একটি দুঃসাহসিক মোটরবাইক ভ্রমনের গল্প (১ম পর্ব)

This page was last updated on 06-Jul-2024 09:07am , By Shuvo Bangla

ভ্রমনের রুটঃ ঢাকা -বান্দরবন -নিলগীরি- রুমা- পতেংগা- ঢাকা (৫ দিনে ১২০০ কিমি দুঃসাহসিক মোটরবাইক ভ্রমন)।

একটি দুঃসাহসিক মোটরবাইক ভ্রমনের গল্প

শুরুর কথাঃ

আমরা যারা ব্যাস্তময় জীবনে আছি তাদের জন্য ৫দিন সময় নিজের জন্যে বের করে মোটরবাইকে এডভেঞ্চারে বের হওয়া এবং সেই ভ্রমনের গল্প পরবর্তি প্রজন্মের জন্যে সাহায্য স্বরুপ লিখে যাওয়া আনেক অনেক কস্টসাধ্য ব্যাপার। তবুও এখন এই কমুনিকেশনের যুগে আছি তাই আপনাদের জানাতে পারছি। বাংলাদেশে এখন আমার মতো অনেকেই বাইক ও বাইকার এসব নিয়ে চিন্তা করছে বা কাজ করে যাচ্ছে, যাদের মদ্ধ্যে শুভ্র সেন দাদা কে এখন আর বাইকারদের কাছে নতুন করে পরিচিত করে দেবার দরকার নেই। সব বাইকারদের নিয়ে কাজ করার জন্য তার অক্লান্ত সময়-শ্রম-অর্থ দিয়ে গড়া বাংলাদেশের প্রথম ওয়েব পেজ বাইকবিডি আজ আমাদের সবার পরিচিত। বাংলাদেশের সমস্ত বাইকারদের পক্ষ থেকে শুভ্র দা ও তার বাইকবিডি টিমকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

তাইমুর হাসান

ভ্রমনের প্রস্তুতিঃ

ঢাকা থেকে আমি তাইমুর হাসান সাথে পালসার ১৩৫ এবং শাওন বিশ্বাস সাথে এপাচি ১৫০ এবং সহযাত্রি হিসেবে রাশেদ ও কাম্রুজ্জামান এই চার জনের একটি দলের কেওকাড়াডং পর্যন্ত মোটরবাইকে যাবার প্রবল ইচ্ছা প্রকাশ করি। যদিও আমাদের কেও বান্দরবন-ই কখনও যাইনি, তবুও সেখানে যাবো বলেই মনস্থির করি। স্বপ্ন ও বাস্তবতার মধ্যে যে এত পার্থ্যক্য হবে সেটা আগে বুঝলে হয়ত এই ট্যুরে আমরা যেতামই না। যা হোক পড়ুন সেই দুঃসাহসিক এডভেঞ্চারের গল্পঃ

……এখন পর্যন্ত আমি ১ লাখ কিমি এবং শাওন ১.৫ লাখ কিমি বাইক চালিয়েছি, আমাদের সবার বাড়ি রাজবাড়ি জেলাতে। পাহাড়ি রাস্তায় বাইক ড্রাইভ করার বলতে গেলে বিরিশিরি ছাড়া বড় কোন অভিজ্ঞতাই আমাদের ছিলোনা। যে রুলস গুলো আমরা ফলো করেছি তা হলোঃ

১} ১ ঘন্টা পরপর ১০ মিনিট ব্রেক ২} সাম্নের ১ ঘন্টা পথের ধারনা আগেই নেওয়া ৩} ভালো খাবার ও ভালো থাকার যায়গার ব্যাপারে কার্পন্য না করা। ৪} সবার সাথে ভালো ব্যাবহার করা (অপরিচিত রাস্তায় এটা খুবই গুরুত্বপুর্ন) ৫} বাইকে নুন্যতম সমস্যা হলে দ্রুত তা সমাধান করা

ঢাকা টি এস সি

১ম দিনের তথ্যঃ যাত্রা শুরু সকাল ৭ টাঃ

আমরা আমাদের মুল প্লান ঠিক রেখে বান্দরবন চলে আসি। ঢাকা থেকে বান্দরবন যাওয়া বা আসা এখন খুব কঠিন কিছু না, তাই এই ব্যাপারে বিস্তারিত লিখলাম না। তবে ট্যুরারদের একটা বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে তা হলো, কক্সবাজার রোড থেকে বান্দরবন পর্যন্ত রাস্তার মাঝে যেন রাত না হয়ে যায়। এই রাস্তাটুকু সন্ধ্যার পর থেকে খুব ঝুকিপুর্ন থাকে মোটর বাইকারদের জন্য।

