ঢাকা থেকে বান্দরবান, আলি কদম, ডিমপাহাড়, কক্সবাজার, টেকনাফ
This page was last updated on 18-Jul-2024 03:00am , By Ashik Mahmud Bangla
ভাবছিলাম একটা গল্প লিখবো । তবে গল্পটা লিখব এটা ভাবতে ভাবতেই অনেকটা সময় চলে গেল । কারন গল্প লেখার জন্য যেসব শব্দ উপমার প্রয়োজন হয় সেগুলোর কিছুই জানি না । তবে পুরোপুরি গল্প লেখা না হলেও একটা রাইডিং স্টোরি লিখতেই পারি । তবে গল্প না হয়ে এটা প্রবন্ধ বা রচনা হয়ে যেতে পারে । পুরো লেখাটি পড়ার অনুরোধ রইলো । সুচনার কথা গুলো অনেকের বাইকারদের কাজে লাগবে আশা করি।
ঢাকা থেকে বান্দরবান, আলি কদম, ডিমপাহাড়, কক্সবাজার, টেকনাফ ঘুরতে যাওয়ার গল্প
২০১৮ তে গিয়েছিলাম টেকনাফ এবং ২০১৯ এ তেতুঁলিয়া । দুটোই দারুন ট্যুর ছিল । বাইক দিয়ে দেশের দুই প্রান্ত ভ্রমন করা অনেকের কাছে বড় কিছু না হলেও আমার কাছে অনেক কিছু । যেহেতু ২ বছর পর একটি ট্যুরের গল্প লিখছি তাই কিছু বিষয় মনের অজান্তে বাদ পড়ে যেতে পারে । এই ট্যুরের মধ্যে এডভেঞ্চার , মজা ,আনন্দ ,বিপদ,গান বাজনা সবই ছিল। একেবারে মারদাংগা ট্যুর যাকে বলে । ঢাকা থেকে বাইক নিয়ে বান্দরবান -থানচি -আলীকদম ডিম পাহাড় হয়ে কক্সবাজার তারপর টেকনাফ । মোট ৩ রাত ৪ দিনের ট্যুর । ১০টি বাইক / ১৫ জন । এই ট্যুরে আগে থেকে কাওকেই চিনতাম না । ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমেই পরিচয় । মনের ভেতর প্রবল ইচ্ছে ছিল অচেনা কারো সাথে কোথাও গেলে কেমন লাগে সেটা জানার এবং বোঝার । আমাকে ফেসবুকে Mijanoor Rahman Ripon নামে পাবেন। আগে একদিনে ৪০০ কিমি রাইড করার অভিজ্ঞতা ছিল । কাছে দুরের বেশ কয়েকটি জেলায় বাইক নিয়ে ঘুরে এসেছিলাম ।
আসলে থানছি আলিকদম বাইক ট্যুর দেয়ার আগে ট্যুর দেয়ার অভিজ্ঞতা থাকা অত্যন্ত জরুরী। এই ট্যুরে মোট ১২০০ কিমির মতো রাইড করতে হবে । পথের হিসাবে কম বেশী হতে পারে । অভিজ্ঞতা দিয়ে দক্ষতা বিচার করা কঠিন । শেষ বছর গুলোতে দেশের অভিজ্ঞ কয়েকজন বাইকার এক্সিডেন্টে মারা গেছে । নিজের দোষে হোক অন্যের দোষে হোক ভাল বাইকার এভাবে মারা গেলে দু:খ লাগে । আমার মতে দু ধরনের বাইক রাইডার রয়েছে । এক : ডিফেন্সিভ দুই : এগ্রেসিভ । রাইডার হিসাবে আমি ডিফেন্সিভ হয়ে চালাতে পছন্দ করি । আগে ডিফেন্স সামলাও তারপর আক্রমন । ডিফেন্সিভ বলতে বোঝাচ্ছি, ব্রেক একটু আগেই ধরি । হাই স্পিড তোলার সময় রাস্তা খালি আছে কিনা দেখে নিই এইসব আর কি । সাধারন কথা গুলোই মেনে চলার চেস্টা করি আর কি । নিজেকে স্লো রাইডার মনে করি আর টেক্সাসের জিপসী বাইকার ভাবতেই দারুন লাগে । এগ্রেসিভ বাইকাররা সাই সাই করে চালায়, চিপা পেলে সুত করে বের হয়ে যায়, সেকেন্ডের মধ্যে ১০০ কিমি তুলে । এ গু্লো ব্যাপার অনেক কস্টে দূরে সরিয়ে রাখি।
আমাকে অমুকের আগে যেতে হবে কিংবা তমুককে আমার আগে যেতে দেবো না এই ধরনের ব্যপার মন থেকে দূরে সরিয়ে রাখি। প্রথম প্রথম এই গুলো মেনে চলতে কস্ট হত তবে ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে গেছে। এখন ধীরে রাইড করতেও অনেক আনন্দ পাই । তবে গতি আমিও পছন্দ করি । কখন কোন পরিবেশে চালাবো সেটা তার উপর নির্ভর করে । এই ট্যুরেও কুমিল্লার পরে গিয়ে ১০০ /১১০ তুলেছিলাম হাইওয়ে খালি ছিল বলে । জিপসী বাইকারদের কথা বলছিলাম । টেক্সাসে বড় বড় উচু হ্যান্ডেল ওয়ালা বাইক গুলো দিয়ে ওরা ঘন্টার পর ঘন্টা রাইড করে । মাইলের পর মাইল চোখ ধাঁধানো পথে রাজার মত বাইক চালায় । পুরো রাস্তাটাই তাদের ঘর বাড়ী । অসাধারন লাগে । বাংলাদেশের হাইওয়ে রোডের কন্ডিশন বিচারে গতি ১০০ কিমি কম না বরং ভালই স্পিড । এখন তো অনেক বাইকারই ১২০ / ১৪০ এ বাইক চালায় ওই রোডে । আমি ১৪০ কিমিতে চালানোর মত দক্ষ নই । তবে এক্সপ্রেসওয়ে হলে চেস্টা করে দেখবো ।
আসলে আমরা কোন বাইকারকেই হারাতে চাই না । সেদিন নিউজে দেখলাম দাঁউদকান্দি রোডে একজন ভাল মানের বাইকার মারা গেছে । তার গতি ছিল ৯০ কিমি । এত পথ থাকতে ওই রোডে কেন এত গতিতে বাইক চালাতে গেল বুঝতে পারি নি। একটি ভ্যানের সাথে ধাক্কা খেয়েছিল। ওই রোড ৯০ কিমিতে চালানোর মত রোড নয় । কেন নয় একটু পরেই বলছি । আমার সামান্য অভিজ্ঞতার কোন একটি হয়তো আপনার জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে । বাইকারদের নানান বিষয় নিয়ে 'হিরো হানক রোড রকার্স' নামে একটা প্রোগ্রাম করেছিলাম কিছুদিন আগে । দেশের ভাল মানের বাইকার , পুলিশ , নারী বাইকার সহ অন্যান্য রাইডার নিয়ে স্টুডিও প্রোগ্রাম । রেডিওতে প্রথম বাইকারদের নিয়ে প্রোগ্রাম ছিল । তবে এখন বাইক নিয়ে সচেতনতা প্রতিনিয়ত বাড়ছে । বাইক যে বিপদজনক বাহন নয় সেটাই বলার চেষ্টা করেছি ।
হাইওয়েতে বাইক রাইড করার সময় কিছু নিয়ম আর মনকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য কিছু কথা মেনে চলি । প্রয়োজনে আপনিও এই নিয়মগুলো মেনে চলতে পারেন এবং নিজেকে বোঝাতে পারেন । রাইডের সময় ৯০/১০০ কিমি গতিতে চলা অন্য গাড়ি বা বাসকে ওভারটেক না করা। ওই গাড়ির পাশাপাশি রাইড না করা। কোন গাড়ি বা বাসের পাশাপাশি রাইড না করা। হয় তাকে আগে যেতে দিন না হয় আপনি তাকে ওভারটেক করুন। সামনের কোন গাড়ী বা গ্রুপের মোটর সাইকেলকে ফলো করে না চালানোই উত্তম। নিজের গতিতে বাইক রাইড করুন। আপনাকে কেউ ওভারটেক করতে চাইলে তাকে স্বসম্মানে যেতে দিন। রাস্তার ডানেও না আবার একেবারে বামেও না এমন এক পজিসনে রাইড করুন যাতে পিছন থেকে কেও ওভারটেক করতে চাইলে ডানপাশ দিয়ে ওভারটেক করতে পারে । আবার বামপাশ থেকে কেও উল্টো পথে আসলে নিরাপদে চলে যেতে পারে । আপনিও নিরাপদে যেতে পারেন । ডান হাতে প্রেসার কম দিন ।
প্রত্যেক বাইকেরই স্পিড বাড়া ও কমার ক্ষেত্রে নিজস্ব চরিত্র রয়েছে । জোর করে প্রেসার দিয়ে গতি না বাড়ানোই ভাল । তাহলে লং রাইডের ক্ষেত্রে ডান হাত বিশ্রাম পাবে । আপনি অনেকক্ষন রাইড করতে পারবেন । ধীরে ধীরে গতি বাড়ান ধীরে ধীরে গতি কমান। বাইকের গতি কখনো আপ ডাউন না করা । কখন কোথায় বাইকের গতি বাড়াবেন কোথায় কমাবেন পরিবেশ বুঝে ঠিক করে নিন । ৫০ অথবা ৬০ কিমি পর পর একবার বিরতি দিন। বিরতির সময় পারলে একটি করে কলা খেতে পারেন। কলাতে অনেক বেশী আয়রন থাকে। যা শরীরের স্টেমিনা অনেকগুন বাড়িয়ে দেয় । আর প্রচুর পানি পান করুন । এতে ব্রেন রিফ্রেস থাকবে সব সময়। সাথে স্যালাইন রাখতে পারেন। বাইক রাইডের সময় মেরুদন্ড সোঝা রেখে চালান । এতে শরীরের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। রাস্তায় চোখ রাখার পাশাপাশি রাস্তায় থাকা মানুষ গুলোর দিকেও খেয়াল রাখুন ।
