিই। এরপর আমরা একে একে গোসল করি, ছবি তুলি, এখানেই সুর্যাস্ত হয়ে যায়। এবার উপরে উঠে এসে চা খেতে খেতে পরের দিনের ধারোনা নিই এবং রিসোর্টে এসে বাইরে বসে সময় উপভোগ করি। ভেবে খুশিই হই যে আমাদের আজকের অর্জন কতখানি।

রাধানগর চা বাগান, পান্থুমাই, বিছানাকান্দি, রাতারগুল, বাইক্কা বিল, সুনামগঞ্জ সদরঃ

বুঝতে পারছিলাম না যে কেন এই সমস্ত প্লেসে আমরা ছাড়া কোন টুরিস্ট নেই, পরে জানলাম যে সাঈদির রায় উপলক্ষ্যে কাল সারাদেশে হরতাল। সিলেটের হরতাল কড়াকড়ি হয়, আমরাও টেনশনে পড়ে গেলাম।

তামাবিল সিমান্তঃ 

সকাল ৬ টায় আমরা তামাবিল সিমানে গেলাম, এখানে ইন্ডিয়ার বাস, ট্রাক, রাস্তা কয়লা- পাথরের স্তুপ দেখে ফিরে এলাম জাফলং খেয়া ঘাটে, এসে সকালের নাস্তা করি, দেরি না করে বেরিয়ে পড়ি, বিছানাকান্দি না দেখা পর্যন্ত যেন দুজনের মনে শান্তি নেই।

রাধানগর চা বাগানঃ 

জাফলং খেয়া ঘাট পার হয়েই শুরু হবে এই চা বাগান। এই বাগানটি বেশ সুন্দর। এখানে ১০ মিনিট সময় নিয়ে আমরা কিছু ছবি তুলি, বাগানের মাঝের রাস্তা গুলোও বেশ ভালো। সামনে যেতে যেতে লোকাল মানুষের মুখে শুনলাম যে আগে যদি পান্থুমাই দেখে যাই তাহলে ভালো, বিছানাকান্দি দেখে আসতে গেলে অনেক ঘোরা পথ হয়ে যাবে।

পান্থুমাই ঝরনা

পান্থুমাই ঝরনাঃ

এবার আমরা পান্থুমাই হয়ে বিছানাকান্দি যাবো এ সিদ্ধান্তে এগিয়ে চলি।পান্থুমাই যাবার পথে আমরা মাটির রাস্তায় প্রায় ৩/৪ কিমি পথ পেরিয়ে চলে আসি ঝরনার কিনারায়। এখানে তেমন কোন মানুষ চোখে পড়লো না। আমরা কিছুক্ষন ঝরনা ও পাহাড় উপভোগ করে রওনা হই বিছানাকান্দির উদ্দেশ্যে।

বিছানাকান্দিঃ

লোকাল মানুষের সাহায্যে আমরা খুব দ্রুতই চলে আসি হাদারপাড় খেয়া ঘাটে। খেয়া ঘাটে এসেই দূর থেকে দেখতে পেলাম বিছানাকান্দির পাহাড়গুচ্ছ। হাদারপার খেয়ে ঘাট পার হয়ে মাটি পাথরের রাস্তা ধরে চলে আসি বিছানাকান্দির পাহাড়ের পাশে। আর যাওয়ার রাস্তা নেই। কিন্তু এত দূর থেকে পাহাড় গুলো দেখে মনে শান্তি পাচ্ছিলাম না। পাথর তোলা চিকন নৌকা ঠিক করে নিলাম। কি যে সেই রিস্কি পারাপার, কয়েকবার বাইক সহ পানির মদ্ধে পড়তে পড়তে বেচে গিয়েছি। বিছানাকান্দির গা ঘেষা বিজিবি ক্যাম্পের পাশে ২ টা দোকানে এসে একটু চেয়ারে বসি দুজন। নতুন বাইক এর দিকে তাকিয়ে খুব খারাপ লাগছিলো। মাত্র ৩০০০ কিমি চলেছে আর দেখে মনে হচ্ছে ৫ বছরের পুরোনো।

