মোটরসাইকেলে প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের ইঞ্জিন ও তাদের বিবরন
This page was last updated on 26-Nov-2024 05:15pm , By Saleh Bangla
ইঞ্জিনের গর্জন ও একজষ্টের শব্দসহ মোটরসাইকেল নিয়ে একটি রোমাঞ্চকর লম্বা রাইড অনেকের কাছেই এক ধরণের স্বাধীনতার বহি:প্রকাশ এবং অনেকটা এ্যাডভেঞ্চারের মতোই। মোটরসাইক্লিংয়ের এই অনন্য আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতার পিছনের চালিকাশক্তিটি কিন্তু মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন, যেটিকে একটি মোটরসাইকেলের হার্ট বলা যেতে পারে।
তবে যাইহোক, আধুনিক এই সময়ে আমরা বিভিন্ন ধরণের এবং ক্যাটাগরির মোটরসাইকেল রাস্তায় চলতে দেখি। আর এই বিভিন্ন মডেলের মোটরসাইকেলগুলি বিভিন্ন ধরণের ইঞ্জিন নিয়ে বাজারে আসে, যাতে তাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য এবং সুবিধা বিরাজমান। তো সেইসূত্রেই, আজ আমরা মোটরসাইকেলে প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের ইঞ্জিন ও তাদের বিবরন এখানে তুলে ধরছি।
মোটরসাইকেলে প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের ইঞ্জিন ও তাদের বিবরন
মোটরসাইকেল মূলত: তাদের স্টাইলিশ লুক, ডিজাইন, ও চমৎকার পারফরম্যান্সের জন্য বিশ্বব্যাপী বাহন হিসেবে প্রায় সবার কাছেই অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাই ম্যানুফ্যাকচারাররা রাইডারদের ধরণ ও চাহিদাভেদে বিভিন্ন ধরণের মোটরসাইকেল যেমন বাজারে ছাড়ে, তেমনি বিভিন্ন মডেলের মোটরসাইকেলে বিভিন্ন ধরণের ইঞ্জিনও সংযুক্ত করে।
আর ধরন ও শ্রেণী অনুসারে, প্রতিটি মোটরসাইকেল ইঞ্জিনের নিজস্ব কাঠামো এবং নির্মাণশৈলী রয়েছে। সেইভাবে বিভিন্ন ইঞ্জিনের বৈশিষ্ট্য ও সক্ষমতাও আলাদা। তাই মোটরসাইকেল ভেদে ক্লাসিক এবং সরলভাবে ডিজাইন করা সিঙ্গেল-সিলিন্ডার ইঞ্জিন যেমন রয়েছে, তেমনি আধুনিক মাল্টি-সিলিন্ডার জটিল ইঞ্জিনও রয়েছে। যাইহোক, এখানে প্রচলিত ধরণের মোটরসাইকেল ইঞ্জিনগুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো।
সিঙ্গেল-সিলিন্ডার ইঞ্জিন:
সিঙ্গেল-সিলিন্ডার ইঞ্জিন প্রায় সবধরণের মোটরসাইকেলেই একটি বহুল প্রচলিত ধরণের ইঞ্জিন, যা সাধারণত এন্ট্রি-লেভেল এবং লাইটওয়েট ধরণের মোটরসাইকেলগুলিতেই পাওয়া যায়। এগুলি নির্মাণে যেমন সহজ তেমনিই এফিশিয়েন্ট। এই ইঞ্জিনগুলি কেবল একক সিলিন্ডার, পিস্টন, এবং স্পার্ক প্লাগ নিয়ে তৈরী হয়।