যে কোন পরিস্তিতিতে শান্ত থাকুন। হাইওয়ে পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার জন্য নিজেকে একটু সময় দিন । হাইওয়েতে নেমেই উচ্চ গতিতে বাইক চালনো উচিত নয় । লং ট্যুরকে কখনো রেসিং ট্যুর মনে করবেন না। দ্রুত গতিতে বাইক রাইড করতে পারা মানেই দক্ষ রাইডার এই কথা মনে করার কোন কারন নেই। দ্রুত গতির রাইডার দেখলেই আফসোস করবেন না। দ্রুত গতিতে বাইক রাইড করতে পারা দক্ষতার একটা অংশ মাত্র। ফুলহাতা জামা পড়ুন। যদি হাফ হাতা পড়েন তাহলে দু হাত ঢেকে রাখার স্লিপার পরতে পারেন। ধুলো বালি থেকে বাচার জন্য মুখ, গলা ঢেকে রাখুন। ব্যাক প্যাক কাধে ঝুলিয়ে রাইড করবেন না। ব্যাগ বাইকের সাথে বেধে নিন। তবে সাইল্যান্সার যেদিকে আছে সেদিকে না বেধে তার অপর পাশে বাধুন। ১ম দিন ঢাকা টু বান্দরবান । ২য় দিন বান্দরবান টু থানছি- আলিকদম- ডিম পাহাড় হয়ে সোজা কক্স বাজার । ৩য় দিন কক্স বাজার টু টেকনাফ। ৪র্থ দিন কক্স বাজার টু ঢাকা । একদম টাইট সিডিউল । বান্দরবান কক্স বাজার আগেই গিয়েছিলাম তবে বাইকে নয় । বাসে নয়তো গাড়ীতে । তাই ও-ই সব রোড সম্পর্কে আগেই একটা আইডিয়া ছিলো । আঁকা বাঁকা, উঁচু নিচু । মোটামুটি একটা পরিচিত রোড কল্পনায় ভাসছিল ।
কিভাবে চালাবো মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম । আর ডিম পাহাড় কদমতলি রোড সম্পর্কে কোন আইডিয়াই ছিল না । একদম অচেনা একটা পথ । কারন আগে যারা গিয়েছিল তারা বিপদ জনক থ্রিলিং রাইডের অভিজ্ঞতার কথাই বলেছিল । সব কিছু ছাপিয়ে যুদ্ধ জয়ের মতই ব্যাপার । বিশেষ করে প্রথম যারা যাবে। তাদের থ্রিল আনন্দ সবই মনে থাকবে অনেকদিন । থানছি থেকে আলিকদম ডিমপাহাড় ওটাই বাংলাদেশের হাইয়েস্ট মটোরেবল পথ । পাহাড়ী আঁকা বাঁকা পথে চালানো আর ডিম পাহাড়ের মত পথে চালানো একটু ভিন্ন ব্যাপার ওখানে গিয়ে বুঝেছিলাম । যেমন থ্রিলিং একটা ব্যপার কাজ করে তেমনি বিপদজনক তেমনি আনন্দ আর মজা । ফোর ইন ওয়ান বলতে পারেন । সত্যিকারের আনন্দ দায়ক হবে যদি নিরাপদে ঘুরে আসা যায় । কারো যদি আগে লং ট্যুর দেয়ার অভিজ্ঞতা না থাকে তাহলে ওই পথে প্রথমেই ট্যুর দেয়া বোকামি হবে । ডিমপাহাড়ের উচ্চতা ২৫০০ ফিট। একদম খাড়া পথ, আঁকা বাকা উচু নিচু সব ধরনের বিপদজনক বাকে ভরা।
রাস্তার একদিকে অতল গহবর অন্যদিকে খাড়া পাহাড় । মেঘের রাজ্যে ভয়ংকর সুন্দর আর পদে পদে বিপদের হাতছানি। চোখের সামনে ২০ তলা বিল্ডিং যেমন দেখা যায় । যত সামনে যাওয়া হয় ডিমপাহাড়কে এমনই মনে হয় । ওখানে বাইক চালানোর সময় মনে হচ্ছিল মই বেয়ে উঠছি । ব্লাইন্ড কর্নারিং সহ নানান ধরনের বাক তো আছেই । কিছু কিছু জায়গায় উপরে উঠার সময় উপরে উঠতেই হবে, থেমে গেলে বা ব্রেক ধরলেও বাইক নিচে পিছলে পরে যাবে আর নিচে নামার সময়ও থামাথামি চলবে না । কিছু বাক আছে ভয়ংকর । এত উপরে মাধ্যাকর্ষণ শক্তিও কম থাকে । বাইক এবং নিজের ওজন কমে যায় । আবার কিছু জায়গায় দাঁড়ালে মনে হবে কেও নিচের দিকে টেনে ধরছে । তবে যত কথাই বলি আপনি একবার ডিম পাহাড়ের উপরে উঠে গেলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবেন। গ্যারান্টি দিলাম। পাহাড়ের উপর থেকে যখন নিচে দেখা যায় তখন চোখ জুড়িয়ে যায়। মেঘ গুলো পায়ের কাছ দিয়ে উড়ে যায় । সাদা মেঘের রাজ্য যেন একটা ।
তখন মনে হবে পৃথীবিতে বেচে থাকা অনেক আনন্দের অনেক সুখের। বেঁচে আছি এই রকমই সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখার জন্য । নিজেকে মেঘের দেশের মানুষ মনে হয়েছিল । সৃস্টি কর্তার বিস্ময়কর সৃস্টিকে জড়িয়ে ধরতে চাইছিলাম। আর মনের অজান্তেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছিলাম। আপনিও তাই চাইবেন । যাই হোক ভয়ের কারন নেই। একটু বুঝে শুনে চালালে নিরাপদেই ঘুরে আসা যায় এই অনাবিল সুন্দরের লীলাভুমি। নতুন রাইডারদের কাজে লাগবে বিধায় এত কথা বললাম। আর কক্সবাজার টেকনাফ হলো ছবির মত সুন্দর । এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সকাল ৬ঃ০০ টায় ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে ড্রেসআপ করে ফেললাম। হ্যান্ড গার্ড, পায়ের গার্ড ফুল ফেস হেলমেট সহ সব ধরনের সেফটি শরীরে । লং ট্যুরের জন্য যা অতীব জরুরী । স্টিল বার্ড হেলমেট । আন্তর্জাতিক অনুমোদিত হেলমেট । তবে আলিকদম রোডে পাহাড়ী কিছু বাইকারদের সেফটি ছাড়া বাইক চালানো দেখে মনে হয়েছিল এইসব সেফটি না হলেও চলে ।
পাহাড়ী লোক গুলো এইসব সেফটি ছাড়াই রাইড করে । আজব ব্যাপার । আমরা তো ওই পথে হেলমেট ছাড়া রাইড করার কথা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। আগেরদিন বিজয় সরনীর ট্রাস্ট ফিলিং থেকে ১০০০ টাকার অকটেন ভরে নিয়েছিলাম । আসা যাওয়া ২৫০০ টাকার তেল হিসাব করেছিলাম । টিএসসিতে মিলিত হবে সবাই । টি এস সি মোড় সবার জন্যই সুবিধা মিট করার জন্য । ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রান কেন্দ্র । এখান থেকে ঢাকা মেডিক্যালের পাশ দিয়ে গুলিস্তান যাত্রাবাড়ী ফ্লাই ওভারের উপর দিয়ে ঢাকা থেকে বের হবো । ৭টায় রওয়ানা হবো । বাংগালী সময় হিসাবে একটু এদিক ওদিক হয়। তবু সময় মত গিয়েছিলাম । বাসা থেকে বের হওয়ার আগে বাইকটা আরেকবার চেক করে করে নিলাম ব্রেকিং সিস্টেম, চাকা সহ আরো কিছু জিনিস । না কোন সমস্যা ছিল না। তবে একটি জিনিশ নিতে ভুলে গিয়ে গিয়েছিলাম।
টায়ার রিপেয়ার ফোম বা জেল। পাহাড়ী পথে এটা সাথে রাখা নিরাপদ । রওয়ানা দিলাম আল্লাহর নামে । শীতল আবহাওয়ার ঢাকা । সকাল ৮ টার পরেই এই শহরে জীবন যুদ্ধ শুরু হয়। চলে একদম গভীর রাত পর্যন্ত । কোন অবসর নেই । বিরামহীন চলছে জীবন। এই শত ব্যস্ততার শহর থেকে বের হয়ে সবাই মাঝে মাঝে মুক্তির স্বাদ নিতে চায় । মুক্ত নাইটিংগেল পাখির মত হারিয়ে যেতে যায়। আমিও তাই চাইছিলাম। সকালে শীত থাকে তবে আস্তে আস্তে দিন বাড়ার সাথে সাথেই গরম । তারপর আবার বিকেলের দিকে গরম কমতে থাকে এবং রাতে ঠান্ডা থাকে । শীত তখনো পুরোপুরি আসেনি। তবে বান্দরবানে রাতে এবং সকালে ভাল শীত লেগেছিল। কুয়াশা আর মেঘের অন্য এক রাজ্য । রাইড করার জন্য একদম দারুন আবহাওয়া বলবো না তবে ভাল। দুপুরটা বাদ দিলে সারাদিন রাইড করতে অসাধারন লাগে । বাইক তিন দিন আগে সার্ভিসিং করিয়ে নিয়েছিলাম । বাইকের পারফরমেন্স জানতে দুটো দিন ভাল সময় । হিরো হানক। এর আগে পালসার, এফ জেড,ফ্রেজারে ট্যুর দিয়েছিলাম । অভিজ্ঞতা ভালই ছিল । কোন সমস্যা হয় নি। কিন্তু হানক নিয়ে প্রথম । ২০১৮ ব্লাক এডিশন । বাইক একদম ছুটে চলার জন্য তৈরি ছিল ।