বিছানাকান্দি

আর না বসে বাইক নিয়ে ঝরনার পানিতে নামিয়ে দিলাম। ওয়াশ করে কোন লাভ নেই জেনেও কিছুটা ওয়াশ দিয়ে নিয়ে এলাম দোকান টার শেড এর নিচে। এবার আমাদের গোসলের পালা। দোকানে গামছা কিনতে পাওয়া গেল ৫০ টাকায়, আজ হরতাল, পর্যটক বলতে শুধু আমরাই, তাই ওখানকার মানুষের আমাদের আপ্যায়নের শেষ নেই। আরাম করে বসলাম ঝিরিপানির মধ্যে পাথরের উপরে।ঠিক ন্যাচারাল সুইমিং পুল এবং জ্যাকুজি তে গোসল করলাম, মাছ ধরলাম। প্রায় ২ ঘন্টা ধরে গোসল করে উঠে এলাম, এবং পাশের শেড এর নিচে বসে নয়নাভিরাম বিছানাকান্দির কোলে বসে টাটকা মাছের তরকারী দিয়ে ভাত খেলাম। এবার ফেরার পালা, গন্ত্যব্য রাতারগুল।

রাতারগুল জলা বনঃ

বিছানাকান্দি খেয়া পার হয়ে স্থানিয়দের সহায়তায়, আমরা চলে আসি রাতারগুল। এখানে নিরাপদ পার্কিং এ বাইক পার্ক করে একটা নৌকা ঠিক করে ফেলি ৫০০ টাকায়। এই জায়গাটা কেন সারা দেশের মানুষের কাছে এত ভালো লেগেছে আর কেনই বা এত নৌকার ভাড়া তা আমার মাথায় আসলো না। তবে এই নদীতে যদি পানিতে পুর্ন থাকতো তাহলে হয়ত আমার অনুভুতির পরিবর্তন হত। যা হোক, মাঝিকে অনুরোধ করতেই সে আমাদের স্থানীয় ভাষায় গান শোনাল। আমরা ক্লান্তি কাটাতে অনেকগুলো আখ কিনেছিলাম, সেগুলো নৌকায় বসে খেয়ে নিলাম, আর হেলান দিয়ে শুয়ে কিছুটা রেস্ট করে নিলাম। এবার আমাদের গন্তব্য সুনামগঞ্জ এর টেকের ঘাট।

রাতারগুল জলা বন

আমরা রাতারগুল থেকে সরাসরি সুনামগঞ্জের টেকের ঘাটে গিয়ে রাতে থাকবো এবং পাহাড় ঝরনা দেখতে দেখতে মোহনগঞ্জ, শেরপুর, ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকা ব্যাক করবো। এই প্লানে আমরা রাতারগুলের নৌকা ছেড়ে টেকের ঘাটের পথে রাইড শুরু করি। পরপর দুই দিনের এই এক্সট্রিম রাইড শেষের দিকে আমরা একমত হলাম যে, রাতের বেলা টেকের ঘাট গেলে অন্ধকারে আমরা বড় ছড়া এবং বারেকটিলা দেখতে পাবোনা, এর চেয়ে আমরা সুনামগঞ্জ রাতে থাকি এবং সকালে এখান থেকেই রওনা হই। এই প্লানে আমরা আবার সুনামগঞ্জের পথে রওনা হই।

সুনামগঞ্জ শহরঃ 

সুনামগঞ্জ এসে আমাদের প্রথম কাজ হলো বাইকের ইঞ্জিন অয়েল চেঞ্জ সহ টুকটাক কাজ করিয়ে নেওয়া। কাজ করিয়ে আমরা হোটেল খুজে হোটেলে চলে আসি। কিছুটা ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবারের জন্য বেরিয়ে পড়ি। হোটেলে খাওয়া শষ করে আমরে বাস স্টান্ডে এসে আমাদের রুট নিয়ে বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলি। রুটটি হলোঃ বড় ছড়া, বারেকটিলা, টেকেরঘাট, মোহনগঞ্জ, শেরপুর, ময়মনসিংহ- ঢাকা। আমি যতদুর জানি এই রুটে কোন বাইকার ঢাকা আসেনি সুনামগঞ্জ থেকে। আমরা আসবো ঠিক করলাম।