তাই এসব ইঞ্জিন লাইটওয়েট কন্সট্রাকশন, কমপ্যাক্ট ডিজাইন, এবং ফুয়েল এফিশিয়েন্সির জন্য অত্যন্ত প্রশংসিত। আর সিঙ্গেল-সিলিন্ডার ইঞ্জিনগুলি তাদের লো-কস্ট অপারেশন, সহজ মেইনটেন্যান্স ও ম্যানেজেবল পাওয়ার ডেলিভারির জন্য যেকোনো ক্যাটাগরীর বেশিরভাগ বিগিনার ক্লাস মোটরসাইকেলগুলির জন্য আদর্শ ইঞ্জিন হিসেবে গন্য করা হয়।
প্যারালাল-টুইন ইঞ্জিন:
প্যারালাল-টুইন ইঞ্জিনও অত্যন্ত প্রচলিত ধরনের মোটরসাইকেল ইঞ্জিন, যা মূলত: এন্ট্রি-লেভেল থেকে মিড-ক্যাপাসিটি মোটরসাইকেলে ব্যবহার করা হয়। এইধরণের ইঞ্জিনে দুটি সিলিন্ডার, দুটি পিস্টন, এবং দুটি স্পার্ক প্লাগ সমান্তরালভাবে একটি সিলিন্ডার ব্লকে পাশাপাশি কনফিগারেশনে থাকে। এই ইঞ্জিন ডিজাইন মূলত: একটি ইঞ্জিনে সুষম পাওয়ার ডেলিভারী, স্মুথনেস, ও কম্প্যাক্ট স্ট্রাক্চার সুসমন্বয় করে।
এর ফলে প্যারালাল-টুইন ইঞ্জিনগুলি যেকোনো মোটরসাইকেলে যথেষ্ট টর্ক ও চমৎকার মিড-রেঞ্জ পাওয়ার ডেলিভারি দিতে পারে। ফলত: এসব ইঞ্জিন একটি মোটরসাইকেলকে সাধারণ সিটি ক্রুজিং থেকে শুরু করে স্পিডি হাইওয়ে রাইড উভয়ের জন্য সমান যোগ্য করে তোলে। আর তাই মিড-ক্লাস স্ট্রিট স্পোর্টবাইক থেকে শুরু করে এখনকার অ্যাডভেঞ্চার বাইকগুলোতেও প্যারালাল-টুইন ইঞ্জিন ব্যপকভাবে ব্যবহার করা হয়।
ভি-টুইন ইঞ্জিন:
গ্লোবাল মোটরসাইকেল ইন্ডাষ্ট্রিতে ভি-টুইন ইঞ্জিন সেই প্রাইমিটিভ পিরিয়ড থেকেই ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় একধরনের ইঞ্জিন। বিশেষ করে কিছু ক্যাটাগরী ডেডিকেটেড মোরসাইকেল যেগুলি ওয়েষ্টা্র্ণ মোটরসাইক্লিং লিগ্যাসি বহন করে, সেসবের কারনে ভি-টুইন ইঞ্জিন এখনো বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয়। ভি-টুইন ইঞ্জিনগুলিতে মূলত: দুটি পৃথক ও স্বতন্ত্র সিলিন্ডার ব্লক একটি ভি-আকৃতির কনফিগারেশনে সাজানো থাকে।
ভি-টুইন ইঞ্জিনের সিলিন্ডার ব্লকের এই নির্দিষ্ট ভি-শেপ ডিজাইন এবং ভি-এ্যাঙ্গেলটি ইঞ্জিন ও একজষ্টে একটি স্বতন্ত্র রাম্বল সৃষ্টি করে এবং বিশেষ মাত্রায় টর্ক ডেলিভারীর জন্যও এই ইঞ্জিনগুলি বিখ্যাত। সেই কারনে ভি-টুইন ইঞ্জিনগুলি কিছু এডভেঞ্চার মোরসাইকেলের সাথে সাথে সাধারণত ক্রুজার ক্যাটাগরির মোটরসাইকেলগুলিতেই বেশি দেখা যায়। সেখানে তাদের লো-এন্ড গ্রান্ট এবং অনন্য একজষ্ট নোটগুলি ভি-টুইন ইঞ্জিনের সিগনেচার মার্ক হিসেবে বিবেচিত হয়।
ইনলাইন-থ্রি ইঞ্জিন:
ইনলাইন-থ্রি ইঞ্জিনগুলি তুলনামূলকভাবে অনেকটা কম প্রচলিত ধরণের মোটরসাইকেল ইঞ্জিন, যা ইনলাইন-টু ইঞ্জিনের মতো একটি সিলিন্ডার ব্লকে একসারিতে সারিবদ্ধভাবে তিনটি সিলিন্ডার, পিস্টন, এবং স্পার্ক প্লাগ নিয়ে গঠিত হয়। এই অনন্য কনফিগারেশন বিশেষ করে তিনটি পিষ্টনের ভিন্ন ক্র্যাঙ্ক অ্যাঙ্গেল এফিশিয়েন্ট পাওয়ার ডেলিভারি, স্মুথনেস, এবং কম্প্যাক্টনেসের একটি অনন্য সমন্বয় নিশ্চিত করে।