১৫০ সিসির এই বাইক শুনেছিলাম লং ট্যুরের জন্য সত্যি ভাল । চার দিনের বেশী জামা কাপড় নেয়া হয়নি । যত হাল্কা থাকা যায় তত ভাল। তিনটি করে টি সার্ট, প্যান্ট আর জ্যাকেট নিয়েছিলাম । মাত্র একটি ব্যাক প্যাক । তবে একজন পিলিওন নিতে চেয়েছিলাম । তবে পরে নেয়া হয়নি। অবশ্য এই রকম লং ট্যুরে সিংগেল রাইড করাই সবচেয়ে উত্তম । সকাল পৌনে ৭টার দিকে পৌঁছে গেলাম টিএসসির মোড়ে । চার পাচটি বাইক ততক্ষনে হাজির হয়ে গেছে । বাকীরা পথে ছিল । দু একজন আবার শেষ মুহুর্তে ট্যুর বাতিল করেছিল । কাউকে চিনিনা শুধু মডারেডর সোহানকে ছাড়া । ট্যুরের আগেরদিন আমার সেফটি গার্ডগুলো কেনার ব্যাপারে সাহায্য করেছিল । তাও ফোনেই আলাপ হয়েছিল। ট্যুরের যাবতীয় প্লান প্রোগ্রাম ওই করেছিল । অবশ্য অন্য সবারই প্রায় একই অবস্থা। কয়েকজন মাত্র এই ট্যুরের আগে একসাথে ট্যুর করেছিল । সোহান খুব হেল্পফুল মানুষ আমার ব্যাক প্যাক ভাল করে বাইকে বেধে দিল নিজেই । সবার অনুরোধে আমার গিটারটা নিয়ে নিয়েছিলাম । অন্য একটি বাইকের পিলিওনকে দিলাম নেয়ার জন্য । কাধে গিটার নিয়ে বাইক রাইড করা একটু মুসকিল ।
অন্যান্য রাইডারদের নাম এখন বললাম না । পরে পরিচয় করিয়ে দেব । কিছুক্ষনের মধ্যেই এক এক করে সবাই হাজির হয়ে গেলো । হাঙ্ক, হর্নেট, অ্যাপাচি, রানার বুলেট, টারবো, কিওয়ে, লিভো, সুজুকি । সারি করে দাঁড়ানো বাইক গুলোকে দেখতে দারুন লাগছিল । কয়েকজনের পাহাড়ে রাইডের অভিজ্ঞতা ছিল । রওয়ানা দেয়ার আগে ছোটখাটো একটা মিটিং করে নিলাম । সিরিয়াল, গতি কত হবে এইসব । ঠিক করলাম ৮০ কিমির বেশী গতিতে চালাবো না । পরে অবশ্য কুমিল্লার পর রোড খালি পেয়ে ১০০ তেই চালানো হয়েছিল । আমি একটু স্লো রাইড করি । কারন গন্তব্যে যাওয়ার পথটুকু একটু উপভোগ করতে করতে না গেলে ভাল লাগে না । হাইওয়ে রোডের পাশের টং দোকানের মালাই চা খেতে খেতে আকাশ না দেখলে ভাল লাগে না । ওইখানকার মানুষগুলোর ব্যস্ততা একটু ভিন্ন অভিজ্ঞতা দেয় । যেখানে বসে চা খেয়েছি সেখানে হয়তো আর নাও যেতে পারি । ওই গ্রাম্য জায়গায় কিছু সময় আড্ডা দিতেও খারাপ লাগে না ।
তাই ছোট ছোট কিছু স্মৃতি থেকে যায় মনে । আপনাদের কেমন লাগে জানাবেন। সবার সাথে পরিচয় হয়ে নিলাম । আমরা ৭ঃ১৫ দিকে রাইড শুরু করলাম । যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার পার হয়ে উঠে গেলাম হাইওয়েতে । মানষিক ভাবে প্রস্তুত মন, স্নায়ু গুলো টান টান হয়ে গেল, শরীরের পেশী সারাদিন রাইড করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে কেবল । রাস্তার সাথে মানিয়ে নিতে কিছুক্ষন সময় লাগবে । আমি মাঝে । সামনে পিছনে বাইকের সারি । লাল, কালো নীল নানা ধরনের বাইক। গ্রুপের বাইক চেনার জন্য প্রত্যেক বাইকারের হেলমেটে এক ধরনের স্টিকার লাগানো আছে । যাতে রাস্তার কোথাও দাঁড়ালে সহজে চেনা যায় । রাতেও এই স্টিকারে আলো পড়লে চক চক করে । রেডিয়াম স্টিকার ।
ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক বাইক রাইডের জন্য সপ্নের সড়ক । বাংলাদেশে যে কয়টা প্রসস্থ মহাসড়ক রয়েছে তার ভেতর এই মহাসড়কটি অন্যতম । একটানে একদম চট্টগ্রাম চলে যাওয়া যায় । বাংলাদেশের দেশী বিদেশী ব্যবসা বানিজ্যের প্রধান সড়ক । দিনের চেয়ে রাতে ভারী যানবাহন চলে বেশী । তবে যারা নতুন যাবেন তাদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলতে চাই । যে কোন শহরে প্রবেশ এবং বের হবার রাস্তায় অনেক যানবাহনের ভীড় থাকে। এখানে শুধু বাস, ট্রাক, কার, রাস্তায় থাকা মানুষগুলোর কথাই বলবো না এখানে মানুষের মন মানষিকতাও জড়িত। ঢাকা থেকে যে বাস বা গাড়িগুলো বের হয় সে গুলোর ড্রাইভারদের রাস্তার সাথে মানষিক ভাবে মানিয়ে নেয়ার জন্য আধা ঘন্টা থেকে এক ঘন্টা সময় লাগে । কিন্তু তারা এই সময়টা নেয় না । যাত্রাবাড়ী ফ্লাই ওভার পেরিয়ে সবাই দ্রুত ঢাকা থেকে বের হতে চায় আবার ঢাকার বাইরে থেকে আসা গাড়ীগুলো দ্রুত শহরে ঢুকতে চায় । এ সময় রাস্তায় থাকা বাইকগুলোকে পাত্তা দিতে চায় না।
তাই আপনি যত বড় দক্ষ বাইকারই হোন না কেন, কোন শহরে প্রবেশ এবং বের হওয়ার সময় গতি নিয়ন্ত্রন করে চলা উচিত অবশ্যই । সব বাইকারদের ক্ষেত্রে এটা অবশ্যই পালন করা উচিত। আমাদের গতি ৫০/৬০ কিমি ছিল । ঢাকা থেকে দাঁউদকান্দি ৫৫ কিলো । প্রাইভেট গাড়ী, বাস, টেম্পু, রিক্সা, মানুষে ঠাসা একটা পথ । একেক যানবাহনের গতি একেক রকম । রাস্তায় উল্টোদিক থেকে রিকশা টেম্পু ভ্যান আসে, মানুষের পারাপার , এলোপাথাড়ি বাস থামানো সবকিছু এই পথে আছে এবং দাঁউদকান্দির পরেই সাধারণত হাইওয়ে আস্তে আস্তে খালি হয় । এরপর দুরপাল্লার বাস বা গাড়ি গুলোই চলে । মানুষ জন কমে যায়। তাই এই রোডে ৯০ কিমি গতি চালানো বোকামী। কাঁচপুর ব্রিজ পার হয়ে গেলাম । কাঁচপুর ব্রিজের পরে বাম দিক দিয়ে চলে গেছে বি.বাড়ীয়ার দিকে । ওইখান দিয়ে সিলেট । আমরা যাবো সোজা। ধীরে ধীরে উত্তেজনা বাড়ছিল । মনে তখন দূরে হারিয়ে যাবার আনন্দ । সবকিছুই ভাল লাগছিল।
দোকান পাট কমে আসছিল । কাঁচপুরের পরেও গতি ৫০/৬০ কিমি পরিবেশ বুঝে । একটি বিরতি নিতে হলো । গ্রুপের সাথে একজন যোগ দিল । এরপর আমাদের রাইডিং চলতে থাকল । ধীরে ধীরে আসে পাশের শহুরে পরিবেশ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছিল । উলটো পথে মাঝে মাঝেই রিকশা, টেম্পু, ভ্যান আসছিল । তাই সাবধানেই রাইড করছিলাম । এই ভাবেই মেঘনা গোমতি সেতু পার হয়ে দাঁউদকান্দি চলে আসলাম। ঢাকা থেকে দাউদকান্দি ৫৫ কিলো। দাউদকান্দি আসার পরেই মনে হলো সত্যি আমরা ঢাকার বাইরে চলে এসেছি । ব্রীজ পার হওয়ার সময় নদীর বিশুদ্ধ বাতাস ফুসফুসে নিতেই শরীর চাংগা হয়ে উঠল । ঢাকার বাতাস আর ঢাকার বাইরের বাতাসে অনেক তফাত। ঢাকার বাতাসে দুষন বেশী । আর এখানে বাতাসে অক্সিজেন বেশী । নিস্বাস নেয়ার সাথে সাথেই রক্তের গতি টের পাওয়া যায়। সকাল ১০ টার কাছা কাছি বাজছিল সম্ভবত । মোল্লা হোটেল । হোটেলের উপরে সাইনবোডে বড় করে লেখা। রাস্তার পাশে সাধারন এক হোটেল।
হোটেলে ঢোকার মুখেই রুটি পরোটা ভাজা হচ্ছে । এখানে আমরা নাস্তা করে নিলাম । সবার বাইকই ভাল চলছে। কোন সমস্যা হয়নি কারো । সবাই ফুরফুরে মেজাজেই ছিল । ধীরে ধীরে একজন আরেক জনের সাথে কথা বলতে ফ্রি হচ্ছে । নাস্তা ৩০/ ৩৫ টাকাতেই হয়ে গেলো । আমি পরোটা আর ডিম খেলাম । ডিম খেলাম দুটো । কেন জানি না লং ট্যুরে বের হলেই সকালের নাস্তায় ডিম বেশী খাওয়া হয় । ডিম ভাজি হতে হবে পেঁয়াজ মরিচসহ একটু হাফ বয়েল্ড। এরপর গরম গরম এক কাপ চা । আসল বাইক রাইড শুরু হলো দাঁউদকান্দির পরেই । সুন্দর হাইওয়ে। দুপাশে সবুজ পাতার গাছে ভরা পথ । ডানে বামে সারি সারি ধান ক্ষেত । গ্রামের বাড়ী ঘর । মাঝে মাঝে খাল বিল । টিনের ঘর দোকান পাট, হাট বাজার পেরিয়ে আমরা ছূটছিলাম গন্তব্যের দিকে । উপরে দিগন্ত জুড়ে আকাশ । গোমরা মুখের আকাশ নয় একেবারে নীল সাদা মেঘের আকাশ । সাদা মেঘ গুলো মনে হচ্ছিল আমাদের সাথে চলছে । পুরো ট্যুরেই এরা আমাদের সাথে থাকবে যদি আবহাওয়া ঠিক থাকে।