সকালে ঘুম ভাংলো বৃষ্টির শব্দে, শরিরে ক্লান্তি থাকায় ঘুম হলো ৭টা পর্যন্ত, আর উঠে বৃষ্টি দেখে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আমাদের দুজনের ই ঢাকাতে রেইন কোর্ট আছে, কিন্তু ফ্রেশ ওয়েদার আর বারতি ওজন হবে জন্যে সেটা বহন করিনি। কিন্তু যাবার দিনে এত ভারি বৃষ্টি দেখে বেশ আপসোস হল কেন আনলামনা। সকাল ১০ টা বাজে কিন্তু ভারি বর্ষনে সুনামগঞ্জ শহর তখনো ঘুমন্ত। শুক্রবার সুনামগঞ্জে বাজার খোলা পাওয়া মুশকিল। এখন কি করি রেইন কোর্ট কিভাবে কিনবো আর ঢাকা কিভাবে ফিরবো।

সুনামগঞ্জ

নতুন রুটের চিন্তা তখন শ্বপ্নে পরিনত হয়েছে, কারন ঐ রাস্তা প্রায় ৪০০ কিমি, যার প্রথম ১০০ কিমি রাস্তা এই ভারি বর্ষনে বাইক চালানোর প্রায় অনুপযোগী। সময় ও নেই হাতে। আমরা বসে না থেকে নতুন প্লানে বেরিয়ে পরলাম। একটা ব্যাটারি গাড়ি নিয়ে আমরা প্রথমে একটা হোটেল থেকে পরোটা ডিম তরকারী কিনে আনলাম, এরপর ঐ গাড়িতেই নাস্তা খেতে খেতে চলে গেলাম হাসন রাজা মিউজিয়াম। ফেরার পথে মধ্য বাজারে কিছু দোকান খোলা পেলাম।ব্যাটারি গাড়ি ছেড়ে দিয়ে এবার রেইন কোর্ট খোজা স্টার্ট করলাম।রেইন কোর্ট পেলাম কিন্ত সেগুলো কেনার উপযোগী নয়। এবার আমরা ৩ গজ মোটা পলিথিন কিনে ১ গজ করে কেটে নিলাম। ১ টা আমার, ১ টা শাওনের এবং ১ টা ব্যাগের জন্যে।

হোটেম রুমে ফিরে এসে পলিথিন গুলো গায়ে জরিয়ে তার উপর গেঞ্জি পড়ে দ্রুতই আমরা রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ি। প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে আমাদের গন্তব্য এবার উফা বিল, নুল্লাহ হাওর হয়ে মৌলভিবাজার- শ্রীমংগল।

উফা বিল এবং নুল্লাহ হাওরঃ 

মেঘ মুক্ত শরৎ কালের এই সময়ে হাওর-বিল পর্যটকদের কাছে কেমন লা্গত সেটা জানিনা, কিন্তু প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে আমরা এই সমস্ত এলাকার যে রুপ দেখে এসেছি তা অতুলনীয়। আমরা আমাদের সমস্ত টুলস প্যাক করে ব্যাগে রেখে দিয়েছিলাম, তাই পথে লোকাল মানুষের সাহায্যই একমাত্র ভরসা। এভাবে বৃষ্টির মধ্যে ১ ঘন্টা রাইড করার পর আমরা গ্রাম্য পথে ঢুকে পড়ি শর্টে সিলেট শহড়কে পাশ কাটিয়ে মৌলভিবাজার যাবার আশায়। বৃষ্টি কিছুটা কমলেও আকাশে মেঘ থাকায় আমরা ড্রেস চেঞ্জ না করেই আগা