বান্দরবন

বান্দরবনে হোটেলে চেক-ইন শেষ করে (সন্ধ্যা ৮টা)আমরা নিলগীরি-রুমা-বগালেক-কেওকাড়াডং রাস্তার আইডিয়া নিতে লোকাল মানুষের সাথে আলাপ করতে থাকি। তাদের দেওয়া রোমহর্ষক তথ্য আমাদের কিছুটা চিন্তিত করে, যেমনঃ

• ফাকা রোডে বেশিক্ষন দারানো যাবেনা। • প্রতিটা টার্নে স্লো করে প্রচুর হর্ন দিতে হবে। • পাহাড়িদের সাথে কথা না বলাই ভালো • নিচের দিকে নামতে বাইকের গতি কন্ট্রোল করা টাফ • রাস্তার পাশে জংগলে ঢোকা যাবেনা • কাঠের ব্রিজে কাঠ পচা থাকে সাবধান • বান্দরবন এর পরে বাইরে কোনভাবেই যেন সন্ধ্যা না হয়। • পাহাড়ে ওঠার সময় স্টার্ট যেন বন্ধ না হয়, ইত্যাদি।

আমরা যখন বান্দরবনের রাস্তায় আরো তথ্য খুজতে ব্যাস্ত তখনি পাশ দিয়ে একটি বাইক দুরন্ত গতিতে বেরিয়ে যায়, পরে বুঝতে পারি তিনি বাংলাদেশের অন্যতম এক্সপার্ট বাইকার রোহিত ভাই, তার সাথে সাথে দেখা হয়, একসাথে চা খেতে খেতে সে আমাদের কে লাইভ ধারোনা দেন যা পেয়ে আমরা আশ্বস্ত হই।

বগালেক থেকে বান্দরবন

রোহিত ভাই সাথে আরো ২জন বাইকার এদিনই বগালেক থেকে বান্দরবন এসেছেন। তাই তার দেওয়া ধারনা আমাদের প্রচুর হেল্প করে। আমরা সেনা ক্যান্টিনে চা শেষ করে বাইকের টুকটাক কাজ করিয়ে হোটেলে ফিরে আসি। এরপর এই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয়ঃ

1. নিলগিরী-র রাস্তা ফুল পিচ ঢালাই করা এবং রুমার রাস্তার থেকে ৮০% ভালো রাস্তা, নিজেদেরকে আরো আত্মবিশ্বাসি ও অভিজ্ঞ করতে আমরা পরদিন সকালে নিলগিরী যাবো, তারপর ওখান থেকে ডিরেক্ট রুমা যাবো এবং রুমাতে আর্মিদের সহযোগিতা নিয়ে আমরা মোটরবাইকে কেওকাড়াডং যাবার ফুল প্লান সেট করবো। ২য় দিনঃ সকাল হতেই আমরা বেরিয়ে পড়ি নিলগিরীর পথে, আমাদের অভিজ্ঞতাসমুহঃ 1. পাহাড়ে উঠতে ১স্ট গিয়ারে আর পি এম ৬/৭ এ ধরে রাখতে হয়েছে 2. রাস্তা ভালো থাকলে নামার সময় স্টার্ট অফ করে ৫ম গিয়ারে ব্যালেন্স করে নেমেছি 3. স্পিড ৪০ এর বেশি ওঠানো রিস্কি 4. একটা বড় পাহাড়ে ওঠার পর বাইক-কে রেস্ট দিয়েছি 5. টার্ন টাইমে রাস্তায় গুড়া পাথর দেখে চালিয়েছি 6. বেইলি ব্রিজে ব্রেক না করলে স্লিপ করতে পারে, তাই ব্রিজে ওঠার আগে স্পিড কমিয়েছি 7. প্রচুর হর্ন দিয়েছি… ইত্যাদি

পিক ৬৯

অবশেষে আমরা চিম্বুক, পিক ৬৯ পারহয়ে একসময় চলে আসি নিলগিরী-র উপরে। আমার বাইক পার্কিং জোন পার করে উঠে আসি নিলগিরী-র সর্বোচ্চ চূড়াতে, কটেজগুলোর পাশে (এখানে বাইক নিয়ে ওঠা নিষেধ)। ১ ঘন্টা আমরা নিলগিরি-তে রেস্ট করি আর প্লান করি রুমাতে যাবার।