এটাই আসল বাংলাদেশ । কিষান কিষানীর দেশ বাংলাদেশ । মাটির দেশ আমাদের দেশ বাংলাদেশ। দাঁউদকান্দির পরেই গৌরিপুর তারপর চাঁন্দিনা তারপর কুমিল্লা ক্যান্টনম্যান্ট । শো শো বাতাস কেটে এগিয়ে যাচ্ছিলাম । ঝড় হলে যেমন বাতাস বয়ে তেমন। তবু কেমন যেন একটা নিরবতা অনুভব করছিলাম । কোন এক্সট্রা শব্দ নেই এই বাইকের । ধীরে ধীরে গতি বাড়াচ্ছিলাম আবার কমাচ্ছিলাম। । ডান হাতে থ্রটলে প্রেসার দিচ্ছি না কারন ৪/৫ ঘন্টা পর ডান হাত ব্যথা করা শুরু করবে । গৌরিপুরের আগেই ৪ লেনের হাইওয়ে দু ভাগ হয়ে গেল । চট্টগ্রাম থেকে আসার পথ আরেক পাশে আর যাওয়ার পথ এক পাশে । মাঝে ধান ক্ষেত, খাল বিল, সারি সারি গাছ পালা । গ্রামের মানুষের হাটা চলা । দোকান পাট। হাট বাজার আরো কত কি। গৌরিপুর পার হয়ে ছুটছি চাঁন্দিনার দিকে । আবার কিছু পরে রাস্তা এক সাথে হলো । এই এলাকা গুলোতে আগেই আসা হয়েছিল । গ্রামের মাঝ দিয়ে যাওয়া ছোট ছোট পাকা রোড গুলোতে রাইড করতে দারুন লাগে।
এলাকাটা একটু পরিচয় করিয়ে দেই আপনাদের সাথে। গৌরিপুরের বামদিক দিয়ে চলে গেছে হোমনার দিকে । সম্ভবত গৌরিপুর থেকে হোমনা ৩৫ কিমি হবে। হোমনা পেরিয়ে ৩০ কিমি পর বাঞ্চরামপুর। একদম রুরাল এরিয়া বলতে যা বোঝায় বাঞ্চহারামপুর তাই। বাঞ্চারামপুরে গরুর মাংসটা দারুন রান্না করে । ছোট ছোট টিনের চালা দেয়া হোটেল । একটু গ্রাম্য এবং লাকড়ি দিয়ে রান্না । স্বাদটা তুলনাহীন। যদি আমার মত ভোজক রসিক হোন তাহলে ওই দিকে গেলে গরুর মাংস দিয়ে এক থালা ভাত খেয়ে আসবেন । জীবনে এর স্বাদ ভুলবেন না । হাইওয়েতে গাড়ী ছিল ভালই । চলার পথে রাস্তার দু পাশে ধানক্ষেত মাঝে মাঝে গাছের সারি পিছনে ফেলে বাইক তখন চলছিল ৭০/৮০ কিমিতে ।
বাংলাদেশ সবুজ মাঠের দেশ সবুজের শেষ নেই। বাতাসের ঝাটকা গায়ে লাগছিল আর শো শো আওয়াজ। দাঁউদকান্দির পর থেকেই হেলমেট পড়া বাইকার কমে গিয়েছিল অনেক । একবার দেখলাম এক কিশোর হেলমেট ছাড়া প্লাটিনা বাইক ডানে বামে করে নেঁচে নেঁচে চালাচ্ছে । দেখে আমার কেন জানি সিরিয়াস কিছু মনে হয়নি বরং হাসি আর মজা লাগছিল । অন্য সময় হলে গাল বরাবর একটা চটকানা দেয়ার ইচ্ছে জাগত সিউর। কালো চেহারার ছেলেটি তার সাদা দাত বের করে আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল মনে হলো । আমি আমার হেলমেটটা ইশারা করে দেখালাম। আমার হেলমেট আছে তোমার নাই ব্যাপারটা এরকম বোঝাতে চাইলাম । বুঝলো কিনা কে জানে। মাঝে মাঝেই হেলমেট বিহীন বাইক দেখতে পাচ্ছিলাম । ঢাকা চট্টগ্রাম ছাড়া বাইক চালকরা সেফটি নিয়ে এত ভাবে না। । তাও শহরে আইন কড়াকড়ি বলেই হেলমেট পড়ে। ময়মনসিং, বগুরা, রংপুর, পাবনা, মাদারিপুর আরো অনেক জেলায় স্থানীয় বাইক চালকদের তেমন হেলমেট পড়তে দেখিনি ।
সারাদেশ হিসেব করলে আমার মনে হয় ২০% বাইকার তার নিরাপত্তা নিয়ে সচেতন আর বাকি ৮০% সচেতন নয়। এই ৮০% এর অধের্ক জানে বাইক চালানোর সময় হেলমেট পড়তে হবে কিন্তু পড়ে না। আর বাকিরা এই ব্যাপারে কিছুই জানে না । ব্যাপারটা এরকম বাইক কিনেছি চালাবো ব্যাস আর কি চাই। এদের মধ্যে অনেক তরুন হেলমেট ছাড়া বাইক চালানোকে এক ধরনের বীরত্ব মনে করে । আপনার কাছে এ বিষয়ে কোন পরিসংখান থাকলে জানাবেন । আর উল্টো দিক দিয়ে রিক্সা, ভ্যান, টেম্পু চলাচল করা দেখে মনে হয়েছে এটা এখানকার সাধারন ব্যাপার । দেখার কেও নেই । নিজেরটা নিজে যদি কেও না দেখে তাহলে অন্যের এত গরজ কেন হবে । ছোট ছোট কয়েকটা মফস্বল বাস স্ট্যান্ড হাট বাজার পেরিয়ে চলে আসলাম চাঁন্দিনা । চাঁন্দিনাও পেরিয়ে গেলাম । চাঁন্দিনার পরেই কেমন যেন কুমিল্লা ভাব চলে আসছে । কুমিল্লা ঢাকা থেকে ১২০ কিমি। দুরত্ব হিসাবে বেশী বলা যাবে না । ২/৩ ঘন্টার পথ ছিল ট্যুরের সময় । এখন নতুন ব্রীজ হওয়ার পর দেড় ঘন্টায় যাওয়া যায় ।
আবারো রাস্তায় যানবাহনের ভীড় বাড়ছিল । ওই যে শুরুতে বলেছিলাম কোন শহরে প্রবেশ আর বের হওয়ার সময় বেশ যানবাহনের ভীড় থাকে । কিছু বাইক আগে চলে গেছে আমি ছিলাম লেজের দিকে । আমার পিছনে একজন কি দুজন ছিল। কুমিল্লার পরে অবশ্য লেজের দিকেও থাকতে পারি নি । সেই গল্প পরে বলছি। ক্যান্টনম্যান্ট এসে একটি বাইকে সমস্যা হলো । খুব সম্ভবত টায়ারে সমস্যা ছিল । তখন ১১:৩০ টা বাজে । ভাগ্য ভাল ক্যান্টনমেন্ট পার হয়েই রাস্তার বাম কিছু মোটর বাইক সার্ভিসিং এর সপ আছে । শুধু মোটর সাইকেল নয় গাড়ি সার্ভিসিং সপও রয়েছে । আমরা সবাই ওইখানেই বিরতি নিলাম । কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বায়ে চলে গেছে দেবীদ্বার, কসবা হয়ে বি. বাড়িয়া ১০০ কিলো হবে । আর কসবাতেই রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় রেল জংশন আখাউড়া । ঢাকা থেকে সিলেট এবং চট্টগ্রামের দিকে আসা ট্রেন গুলো এসে আখাউড়াতে মিলিত হয়। ওখান থেকেই ট্রেনের লাইন দু দিকে গেছে । একটি লাইন সিলেটের দিকে অন্যটি চট্টগ্রামের দিকে । আখাউড়া গিয়েছিলাম একবার তবে বাইকে নয় । রেল লাইন দিয়ে হাটতে ভাল লেগেছিল । প্রচন্ড বৃস্টির মাঝে স্টেশনে বসেছিলাম অনেক ক্ষন । গুরুম গুরুম মেঘের গর্জন আর বৃস্টির সুমধুর শব্দে একটু পর পর চা খাচ্ছিলাম । সে কথা ভোলার নয় । তবে আমার খুব ইচ্ছে কোন একদিন গভীর রাতে প্রচন্ড বৃস্টির মাঝে কোন এক নির্জন স্টেশনে বসে থাকবো ।
আমরা যার যার বাইক চেক করে নিচ্ছি । টায়ার আর টায়ার। ছোট বড় সব ধরনের টায়ারে ভরা সপ গুলো। তার মানে বোঝা যায় এখানে টায়ারের সমস্যা নিয়েই বেশী গাড়ী আসে । আমি আমার টায়ার প্রেশার চেক করে নিলাম । সামনের চাকায় ৩২। পিছনে ৩৭ । লং ট্যুরে একা রাইড করার সময় সামনের চাকা ২৮ থেকে ৩২ আর পিছনে ৩৭ বেশী হলে ৩৮ খুব ভাল কম্বিনেসন । বাইক অনুযায়ী কম বেশী হতে পারে। চা আর কলা খেলাম । ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা হানিফ, শ্যামলি বাস গুলো বীরের মত চট্টগ্রামের দিকে ছুটে চলেছে । ক্যান্টনম্যান পেরিয়ে কিছু পরে বায়ের দিকের রোড চলে গেছে কুমিল্লা শহরে আর সোজা হচ্ছে বাইপাস সড়ক চট্টগ্রামের দিকে। আমি কতগুলো স্যালাইন কিনে ফেললাম । কারন টানা ৪ দিন রাইড করতে হলে কিছু এক্সট্রা প্রস্তুতি থাকা দরকার আছে । মাঝ দুপুরের গরমটাই একটু সমস্যা করবে। হানক রাইড করতে খুব ভাল লাগছিল । কোন এক্সট্রা সাউন্ড নেই এই বাইকের । অন্যান্য বাইক থেকে সাউন্ড একটু কম ।