এবার শুরু হলো বাজে রাস্তা। আহ বাজে রাস্তা কাকে বলে। এই রাস্তার ভিডিও টা পরবর্তীতে বাইক বিডি পেজ এ শেয়ার করবো। পিচ ঢালাই রাস্তার ৩ভাগের ২ ভাগ ই উঠে গিয়েছে এবং বড় বড় গর্ত হয়ে গিয়েছে। এমন রাস্তা তে প্রায় ১৫ কিমির মতো চালাই। এভাবে বিভিন্ন টাইপের গ্রাম্য রাস্তা শেষ করে আমরা একসময় চলে আসি মৌলভিবাজার শহড়। কিন্তু এওময় একদম নেই, সাথে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ৫ মিনিট রেস্ট নিয়ে আবার রাইড শুরু করি। এবার টার্গেট লাওয়া ছড়া রেইন ফরেস্ট।

লাওয়াছড়া রেইন ফরেস্টঃ 

এই জংগল নিয়ে কম বেশী সবাই জানেন। আমাদের কাছে এখানে কিছুটা পার্থ্যক্য গড়ে দেয় প্রচন্ড বৃষ্টি। রেইন ফরেস্টে রেইন পাওয়াটা আমাদের বারতি ভালোলাগা যোগ করলো। যা হোক বনের ভেতরে আমরা কিছু ছবি তুলে চা খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়ি সাতছড়ি উদ্দ্যানের পথে। বলে রাখা প্রয়োজন যে, এই রাস্তাগুলো ছিলো বাইক চালানোর জন্য অসাধারন।

সাতছড়ি উদ্দ্যানঃ 

লাওয়াছড়া উদ্দ্যান থেকে বেরিয়ে সাতছড়ার পথে কিছুটা পথ গিয়ে আমরা রাস্তার দুপাশে চমৎকার চা বাগান দেখেই দাঁড়িয়ে পড়ি। আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হল বৃষ্টি হয়ত হবে না। চা বাগানের মধ্যে একটা ব্রিজ দেখে আমরা এবার সারাদিনের ভেজা কাপড় চেঞ্জ করা শুরু করি। এমনিতে কোন লোকজন না থাকলেও ১০ মিনিটের মধ্যে আমাদের চারপাশে বেশ ভিড় হয়ে যায়। আমরা তাদের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। যখন সাতছড়ি বনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন বেশ কিছু বন্য শিয়াল রাস্তা পার হতে দেখি। বৃষ্টির পরে চার পাশে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসে বনের ভেতরের রাস্তায় এক ভিতিকর পরিবেশের তৈ্রি হলো। যতদুর মনে হলো এটা মেইন রোড, কিন্তু প্রায় ২০ কিমি অঞ্চলের মধ্যে কোন জন মানুষের দেখা নেই। রাতের আধারে সাতছড়ি আর ভালো ভাবে দেখা হলনা।আমরা আরো কিছু রাস্তা পেরিয়ে চলে এলাম ভৈ্রব ব্রিজে।

এবার প্রায় ১৫ মিনিট ব্রেক নিয়ে রাত প্রায় ৮ টার দিকে আমরা রওনা হই ঢাকার উদ্দেশ্যে। আর ভৈ্রব পার হতেই আবার শুরু হল বৃষ্টি। এই বৃষ্টি আর কমেনি, আমরা ডেমরা হয়ে যাত্রাবাড়ি পার হই রাত ১০ টা ৩০ এ।

এভাবেই শেষ হয় আমাদের মৌলভিবাজার-সিলেট-সুনামগঞ্জ ট্যুর। আর আমিও আমার বাইকের পারফেক্ট ব্রেক ইন ক্রস করি।

-তাইমুর হাসান

আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন ফেসবুক এ 

আপনার নিজের বাইকের ভ্রমন কাহিনি লিখে পাঠাতে পারেন bikebd@gmail.com ঠিকানায়।