নিলগিরি

বাইকের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিলো তার উপর অনেক ধকল গিয়েছে, তবুও আমাদের সন্ধ্যার আগেই রুমা যেতে হবে। নিল্গিরি থেকে আমরা দুপুর ২ টায় রওনা হই রুমার পথে। Y- জংশনের আগে আর্মি ক্যাম্পের পাশে পাহাড়িদের হোটেলে আমরা লাঞ্চ করি। সাঙ্গু নদির রুই মাছ যে এত টেস্টি তা না খেলে হয়ত আমরা ধারোনা পেতাম না। যা হোক, প্রথম দিকে রাস্তা একটু কস্ট হয়েছে আর পরের দিকে নিলগিরির রাস্তায় লাইভ মোটরবাইক ভিডিও গেম খেলেছি।

এবার Y- জংশনে আমরা ব্রেক নিই, ছবি তুলি সাথে সিদ্ধান্ত নিইঃ ১। এখান থেকে রুমা পর্যন্ত আর কোথাও দারাবো না। ২। সন্ধ্যার মদ্ধ্যে রুমাতে যেতে হবে।

বান্দারবান থেকে রুমা

রওনা হই আমরা, কিছুদুর পরেই শুরু হয় সেই ভয়ংকর রাস্তা। তবে একটা বিষয় বুঝতে পারি যে, নিলগিরি তে আমরা শুধু উপরের দিকে উঠেছিলাম, আর রুমার পথে আমরা শুধু নিচের দিকে নামছি। পাহাড়ের বাকে বাকে বেইলি ব্রিজ, কাঠের ব্রিজ। চারপাশে তাকালে মনে হয় দুপাশে উচু গাছপালার সবুজের দেয়াল। এদিকে জনবসতি খুব ই কম আর রাস্তায় জানবাহন নেই বললেই চলে। পাহাড়ের পাদদেশে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে যাচ্ছি তাই দুপুর ৪ টাও মনে হচ্ছে সন্ধ্যা।আর একটা বিষয়, রুমার পথে যেতে যেতে বুঝলাম রুমাতে প্রকিতি তার নিজের ভংগিমায় সেজেছে।

আহ কি অপুরুপ সেই মুহুর্ত। এমন লোকালয়হিন ছমছমে পরিবেশে প্রকিতিকে দেখার জন্য কিছুক্ষন না দাঁড়িয়ে পারলাম না। ১০মিনিট ব্রেক নিয়ে আবার বেরিয়ে পরলাম। পথে এবার আর্মি ক্যাম্প, রুমার গর্ব সাংগু নদি, নদির ব্রিজ রেখে আমরা রুমার পথে এজিয়ে চল্লাম। কিন্তু এবার যে রাস্তা শুরু হলো তা দেখার জন্য আমরা একদম প্রস্তুত ছিলাম না। শুধুমাত্র পাথর আর গরমে পাউডারের মত পিচ্ছিল মাটির রাস্তা, সাথে ৪০০-৫০০ ফিট গভির হয়ে পাহাড়ে ওঠা এবং নামা। এই রাস্তাগুলো ৪০-৫০ ডিগ্রি এঙ্গেলে।

রুমার পথে

আমাদের সহযাত্রিদের নামিয়ে দিলাম, তারা হেটে পার হবে, আর আমরা দুইজন বাইক নিয়ে অপেক্ষা করলাম, রাস্তা বিস্লেশন করলাম। একটু দুরত্ব রেখে দুইজন এই রাস্তা টা পার হয়ে এলাম। বাইকের জন্য খুব কস্ট হচ্ছিলো, কিন্ত কিছু করার নেই এগিয়ে যাওয়া ছাড়া।

এভাবে পাহাড়ের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শেষ পর্যন্ত আমরা আমাদের স্বপ্নপুরি রুমাতে পউছে যাই। এখানে একটা বিষয় না বললেই না, তা হলোঃ রুমা একটি উপজেলা। যাবার পথে আমাদের একজন সহ মোটরবাইক যাত্রি মেলে যিনি ওই এলাকার ইউ এন রিলিফের দাইত্বে রুমা উপজেলাতে গত ৮ বছর দাইত্ব পালন করছেন। এই লোকটি না থাকলে আমাদের যে কি হতো তা ভাবতে চাইনা।