এই বাইকের চলার ক্ষেত্রে নিজস্ব একটা স্টাইল আছে । বডি ডিজাইন এমন ভাবে তৈরী যে, আপনি চাইলেই ডান বামে নিতে পারবেন না । চাইলেই পাগলের মত চালাতে পারবেন না । আমার মত ৫ ফিট সাড়ে ৮ ইঞ্চ মানুষদের জন্য হানক আসলেই খুব ভাল বাইক । গতি উঠা নামার ক্ষেত্রেও এই বাইকের নিজস্ব একটা চরিত্র রয়েছে । এই বাইক কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাকে টেনসন ফ্রি রেখেছে তার নিজস্বতা দিয়ে । হানক একদম সোজা হয়ে চালানো যায় । সামনের দিকে ঝুকতে হচ্ছে না । হ্যান্ডেলবারটা একটু উচু । এই জন্য দু হাতে প্রেসার কম পড়ছিল । তা না হলে দু কাঁধে ব্যাথা করতো । তবে পিছনের চাকাটা আরেকটু মোটা হলে ভাল হতো । কুমিল্লা বাংলাদেশের অন্যতম বড় জেলা । এখানে যাই হোক না কেন, একটি জিনিষ খুব বিখ্যাত । সেটা হলো রস মালাই । রস মালাইর জন্য কুমিল্লার মাতৃভান্ডারকে নোবেল প্রাইজ দেয়া দরকার । আহা কি যে এটার স্বাদ। ভোলার নয় । অবশ্য কুমিল্লার আশে পাশের সব জায়গায় এমন কি রুরাল এরিয়ার গ্রাম্য দোকানেও খুব ভাল মানের মিস্টি তৈরি হয় ।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে কুমিল্লা, দেবিদ্বার, কোম্পানী গঞ্জ, মুরাদ নগর, রামচ ন্দ্রপুর এর আসে পাশের অনেক জায়গার এক পিস মিস্টি হলেও খেয়ে দেখেছি । মানুষের রস বোধ কেমন আছে জানি না তবে এরা মিস্টিতে রস ভালই দিতে জানে । তুলোনাহীন । দাম ঢাকার মত বেশী নয় । এটা শুধু স্বাদের ব্যাপার নয় অনুভবের ব্যাপার । তবে যাওয়ার পথে খাওয়া হয়নি ফেরার পথে খেয়েছিলাম । আধ ঘন্টা পরেই আবার রওয়ানা দিলাম । কুমিল্লা বাইপাস হয়ে ফেনীর দিকে । কুমিল্লা পার হতেই রাস্তায় তেমন কোন গাড়ী দেখলাম না । দিনের বেলা এই হাইওয়েতে গাড়ী কম থাকে আর এখন দুপুর হতে চলেছে । রাতে গাড়ীর প্রেশার অনেক বেশী । বিশেষ করে ভারী যানবাহন চলে বেশী । বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার একটার পর একটা যায় আর আসে । বাইকের গতি বেড়ে গিয়ে হলো ১০০ কিমি । স্পীডে চলার জন্য এর চেয়ে ভাল সময় হয়ত আর পাবো না । গাড়ীর হইসেল নেই, নেই রিক্সার টুংটাং । মাঝে মাঝে একটি দুটি বাস, প্রাইভেট কার আসছে যাচ্ছে । ততক্ষনে দেখলাম আমার সাথে কেও নাই ।
হাইওয়ে খালি পেয়ে সবাই ইচ্ছে মত টান দিয়েছে । উপরে বিশাল আকাশ নিচে আমি । ধানক্ষেতের দল ,খালবিল বাড়ী ঘর, গাছের সারি, দোকান পাট, হাট বাজার পেরিয়ে তীব্রবেগে ছুটছিলাম । সাদা মেঘের দলও আমার সাথে ছুটছে। আমারও প্রচন্ড ভাল লাগছিল । চোখ পুরো সামনে। এক চুল চোখ সরানোর উপায় নেই । চোখ সরালেই বিপদ । টান টান উত্তেজনা তখন শরীরে ও মনে। শরীরের রোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল । বাতাস গুলো সাই সাই করে মাথার দুপাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল । গম গম শো শো আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই । ঝড় শুরু হউয়ার আগে বাতাসের মতো। এ ত কিছুর পরও কেন জানি একটা নিরবতা অনুভব করছিলাম । একটা শুন্যতা গ্রাস করছিল । সামনের বাস ট্রাক সব একটার পর একটা পেরিয়ে যাচ্ছিলাম । ৩০ কিমি রাইড করার পর মনে হলো একটু ধীরে চালাই তাছাড়া হাতের গ্লাভস টাও খুলে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছিল । কি কারনে জানি না ধীরে ধীরে বাইকের গতি নামিয়ে ৩০ /৪০ কিমি করে ফেললাম । সামনে পিছনে কেও নেই । মাঝে মাঝে একটি দুটি বাস, প্রাইভেট কার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। যেতে যেতে ছোট হয়ে আসছিল । তারপর ছোট বিন্দু । তারপর কিছুই নেই ।
এইবার আশে পাশে জায়গা গুলো দেখতে পেলাম । হাইওয়ে থেকে নামলেই ধানক্ষেত, খাল বিল, দোকান । আমাদের দেশটাকে ধানক্ষেতের দেশ বলা যেতে পারে । মাঝে মাঝে কিছু মানুষের জটলা । স্কুলের কিছু মেয়েরা কথা বলতে বাড়ী ফিরছে মনে হলো। তবু আমি একা । আমি ছাড়া পৃথীবিতে যেন আর কেও নেই । রোদে ভেজা রাজপথ তখন রোদের তাপে সাদা হয়ে গেছে । আসলে ঢাকাতে সারাক্ষন কাজের মধ্যে থাকতে থাকতে জীবনটা কেমন যেন বন্দি পাখির মতো হয়ে গিয়েছিল । মুক্তির আনন্দ অনেক বড় আনন্দ । কোন কিছু না ভেবেই একটা টং দোকানে থেমে গেলাম । গরুর দুধের একটা চা খেলাম। দোকানের সামনেই বেঞ্চ ।
দোকানের পাশে কড়ই গাছ। আশে পাশে আরো ছোট বড় গাছ । গাছের পাতা গুলো বাতাসে দোল খাচ্ছিল । গাছের ডাল পালার ফাক দিয়ে টুকরো আকাশ আর মেঘের দলের আনাগোনা চোখে পড়ল । পাখী দেখতে পেলাম কয়েকটা । এক গাছ থেকে আরেক গাছে উড়ছে। পরিবেশটা দেশের অন্যান্য সাধারন গ্রাম্য পরিবেশের মতই। নির্জন ছিম ছাম জায়গা। মানুষের ব্যস্ততা বোঝা যাচ্ছে না । রিক্সা টেম্পু গুলো অলস বসে ছিল । দু একজন যাত্রী উঠে বসে আছে। পুরো ভরলেই রওয়ানা দেবে । তাদের তাড়াহুড়ো নেই। থাকলেও বোঝা যায় না। কোথাও কড়াত দিয়ে কাঠ কাটার শব্দ আসছিল । চিত্র শীল্পি হলে ছবি একে ফেলতাম । আসলে বাংলাদেশের ছোট ছোট বাজারগুলো দেখতে একই রকম । কিন্তু কোথাও গেলে আমরা হয়তো তেমন খেয়াল করি না। কিছুক্ষন পর আবার যাত্রা শুরু করলাম ।
ফেনীর কিছু আগেই সবাইকে পেয়ে গেলাম । রাস্তার ধারে সারি বেধে বাইক দাঁড়ানো । সম্ভবত চোদ্দগ্রামের পরে ছিল জায়গাটা । বাম পাশে দূরে ভারত - বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেষে বড় বড় পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছে । আর রাস্তার পাশে সবুজ ধানের ক্ষেত একদম ওই পাহাড় পযর্ন্ত চাদরের মত বিছানো । দারুন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য এবং ট্যুরের প্রথম পাহাড় দর্শন। বাংলাদেশে এত পাহাড় নেই । দেশের উচ্চতম পাহাড় ছিল কেওকাড়াডং। এখন সরকারী ভাবে রুমার রেমাক্রীতে অবস্থিত তাজিংডংকে উচ্চতম পাহাড় হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে । প্রায় ৪১০০ ফুট। তবে অনেকে উচ্চতম পাহাড় হিসাবে আরেকটি পাহাড়ের নাম বলে বলে । তবে এখনো প্রমানিত নয়। কেওকাড়াডং রোডটা পাকা হলে যাওয়ার ইচ্ছে আছে ।
বাংলাদেশ পাহাড়ী দেশ নয় । হিমালয় সামনে থেকে দেখতে কেমন জানা নেই । আমি তো নীলগীরিতে গিয়েই মুগ্ধ হয়ে যাই । মনে হয় মেঘের দেশে এসেছি । তবে বাংলাদেশে মাইলের পর মাইল রয়েছে সমতল ভুমি । সবুজ মাঠ । রয়েছে বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে চলা হাজারো ছোট বড় নদ নদী । রয়েছে পৃথিবীর সব চেয়ে বড় সমুদ্র সৈকত কক্স বাজার যা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। তাই এই সুন্দর দেশ নিয়ে জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল হাজারো গল্প,কবিতা, উপন্যাস, গান লিখেছে। কবিদের কবিতা লেখার দেশ । আমাদের সমতল জমি প্রয়োজন পাহাড় নয়। পাহাড় দেখতে সুন্দর কিন্তু জীবনের প্রয়োজন মেটাতে পারে না । আমাদের সমতল জমি প্রয়োজন এক চিলতে ফসলের জন্য । মনে পড়ে গ্রামের বাড়ীতে এক কৃষক তার ধানী জমি গুলো দেখিয়েছিল । দু বছর ভাল ফসল হয় নি। সেই বার সে খুব খুশীতে আত্বহারা ছিল । জমির আইল দিয়ে হাটতে হাটতে দেখাচ্ছিল আর অনবরত গল্প করছিল । সেদিন তার মুখে যে খুশীর ঝলক দেখেছিলাম তা ভোলার নয়। যাই হোক একটু অন্য প্রসংগ চলে এসেছে। চলুন আমরা ফিরে যাই আমাদের ট্যুরে ।