ফলে ইনলাইন-থ্রি ইঞ্জিনগুলি তাদের হাই-রেভিং ক্যারেক্টারিস্টিকস, লিনিয়ার পাওয়ার ডেলিভারি, এবং অপটিমাম ফুয়েল এফিশিয়েন্সির জন্য নিবেদিত। আর একারনেই ইনলাইন-থ্রি ইঞ্জিনগুলি সাধারণত আধুনিক হাই-পারফর্মেন্স মিড-ক্যাপাসিটি এমনকি বিশেষ কিছু হাই-ক্যাপাসিটি স্পোর্টবাইক, নেকেড স্ট্রিটফাইটার, এবং ট্যুরিং বাইকেও দেখা যায়।
ইনলাইন-ফোর ইঞ্জিন:
ইনলাইন-ফোর ইঞ্জিন হলো অত্যন্ত জনপ্রিয় ধরনের মোটরসাইকেল ইঞ্জিন যা হাই-ক্যাপাসিটি ও হাই-পারফরম্যান্স মোটরসাইকেলগুলিতেই দেখা যায়। এই ইনলাইন-ফোর ইঞ্জিন সাধারণ মোটরগাড়িতেও ব্যপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এই ইঞ্জিনগুলিতে মূলত: চারটি সিলিন্ডার একই ব্লকে একসারিতে সাজানো থাকে, আর একই সিলিন্ডার ব্লকে চারটি পিস্টন, চারটি স্পার্ক প্লাগ, এবং একটি চার-সিলিন্ডার হেড সেটআপও থাকে।
ইনলাইন-ফোর ইঞ্জিনগুলি সুপারিয়র পাওয়ার, টপ-নচ পারফর্মেন্স, এফিশিয়েন্সি, ও সমুথনেস প্রদানের জন্য জনপ্রিয়। আর তাই এই ইঞ্জিন কনফিগারেশন হাই-পারফরম্যান্স মোটরসাইকেলের সমার্থক। কেননা, ইনলাইন-ফোর ইঞ্জিনযুক্ত মোটরসাইকেলগুলি এক্সট্রিম এক্সিলারেশন, একসেপশনাল টপ-এন্ড স্পিড, ও সুপারিয়র পারফরম্যানন্সের জন্যই পরিচিত। তাই সুপার স্পোর্টবাইক, হাইপার-নেকেড স্পোর্টবাইক, এবং সুপার অ্যাডভেঞ্চার বাইকগুলিতে ইনলাইন-ফোর ইঞ্জিনই দেখা যায়।
বক্সার ইঞ্জিন:
মোটরসাইকেলে বক্সার টইপ ইঞ্জিন বিশেষ একধরণের পারফর্মেন্স ইঞ্জিন। এগুলি মূলত: বিশেষ একটি শ্রেনীর হাই-পারফরম্যান্স মোটরসাইকেল ছাড়া দেখা যায় না। এই বিরল ধরনের ইঞ্জিনগুলি অনন্যভাবে ডিজাইন করা এবং বেশকিছু ডেডিকেটেড ফিচারসহ তৈরী হয়। বক্সার ইঞ্জিনগুলিকে ফ্ল্যাট-টুইন ইঞ্জিনও বলা হয়, যাতে দুটি পৃথক ও স্বতন্ত্র সিলিন্ডার ব্লক একে অপরের বিপরীত দিকে অনুভূমিকভাবে বসানো থাকে।।
বক্সার ইঞ্জিনের সিলিন্ডার এবং পিস্টনের এই অনন্য বিন্যাসের ফলে তা আকারে বেশ বড়ো হলেও তা ব্যতিক্রমী ধরনের সেন্টার-অফ-গ্র্যাভিটি, চমৎকার ব্যালান্স, ও মসৃণ পাওয়ার ডেলিভারী নিশ্চিত করে। আর এই ব্যতিক্রমী ধরনের ইঞ্জিনগুলি সাধারণত BMW ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলেই দেখা যায়, যেখানে ইঞ্জিনগুলির অনন্য কনফিগারেশন একসেপশনাল ইঞ্জিন পারফর্মেন্স, সুপারিয়র হ্যান্ডেলিং, ও স্ট্যাবিলিটি নিশ্চিত করে। আর এই হরাইজন্টাল এলাইনড সিলিন্ডার কনফিগারেশন একটি সিগনেচার ইঞ্জিন নোটও তৈরি করে যা BMW মোটরসাইকেলগুলিতে নিঃসন্দেহে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য যোগ করে।