Also Read: দ্বি-চক্র যানে চড়ে স্বর্গ মোরা এলাম ঘুরে (শেষ পর্ব)

যা হোক, রুমা উপজেলার প্রধান জায়গা হচ্ছে রুমা বাজার, ইউ এন এর সেই ভাই আমাদের রুমা বাজার পর্যন্ত এনে একটি সুন্দর হোটেলের ব্যাবস্থা করেন। আমরা আমাদের মালামাল হোটেলে রেখে বাইক নিয়ে বেরিয়ে যাই গ্যারেজে কিছু জরুরি কাজ করাবার জন্যে, কারন পরের দিন সকালে আমাদের কেওকাড়াডং যেতে হবে। গ্যারাযে বাইক রিপেয়ার করে আমরা সেখানে আসা অন্যান্য বাইকারদের কাছ থেকে কেওকাড়াডং এর রাস্তার ধারোনা নিই।

রুমা সদর থানা

গ্যারাজ়ে আমাদের একটা মিটিং ও হয়। মিটিঙ্গের আয়জন করেন ইউ এন এর ওই ভাই। বিষয় আমাদের কিভাবে বাইক সহ কেওকাড়াডং নিয়ে যাওয়া যায়। ওই মিটিং এ আমরা ছাড়াও ছিলেন, আমাদের হোটেল মালিক- যিনি ওই সময় রুমা আওয়ামিলিগের সভাপতি ছিলেন, বাইকের গ্যারেজের মালিক, কেওকাড়াডং রেনজ়ের ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, এবং কেওকাড়াডং এ উঠেছে এমন কয়েকজন বাইকার।

একটা বিষয় বলা প্রয়োজনঃ

বিভিন্ন সময়ে বাইক ট্যুরে বেরিয়ে আমরা সবসময় অবস্থার প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যা আমাদের বিশেষ অভিজ্ঞতা প্রদান করেছে। আর সবসময় ভাগ্য আমাদের সহায় হয়েছে। এই ট্যুরের সময়েও তার ব্যাতিক্রম ঘটেনি। রুমাতে মিটিং এর পর আমরা কিছু সিদ্ধান্ত নিই, তা হলোঃ

১। জীবন আগে, শখ মেটানো পরে- যে পর্যায়ে এই সিচুয়েশন হবে সখানে আমরা বাইক বাদ দিয়ে পায়ে হাটা শুরু করবো। ২। বাযে রাস্তার সাথে যেখানে ঢাল ৬০ ডিগ্রি বা তার চেয়ে বেশী খাড়া, সেখানে আমরা ১ জন ড্রাইভ করব আর বাকি ৩ জন নামার সময় পেছনে আর উঠার সময় সামনে বাইকের সামনে বা পেছনে মোটা দরি বেধে ব্যালেন্স করব, এভাবে আর এক জন ও উঠবো বা নামবো। ৩। বাইক রাস্তায় খারাপ হলে গ্যারাজ থেকে টুল বক্স সহ একজন আমাদের হেল্প করতে এগিয়ে যাবে। তার ফোন নাম্বার নেওয়া হলো। ৪। ৬০ ডিগ্রির মতো এক-ই ধরনের ঢালে কিভাবে উঠতে বা নামতে হবে তা আমাদেরকে ট্রিনিং দেওয়া হবে পরের দিন সকাল ৬ টায়। ৫। পথে বড় প্রব্লেম হলে জরুরি নাম্বার রাখা ৬। শুকনা খাবার ও পানি ভর্তি একটা ব্যাগ নেওয়া ৭। ওই রাস্তায় আজন্তুক বাইকার রা গেলেই দুর্ঘটনা হয়, এজন্যে আর্মিরা বাইক সহ যেতে দেয় না। আমাদের প্লান লিখে আর্মিদের সাথে কথা বলে তাদের রাজ়ি করানো.

মিটিং অনুযায়ি কাজ শেষে আমরা হোটেলে আসি, এবং হোটেলের অদ্ভত ছাদে রিফ্রেশ হয়ে যারযার রুমে এসে পরের দিনের ভাবনা ভাবতে ভাবতে ঘু্মিয়ে পড়ি।

দেখুন ২য় পর্বের কাহিনী