কিছুক্ষন পর আবার যাত্রা শুরু । ঠিক হলো ফেনীর পর একটা ছোট বিরতি দেবো এরপর আর বিরতি হবে না । একদম চট্টগ্রামে বিরতি হবে । ফেনীতে একটা ছোট হোটেলে দাঁড়ালাম । দুপুর হচ্ছিল । একটু গরম লাগছিল। যদিও তখনো পুরোপুরি দুপুর হয়নি । কয়েকটি স্যালাইন পানিতে গুলিয়ে খেয়ে ফেললাম । দরকার ছিল না কারন ক্লান্ত ছিলাম না । তবু একটু রিফ্রেস হওয়ার জন্য খাওয়া । তবে ঘন্টা দুয়েক পর কাজে দেবে । রক্ত চলাচলে ভাল সহায়ক।
আমার মতে লং রাইডের সময় প্রতি ৫ থেকে ৭ ঘন্টা পর পর এক গ্লাস স্যালাইন মেশানো পানি খাওয়া শরীরের জন্য ভাল । আর প্রচুর পরিমানে পানি খেতে হবে । ৩/৪ দিনের টানা রাইড হলে শেষের দিন এটার ফল বুঝতে পারবেন । রাতে ভাল ঘুম হবে । এটা শরীরের স্ট্যামিনা অনেক বাড়িয়ে দেবে । শরীরে অনেক শক্তি থাকা সত্তেও অনেকে লং রাইড করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে । এর কারন শরীরে স্ট্যামিনা থাকে না । তাই লং রাইডে যে যত পানি খাবে তত অনেক সময় ধরে রাইডের শক্তি পাবে । এটা এমন না যে এখন এক জগ পানি খেলাম আবার ৫ ঘন্টা পর আরেক জগ। খেতে হবে নির্দিস্ট সময় পর পর । সবচেয়ে ভাল প্রত্যেক ঘন্টায় এক গ্লাস পানি খাওয়া ।
হাইওয়ের পাশে থাকা টিউ বয়েলের পানি আপনাকে অনাবিল প্রশান্তি দেবে । মাটির ভিতরের একদম পরিস্কার পানি । খাওয়ার সাথে সাথে চোখ বন্ধ করলে আপনি হারিয়ে যাবেন অন্য দুনিয়ায়। আবার যাত্রা শুরু। এবার সবাই আরো সিরিয়াস । খালি রোডে ৮০/ ৯০/ ১০০ তে বাইক চলছে । তাই আশে পাশে কি আছে দেখার সুযোগ পাই নি । যথারীতি সবাই আমার আগে চলে গিয়েছিল । সমুদ্র কাছে হওয়ায় এখানকার বাতাসটাও একটু ভিন্ন আমেজ দিচ্ছিল। মিরসরাইয়ের আশে পাশে ছিলাম মনে হয় । বাতাসের শো শো শব্দ । তবে সত্যি কথা কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম হাইওয়ে বাইক রাইডের জন্য অসাধারন এক হাইওয়ে । একবার রাইড শুরু করলে আর থামতে হবে না । এক টানে চট্টগ্রাম। এভাবেই টানা নগর বন্দর পেরিয়ে দুপুর ১:৩৮ শে চলে আসলাম চট্টগ্রাম গেইটে ।
সব বাইক পৌছে গিয়েছিল আগেই । আমি যথারীতি সবার পেছনে । লেট লতিফ । তবে ঢাকায় ফেরার দিন এই সমস্যা হয় নি । আসলে বাইকারদের সাথে একবার বোঝা পড়া হয়ে গেলে এইগুলো নিয়ে পরে কেও কিছু মনে করে না । ট্যুর শেষে আনন্দের পরিমানটাই বেশী থাকে । চট্টগ্রাম গেটের একটু পরেই বামে দিয়ে বের হতে হবে । ওখান দিয়েই শাহ আমানত শাহ সেতু। । সেতু পার হয়ে কক্স বাজার হাইওয়ে । এখানে ঢাকা শহরের মত অবস্থা । রিক্সা, গাড়ী, দূর পাল্লার বাস, টেম্পু, মানুষের ভীড়ে ঠাসা রোড । গাড়ী, রিক্সা, বাসের প্যা পু শব্দে কান ঝালাপালা অবস্থা । অবশ্য খারাপ লাগছিল না । নতুন জায়গা আমি শুধু দেখছিলাম খুটিয়ে খুটিয়ে । তবে ঢাকা শহর নিয়ে যতই সমালোচনা করি না কেন ঢাকার বাইরে ৪/৫ দিনের বেশী থাকতে পারি না। গ্যাঞ্জামের শহর ঢাকাই সবচেয়ে আপন মনে হয় । তার উপর জন্ম আমার ঢাকায়। পিলখানায় । দুপুরের গরমে ঘামছিলাম ।
ওদের সবাইকে খুজে পেতে একটু সময় লাগল । জ্যামে আটকে পরেছিলাম বেশ কিছু সময় । গ্রুপে ট্যুর দেয়ার সুবিধা আছে আবার কিছু অসুবিধাও আছে । যাই হোক সবাই একসাথে মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত হলো দুপুরে হালকা খেয়ে রওয়ানা হবো । এখন খেলে শরীরে ক্লান্তি চলে আসতে পারে । খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম না নিলে খারাপ লাগতে পারে । তাছাড়া আমরা একটা ছন্দের মাঝে ছিলাম। ছন্দটা ব্রেক করতে চাইনি । আমার খিদে ছিল না বেশী । আমরা হালকা চা নাস্তা খেয়ে নিয়েছিলাম । আবার রাইড শুরু । চলতে চলতে একজন বাইকার আবার অন্যপথে চলে গিয়েছিল তাকে খুজে আনতে লিভো বাইকার সিহাব গিয়ে ধরে নিয়ে আসল । আমিও চেনা পথও পরেরবার গেলে একদম ভুলে যাই । তাই কোন নতুন পথে গেলে মনে রাখি না । যত টুকু মনে থাকে থাকল না হলে ওইখানকার মানুষ গুলো সাহায্য করে । গ্রুপ রাইডে এই রকম ছোট খাটো সমস্যা হবেই ।
চট্টগ্রাম শহর থেকে শাহ আমানত সেতুর পযর্ন্ত তখন বিশাল হাইওয়ে রোডের কন্সট্রাকসন কাজ চলছিল । এই ভাল আবার এই খারাপ । তাই সেতুতে পৌছাতে দেরী হয়েছিল । দূর থেকে সেতুটা ঝুলন্ত সেতুর মত মনে হয় কিন্তু এটা ঝুলন্ত সেতু নয়। দূর থেকে লন্ডনের টেমস নদীর ঝুলন্ত ব্রীজের মতো মনে হচ্ছিল। শাহ আমানত সেতুর মাঝখানে দাড়ালাম সব বাইক । কনর্ফুলী নদীর উপর ব্রিজ । ঝুলন্ত ব্রিজের মত উপর থেকে বড় বড় তার টানা সেতু । দূর থেকে ছোট মনে হচ্ছিল অথচ কাছে আসার পর দেখলাম কি বিশাল। উপরে নীল সাদা মেঘের আকাশ । এটাই মনে হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর সেতু । ব্রিজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নদীটির তাকালে আরো বেশী ভাল লাগে । নদীর উপর থেকে বিশাল সমুদ্রের বড় জাহাজ গুলো ছোট দেখায় । জাহাজের হুইসেল গুলো কানে আসে। অনেক আওয়াজ । আওয়াজ যত জোরেই হোক শুনতে ভালই লাগে ।
ছোট বড় অনেক জাহাজ ভরপুর । জাহাজ গুলো নোংগর করা । কিছু স্পিড বোট দেখতে পেলাম নদীর মাঝ দিয়ে চলছে ঢেউ তুলে । নৌকা চলছে ইঞ্জিন চালিত । বৈঠা চালিত নৌকা ছিল কিনা খেয়াল করিনি । কিছুক্ষন পরিবেশটা উপভোগ করলাম । গরম তখনও ভালই ছিল । তবে মাঝ দুপুরের থেকে একটু কম । ওখান থেকে যাত্রা শুরু হলো ৩.৩০ শে । এবার গন্তব্য বান্দরবান । মাঝখানে লাঞ্চের বিরতি নেয়া হবে । এই পর্যন্ত কোন সমস্যা হয়নি কারো। চট্টগ্রাম থেকে বান্দারবান ৭৫ কিমি। গন্তব্যে যাওয়ার একটা তাগিদ ছিল আমাদের । সন্ধ্যার পর ওই পথে রাইড করতে চাচ্ছিলাম না। কারন ৫.৩০ টার দিকেই সন্ধ্যা হয়ে যায় । এখানকার সন্ধ্যা মানেই একটু বেশী অন্ধ্কার । সন্ধ্যার পর পর পৌছে যাবো আশা করি । পটিয়া, চন্দনাইস দোহাজারী পার হয়ে সাতকানিয়ার দিকে ছুটছিলাম আমরা । সাতকানিয়া থেকে বামের পথটি চলে গেছে সোজা বান্দরবান । যথারীতি সব বাইক আমার আগে চলে গেল আমি শেষে ।