রোটারি ইঞ্জিন:
রোটারি ইঞ্জিন এখন পর্যন্ত মোটরসাইকেলে ব্যবহৃত অত্যন্ত বিরল একধরণের ইঞ্জিন। আধুনিক মোটরসাইকেলগুলিতে এই ইঞ্জিনের ব্যবহার খুবই বিরল। তবে, রোটারি ইঞ্জিন একটি অনন্য ইঞ্জিন ডিজাইন এবং স্ট্রাকচার নিয়ে তৈরী হয় যেখানে একটি ত্রিভুজাকার রোটর একটি ক্লোজড চেম্বারের মধ্যে ঘোরে। এর ফলে রোটেশনাল পাওয়ার উৎপাদন হয়ে সেটি সরাসরি রোটর শ্যাফ্টের মাধ্যমে সরবরাহ হয়।
রোটারি ইঞ্জিন ডিজাইনে বেশ অপ্রচলিত ধরনের ও কিছুটা জটিল। তবে এটিও কিছুটা কম্প্যাক্ট ডিজাইনের এবং স্মুথ পাওয়ার ডেলিভারী দিতে সক্ষম। এই ইঞ্জিনগুলি মূলত: 1970 এবং 1980 এর দশকে বেশকিছু মোটরসাইকেলে ব্যবহৃত হতো। তবে রোটারি ইঞ্জিনের জটিল গঠন, জটিল রক্ষণাবেক্ষন, এবং নির্ভরযোগ্যতার সমস্যার কারণে এখন তাদের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন বলা চলে।
ইলেকটিক মোটর:
ইলেকটিক মোটর হল আধুনিক মোটরসাইকেল এবং স্কুটারের একটি আধুনিক সংযোজন। ইলেকটিক মোটরগুলি মূলত: অন্যান্য ইলেকট্রিক ভেহিকেলের সাথে সাথে এখনকার ইলেকট্রিক মোটরসাইকেল এবং স্কুটারে ব্যবহৃত হয়। এগুলি সাধারণ ধরনের ইলেকট্রিক মোটর যা পেট্রোল ইঞ্জিনের পরিবর্তে রিচার্জেবল ব্যাটারি থেকে শক্তি নিয়ে চলে।
ইলেকটিক মোটরগুলি ইমিশন-ফ্রি, শব্দহীনভাবে চলে, ইন্সট্যান্ট টর্ক ডেলিভারি দিতে পারে, আর তাদের পরিবেশবান্ধব কর্মক্ষমতার জন্য এখনকার সময়ে বেশ জনপ্রিয়। ইলেকট্রিক মোটরগুলি লিনিয়ার এক্সিলারেশন ও পাওয়ার ডেলিভারি যেমন দিতে পারে, তেমনি প্রচলিত ইন্টারনাল-কম্বাশ্চন ইঞ্জিনগুলির তুলনায় তাদের কম মেইনটেন্যান্সের প্রয়োজন হয়। ফলে, ইলেকট্রিক মোটর প্রচলিত পেট্রল ইঞ্জিনগুলোর পাশাপাশি এখনকার আধুনিক ইলেকট্রিক টু-হুইলারে তাদের স্থান করে নিচ্ছে।
তো বন্ধুরা, এই ছিলো মোটরসাইকেলে প্রচলিত দৃশ্যমান এবং উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন ধরণের ইঞ্জিনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। মূলত: এই ইঞ্জিনগুলি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ধরণের মোটরসাইকেলে ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে এই ইঞ্জিনগুলির সাথে সাথে কিছুটা ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের আরো কিছু ইঞ্জিন কিছু কিছু মোটরসাইকেলে দেখা যায়, যা মূলত: ব্যতিক্রমী ক্যাটাগরীতে পড়ে। তবে সাধারণভাবে উপরে উল্লেখিত ইঞ্জিনগুলি বহু বছর ধরে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন মোটরসাইকেলে ব্যবহার হয়ে আসছে।