সাতকানিয়া গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল । এখন সবাই সিরিয়াস। এই এলাকায় সব বাইক একসাথে থাকা বেশী জরুরী । অচেনা জায়গায় বিপদের আশংকা বেশী থাকে । ঢাকা থেকে বান্দরবান ৩২৫ কিমি । সাতকানিয়া থেকে ৩০ কিলো হবে বান্দরবান । আমিও একটু সিরিয়াস হলাম ভাবলাম আর পিছনে থাকবো না সবাইকে একটু কস্ট দিচ্ছিলাম মনে হচ্ছিল । আমার মতো অলস বাইকারকে পুরো ট্যুরে হাসি মুখে সহ্য করার জন্য গ্রুপের সবাইকে এই লেখার মাধ্যমে ধন্যবাদ । সাতকানিয়া কিছুক্ষন চলার পর ধীরে ধীরে বান্দরবান পাহাড়ী পথ শুরু হলো । আঁকা বাঁকা উঁচু নিঁচু । সিংগেল রোড । এবার আমি সবার প্রথমে রাইড করছিলাম । এখানে সিএনজি এবং বাইক বেশী চলতে দেখলাম ।
পাহাড়ের মাঝ দিয়ে গাছের সারি পেরিয়ে বাইক ছুটছিল গন্তব্যের দিকে । দু পাশে ঝোপ ঝাড়, অগনিত নাম না জানা গাছ পালার সমাহার । সারাদিন রাইডিংগের সাথে এই পরিবেশের কোন মিল নেই । আমার বাইকের গতি ভালই ছিল । গতিটা নাই বলি । রাস্তার দু পাশে গাছের সারি আর ছোট বড় পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বাইক চলছে । ৩০ ফুটের রাস্তা মনে হয় । ইউ টার্ন গুলোতে বড় আয়না লাগানো । অপর পাশের গাড়ী দেখার জন্য । একটানা টেনে গেছি । ইউ টার্ন, কর্নারিং করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম । একবার ডানে আরেক বামে । বাতাসের ধাক্কাটা বেশ ভালই উপভোগ করছিলাম । যা সব সময় করি । আবার সেই একই আওয়াজ। শো শো । দুপুরের গরমে যে কস্ট হয়েছিল সেটা ভুলে গেলাম নিমিষেই । পাহাড়ী পথের একমাত্র নিয়ম হলো বায়ে থাকা । এই নিয়মের কোন বিকল্প নেই । এইসব পথে গাড়ী আসা যাওয়ার কোন টাইম টেবিল নেই ।
কিছুক্ষন দেখা যায় রাস্তা ফাকা আবার দেখা যায় বলা নেই কওয়া নেই উলটো দিক থেকে গাড়ী সুত করে চলে আসে । ইউ টার্ন এর সময় মনে হবে ওই পাশে কোন গাড়ী নেই আচমকা দেখা গেল বড় বাস চলে এসেছে । পুরো রোড দখল করে। মাঝে মাঝে মনে হবে এখান কার মানুষ জন গেল কোথায় । মানুষ নেই নাকি। একটু পরেই দু এক জন দেখা যাবে। সাতকানিয়া থেকে যাও মাঝে মাঝে দোকান পাট, বাজার ছিল তাও ধীরে ধীরে একদম কমে গেছে। একটু ক্লান্ত লাগছিল অবশ্য । শরীর ব্যাথা নেই । সারা শরীরে ধুলোর আস্তরন লেগে একাকার। এভাবেই চলতে চলতে উজিরপুর এসে থামলাম । লাঞ্চ করবো । দুপুরের লাঞ্চ করছি বিকেলে । ৫.৩০ টায় সন্ধ্যা হয় তখন ৪.৩০ বাজে সম্ভবত । উজিরপুর মার্কেটের আন্ডার গ্রাউন্ডে সুন্দর একটা হোটেল আছে ।
ছিম ছাম, সাজানো গোছানো । হাত মুখ ভাল করে ধুয়ে নিলাম । ভাগ্য ভাল খাবার পেয়েছি। ভাত নিলাম, চিকন চাউলের ভাত । মান ভাল । পরিবেশন ভাল । গরুর মাংস দিয়ে ভরপেট খেয়ে শেষে ডাল দিয়ে ফিনিসিং । খাওয়ার আগে সুন্দর করে শশা দিয়ে সালাদ বানিয়ে দিতে বলেছিলাম । গোল গোল টেবিল গুলোতে ৩/৪ জন করে বসে গেলাম । পুরো হোটেলে শুধু আমরা। খিদেয় পেট চো চো করছিল সবার। মন প্রান এক করে খেলাম । একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে পাহাড়ী সন্ধ্যা মানে ভিন্য রকম ভিন্য আমেজ । নির্জন সন্ধ্যা মানে উপভোগের সন্ধ্যা । এখানে কোন কোলাহল নেই । কেও বিরক্ত করার নেই । বিকেলটাও অনেক মনোরম। খাওয়ার পরেই ঘুম ঘুম একটা ভাব চলে এসেছে । গরম কমে গেছে অনেক । তাই পরিবেশটা আরো ভাল লাগছিল ।
বাজারে মানুষ জন ছিল না তেমন । তবে উপভোগের সময় ছিল না রওয়ানা দিতে হল । গন্তব্যে পৌছানোর তাড়া ছিল। সন্ধ্যার পর বাইক চালানো একটু বিপদ জনক। বান্দরবান শহর বেশী দূর ছিল না । ছোট বেলায় ভাবতাম বান্দরবানে নিশ্চই অনেক বান্দর থাকে এই কারনে নাম বান্দরবান হয়েছে । কিশোর বয়েসে ওখানে গিয়ে অনেক সময় ধরে এখানে সেখানে বানর খুজেওছিলাম । একটাও বানর দেখি নি । ভুল ভাংগতে অনেক দিন লেগেছিল। তবে বান্দরবানের নাম বানরদের একটি ঘটনা থেকেই এসেছে বলে স্রুতি আছে। স্থানীয় ভাবে কথিত আছে অনেক অনেক আগে এখানে অনেক বান্দর থাকত ।
তারা নদী পার হয়ে এখানে খাবার খেতে আসত। কোন এক সময় প্রচন্ড বৃস্টিতে নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় নদী পার হতে পারছিল না। ওরা একটা বুদ্ধি বের করল। একজনের উপর আরেক জনের হাত ধরে সারিবদ্ধ ভাবে বাধের মত অথবা এই ধরনের কিছু একটা করে নদী পার হয়েছিল বলে শোনা যায় । স্থানীয় লোকজন এটা দেখে এর নাম দেয় ম্যা অকসি। মারমা ভাষায় ম্যা অর্থ বানর অকসি অর্থ বাধ । কালের বিবর্তনে এই জায়গার নাম হয়ে যায় বান্দরবান । সুন্দর ঘটনা শুনতে ভালই লাগে। আমরা রাইড শুরু করলাম । পুরো রাস্তায় বাজার ছাড়া দু এক জন মানুষ দেখেছিলাম কিনা মনে পড়ছে না। । বাড়ী ঘর তেমনই । অনেক কম । রাস্তার দু পাশের অসংখ্য ঝোপ ঝাড় গাছ, পাহাড় ঘেরা এই পথে একটু রাত মানেই গভীর রাতের মত মনে হয় । বান্দরবান রোডে রাত ৮ টার পর গাড়ী চালানো নিষেধ । সব ঠিক থাকলে এত সময় লাগবে না । রাইড করতে করতেই সন্ধ্যা নেমে চারিপাশ অন্ধ্কার হয়ে এল ।
তবে এরপর একটা ঘটনা ঘটল। বাইকারদের সচেতন করার জন্যই ঘটনাটার উল্লেখ করছি । তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে । ও ই পাশ থেকে সিএনজি, বাইক মাঝে মাঝে একটি দুটি প্রাইভেট কার আসছে । সিএনজি আর বাইকই বেশী । আমিও একটার পর একটা গাড়ী ওভারটেক করে চলেছি সুযোগ বুঝে । ওই পাশ থেকে গাড়ী আসছে। আর পাশ কেটে চলে যাচ্ছে । আমার সামনে তখন একটা সিএনজি । তাকে ওভারটেক করবো করবো করছি । কিন্তু তখনি আমার পিছন থেকে আমাদের একজন বাইকার দ্রুত গতিতে আমাকে এবং আমার সামনে থাকা সিএনজিকে ওভারটেক করছিল। যথারীতি উনি আমার আমার পাশে চলে এলেন । আমি যেমন আছি তাই ছিলাম একই সময় উলটো দিক একটা সিএনজি আসছিল । ওই সিএনজির পিছনে একটা স্থানীয় বাইকার ছিল সেও ওই সিএনজিকে ওভারটেক করছিল । কিন্তু দু:খ জনক হলেও সত্য ওই স্থানীয় বাইকারের কোন হেডলাইট ছিল না । অন্ধকারে বোঝার উপায় নেই ওটা একটা বাইক । ঘটনাটা আচমকা ঘটে গেলো । না কোন এক্সিডেন্ট হয় নি । ওই দুটো বাইকের ইঞ্চি খানেকের জন্য সংঘর্ষ হয় নি। ভাগ্য ভাল ছিল ।
আমিও বিপদে পড়তে পারতাম । বান্দরবান হাইওয়েতে সন্ধ্যার পর স্থানীয় বাইকাররা চোর ডাকাতের ভয়ে হেডলাইট ছাড়াই রাইড করে । কারন অন্ধকারে চোর ডাকাতের আনাগোনা বেশী পাহাড়ী পথে । এক বিপদ থেকে বাচতে আরেক বিপদ ডেকে আনা আর কি । এই জন্যই পাহাড়ী পথে সবসময় বামে থেকে চালানোই সবচেয়ে নিরাপদ । পরে আর সমস্যা হয় নি । বাইক নিয়ে যখন বান্দরবান পৌছলাম তখন ৬.৩০ বাজে । নিরব, নিস্তব্ধ ভিন্য কিছু । কোলাহল হীন । অন্ধ্কার কিন্তু অসাধারন মন ভাল লাগা পরিবেশ । আপনি গেলেই আপনাকে নিরবতা গ্রাস করবে । বিশেষ করে রাত ১০ টার পরে তো মনে হবে ভুতের নগরী । গা ছম ছম করা একটা ভাব আসবে । যদি একা থাকেন তাহলে । তবে সন্ধ্যা উপভোগ করার সময় ছিল না কারন সবাই খুব ক্লান্ত ছিলাম । হোটেলে ওঠার আগে বাইকের তেল ভরে নিয়েছিলাম সবাই । হোটেলের নাম গ্রীন ল্যান্ড । তিন তলা হোটেল । এর থেকেও ভাল হোটেল আছে এখানে তবে সব হোটেলে বাইক রাখার জায়গা নেই । এই হোটেলের আন্ডার গ্রাউন্ডে বাইক রাখার ভাল জায়গা ছিল । নিরাপত্তা ভাল ।
সবাই আন্ডার গ্রাউন্ডে বাইক রেখে হোটেলে উঠলাম । দোতালার পুরো ফ্লোরটা বুক করা ছিল । আমার সংগী হলো সজীব । কথা বলতে বলতেই ফ্রি হয়ে গেলাম । ঘরটা এত উন্নত না হলেও খারাপ না । পরিস্কার আছে। লাগোয়া বাথরুম সহ দুটি খাট রাখা রুমে । দুজন ৫০০ টাকায় হয়ে গেল । বাইক রাখার জন্য কোন অতিরিক্ত খরচ নেই । ক্লান্তি আর ধুলো বালিতে সয়লাব শরীর । গোসল করে ফ্রেশ হয়ে ঘন্টা খানেক বিশ্রাম নিয়ে নিলাম । শীত লাগছিল তখন । আমরা রাত দশটার দিকে বের হলাম ডিনারের জন্য । এখানকার খাবারের হোটেল কয়টা পযর্ন্ত খোলা থাকে জানা ছিল না । হোটেল গ্রীন ল্যান্ডের পাশে লাগোয়া রেস্তোরা রয়েছে । গ্রীন প্রেইরী। দারুন পরিবেশ । সুন্দর ছিমছাম সাজানো হোটেল । হোটেলের আশে পাশে কোন দোকান পাট নেই । গভীর নিরবতা চারদিকে । এত নিরবতা অনেকদিন দেখা হয়নি । হোটেলের অপর পাশে ছোট্ট একটা পাহাড় । পাহাড় বলবো না টিলার মত । হোটেলটা শহরের শেষ প্রান্তে । হোটেলের থেকে নেমেই ডান দিক দিয়ে চলে গেছে রুমা, থানচি, নীলগিরি আর বাম পাশ দিয়ে বান্দরবান মুল শহর । কুয়াশা পড়া শুরু হয়েছে তখন । আগেই বলেছিলাম এখানে সকালে এবং রাতে শীত পড়ে আর দিনের আলো বাড়ার সাথে সাথে গরম । মাঝ দুপুরে গরম বেশী হয় । সবাই বেশ ফুরফুরে মেজাজে ছিল । আসার পথের বিভিন্য কথা হচ্ছিল । নিরাপদে আসতে পেরে ভাল লাগছিল সবার । গ্রীন প্রেইরীতে খেতে বসলাম। খাবারের মেনু খিচুরি । পাহাড়ী মুরগি দিয়ে খিচুরিটা খেতে বেশ লেগেছিল । প্রতি প্লেট ১৬০ ছিল যতদুর মনে পরে । এরা যে খাবার আগে থেকে তৈরী করে রাখে তেমন না।
অর্ডার দিলে রান্না করে দেয় । খিদের কারনেই হোক আর অন্য কিছু হোক খিচুরিটা খেতে ভাল লেগেছিল। দু তিনটি টেবিল একসাথে জড়ো করে সবাই একসাথে খেলাম । পরদিন সকালের নাস্তার কথা বলে রাখলাম। হোটেল থেকে বের হতেই রাতটা অসাধারন মায়াময় লাগছিল । আকাশে কোন তারা নেই। নিকষ কালো অন্ধকার । অদ্ভুত অন্ধকার পরিবেশ। হাটতে বের হলাম । কিছুদুর আসতেই রাস্তার বাড়ীঘর দেখা গেল। সত্যি কথা এই সব বাড়ীতে মানুষ জন আছে কি নেই বুজতে পারিনি । কোন শব্দ নেই । শুধু রাস্তায় হাটার সময় নিজেদের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আর আমাদের কথা ।
মাঝে মাঝে রাস্তার এপাশ ওপাশ তাকিয়ে জোনাকী পোকা খুজলাম। না পেলাম না। আকাশে তারা নেই। মাঝেই মাঝেই ঝি ঝি পোকার ডাকে পরিবেশটা আরো নির্জন হয়ে গেছে। আর একটু ভেতরে ঢুকতেই অল্প কিছু দোকান খোলা পাওয়া গেল। কেও হয়তো বা এটাকে ভুতুরে পরিবেশ মনে করতে পারেন । কেও এটাকে মনোরম পরিবেশ ভাবতে পারেন। তবে যে যেটা ভাবেন সমস্যা নেই ভাবনার ডানা মেললেই হলো । এই শহরটার তিন দিকে নদী বয়ে গেছে। তিন দিকে বলতে সাংগু নদীটি ইউ অক্ষরের মত শহরটাকে পেচিয়ে বয়ে গেছে। ইউয়ের ভেতরই মুল শহর আর নদীর ওপারেও বাড়ী ঘর রয়েছে। ৭টি উপজেলা নিয়ে গঠিত বান্দরবানে মোটামুটি ৪ লাখ মানুশের বসবাস । বাংলাদেশের সবচেয়ে কম ঘনবসতির জেলা। সাংগু নদীই এখানকার জনপদের জীবন ধারনের মুল উৎস। আর হচ্ছে জুম চাষ।
একটি জমিতে কয়েক রকমের ফসল যেখানে চাষ হয় তাকেই বলা হয় জুম চাষ। ধান,গম,ভুট্টা,আদা নানা ধরনের ফসল এক জমিতেই চাষ করা হয়। আর আছে পাহাড়ীদের হাতে তাতে বোনা সুন্দর সুন্দর কাপড়। বাংগালী এবং উপজাতিরা মিলেমিশে এখানে থাকে । উপজাতিদের মধ্যে চাকমা, মারমা সহ বেশ কিছু উপজাতী রয়েছে । পাগাড়ের গা ঘেষে গড়ে ওঠা এই হিল সিটি বাংলাদেশের অন্যতম সেরা পাহাড়ী শহর । ট্যুরিস্ট স্পট হিসাবে বর্তমানে সব ধরননের সুযোগ সুবিধাই রয়েছে এখানে। রয়েছে নীলগিরি, নিলাচল, স্বন মন্দির সহ অনেক ভ্রমন স্থান। রয়েছে পাহাড়ী ঝর্নার অবিরাম বয়ে চলা। আসলে বান্দরবান, রাংগামাটি, থাঞ্চি নাম গুলো শোনার সাথে সাথেই চমৎকার একটি অনুভতি কাজ করে মনের ভেতর । পাহাড়ী অপরুপ সৌন্দর্যের লীলাভুমি ।
পাহাড়ী মানুষগুলো শান্তি প্রিয় হয় । ঘোর প্যাঁচ নেই । জিনিষ পত্রের দামের ব্যাপারেও এরা দামাদামী পছন্দ করে না । কিছু লাভ রেখে বিক্রি করে । পথে একজন আমাদের ডিম পাহাড়ের পথ সম্পর্কে সাবধান করলো । বাবা বি ডি আরে থাকার সময় এই এলাকায় বেশ কিছুদিন ছিল । ৯০ সালের কথা বলছি। তখন এই এলাকা অত্যন্ত বিপদ জনক ও ভয়ংকর ছিল । আর এখন অনেক নিরাপদ ।সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রন করে এই অঞ্চল গুলো । তবু একটা দুটো ঘটনা ঘটে যায় । এখানকার মানুষ গুলো দেশের অন্যান্য এলাকার মানুষদের মতোই খেটে খাওয়া সাধারন মানুষ । সহজ সরল জীবন ধারন করতেই অভ্যস্ত । কিছুক্ষন বান্দরবানের রাস্তা ধরে এদিক ওদিক হাটাহাটি করে ফিরলাম হোটেলে । একটু পরেই এক এক করে আমাদের রুমে হাজির সবাই ।
শুরু হলো আড্ডা। ১৫ / ১৬ জন মানুষে ভরে গেল রুম । কেও বসে, কেও দাড়িয়ে, কেও হেলান দিয়ে। ঘুমে জড়িয়ে আসছিল চোখ । একটা শান্তির ঘুমের প্রয়োজন অনুভব করছিলাম। কিন্তু গিটার যেহেতু ঢাকা থেকে নিয়ে আসা হলো । গান না হলে কি জমবে কেন । আমি অনেক দিন গান গাই না ।আসলে এখন যা গাইবো তা সবারই ভাল লাগবে। ফুরফুরে মেজাজে থাকলে হেড়ে গলার গানও ভাল লাগে। এ কথা সে কথার পর গাওয়া শুরু করলাম । ঘুম ঘুম চোখে ঘুম ঘুম গান গাওয়া হয়নি। আসর জমানো গানই গাওয়া হচ্ছিল । আস্তে আস্তে জমে উঠেছিল । গিটারের টুং টাং শব্দ আর গানে রুমটা গম গম করছিল । বাইরে কতদুর পযর্ন্ত শোনা গিয়েছিল জানা ছিল না । সারাদিন রাইড করার পর এই রকম আড্ডা গানের আসর সবাইকে আনন্দিত করাই স্বভাবিক। হৈ হুল্লোর,হাত তালিতে ভরে গিয়েছিল ঘরটা।বাইকার সবাই গায়ক হয়ে গিয়েছিল যেন ।
আরেকজনের কথা বলতে হয় সে হলো মারুফ । সে গান গাইল । সুন্দর এন্টারটেইনিং গান । মজার গান। সবাই গলা মিলিয়ে গান গাইলাম কিছুক্ষন । বেশীর ভাগই ফোক গান। তবে মারুফ আসল বিনোদন দিয়েছিল কক্স বাজারে । সে গল্প পরে বলছি । রাত একটায় আমরা ঘুমাতে গেলাম । পরদিন কঠিন সিডিউল। পাহাড়ী পথের রাইডিং উত্তেজনা। কঠিন রাইড অবশ্যই । কাল শুরু আসল এডভেঞ্চার, থ্রিলিং রাইড। ক্লান্ত ছিলাম তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । বেশ ঠান্ডা লাগছিল । একটা অজানা উত্তেজনায় ভালই ঘুম হলো । ভবঘুরে জীবনের আনন্দের ঘুম। সব কাজ থেকে মুক্তির আনন্দ। গল্পের প্রথম কিস্তি এখানেই শেষ হলো। কেমন লাগলো জানাবেন। কোথাও ভুল হলে ক্ষমা প্রার্থী।
লেখকঃ মিজানুর রহমান রিপন