কিওয়ে আরকেএস ১২৫ টিম বাইকবিডি টেষ্টরাইড রিভিউ

This page was last updated on 06-Jul-2024 09:12am , By Shuvo Bangla

স্পিডওজ লিমিটেড, বাংলাদেশের মোটরসাইকেল বাজারে কিওয়ে ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলের একমাত্র পরিবেশক। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা আমাদের পথে-ঘাটে, শহরে-বন্দরে কিওয়ে আরকেএস ১২৫ মডেলের বেশকিছু মোটরসাইকেল চলতে দেখছি। আর সেই সাথে সাথে আমরাও বাইকটি সম্পর্কে আপনাদের কাছ থেকে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছি। আর সেজন্যই আমরা আপনাদের সহযোগীতার জন্য আজ কিওয়ে আরকেএস ১২৫ টিম বাইকবিডি টেষ্টরাইড রিভিউ নিয়ে হাজির হয়েছি। আসুন আমাদের টেষ্টরাইড রিভিউয়ের মাধ্যমে আপনাদের প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবার চেষ্টা করি।

কিওয়ে মোটরসাইকেল ব্র্যান্ডটি ১৯৯৯ সালে হাঙ্গেরীতে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাথমিকভাবে কোম্পানীটির লক্ষ্য ছিল স্কুটার উৎপাদনে আঞ্চলিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কিওয়ে আজ বিশ্বে একটি বহুজাতিক মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড, যার কার্যক্রম প্রায় আশিটি দেশে বিস্তৃত; আর তা কেবল স্কুটারের ক্ষেত্রে নয় বরং অনেক উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন মোটরসাইকেলও তারা উৎপাদন করে।

বাংলাদেশে স্পিডওজ লিমিটেড মেগেলী ও স্পাইকার মোটরসাইকেল আমদানী করে বাজারজাত করতো। কিন্তু বর্তমানে তারা স্বকীয়তায় মনোযোগী। বাংলাদেশের বাজারে মোটরসাইকেল ব্যবসায় তাদের প্রতিশ্রুতিশীলতার প্রমানে তারা বগুড়া জেলায় মোটরসাইকেল উৎপাদনের কারখানা স্থাপন করছে। আশা করা যায ২-৩ বছরের মধ্যেই তারা পুরোদমে বাংলাদেশের জন্য মোটরসাইকেল উৎপাদন করতে পারবে। যাহোক, চলুন আর কথা না বাড়িয়ে আমাদের মূল রিভিউ অংশে যাওয়া যাক।

ইঞ্জিন:

কিওয়ে আরকেএস ১২৫ এর ইঞ্জিনটি একটি ১২৫সিসি এয়ার-কুলড ফোর-ষ্ট্রোক ইঞ্জিন। প্রাথমিকভাবে বাহ্যিক দর্শনে আপনারা খেয়াল করলে দেখবেন যে এর ইঞ্জিনটি আকারে বেশ বড়, অনেকটা ১৫০সিসি ইঞ্জিনের মতোই। এই ১২৫সিসি ইঞ্জিনটি ১১.২বিএইচপি শক্তি ও ৯.২এনএম টর্ক উৎপন্ন করতে পারে। এই ইঞ্জিনটির লুব্রিকেশন চাপযুক্ত তেল নিক্ষেপনের মাধ্যমে করা হয়, আর এতে রয়েছে কার্বুরেটর নিয়ন্ত্রিত ফুয়েল সিস্টেম। এর ইঞ্জিনের শক্তি ৫-স্পিড গিয়ার বক্স দ্বারা পরিচালিত, আর এতে রয়েছে ভেজা মাল্টি-প্লেট ক্লাচ সিষ্টেম।

কিওয়ে আরকেএস ১২৫ এর ইঞ্জিনের গুঞ্জন কিছুটা আলাদা ধরনের। এর গুঞ্জন হয়তোবা হিরো গ্ল্যামার বাইকটির মতো মসৃন নয়, তবে বেশ খানিকটা ভিন্ন ধরনের যাতে আপনার মনে হতে পারে যে এটা হয়তো প্রয়োজনের তুলনায় বেশী বাতাস টানছে, অনেকটা টার্বো-চার্জার সম্বলিত ইঞ্জিনের মতো।

আমরা আমাদের নিরিক্ষার সময় বাইকটিতে কিছুটা ঝাঁকুনি অনুভব করেছি, তবে তা ছিল কেবল উচ্চ আরপিএম এ; আর সেটা ছিল ৬০০০-৬৫০০ আরপিএম এর দিকে। যেহেতু কিওয়ে আরকেএস ১২৫ বাইকটি একটি কমিউটার তথা অল্প ক্ষমতা সম্পন্ন বাইক, সেহেতু আপনাকে বেশির ভাগ সময়েই হয়তো এরকম উচ্চ আরপিএম এ বাইক চালাতেই হবে না, ফলে হয়তো আপনি এই ঝাঁকুনি অনুভব করার অবস্থায় পড়বেনই না।

ডিজাইন:

কিওয়ে আরকেএস ১২৫ বর্তমান সময়ে ১২৫সিসি ক্যাটাগরীতে একটি দৃষ্টিনন্দন আর কিছুটা আগ্রসী ডিজাইনের বাইক যাতে হয়তো দ্বিমত করার সামান্যই সুযোগ আছে। বাইকটিতে নেকড়ে সুলভ হেডলাইট ডিজাইনের পাশাপাশি চমৎকার ছাটের পেছন প্যানেলসহ পুরো ডিজাইনটিই বেশ গোছানো। বাইকটির হ্যান্ডেলবার অনেক ছড়ানো নয়, বরং বাইকের সাথে মানানসইভাবে খানিকটা খাটো, যাতে ছোট আকারের বাইকটি সহজেই নিয়ন্ত্রন করা যায়। আর বাইকটির ছোট আকারের সাথে সাথে এর সিটের উচ্চতাও খানিকটা কম। ফলে ৫’-৫’.৫’’ এর উচ্চতার চালকদের জন্য কিওয়ে আরকেএস ১২৫ একটি মানানসই পছন্দ হতে পারে।


এই বাইকটির গিয়ার লিভার কেবলমাত্র একটা যা কিনা সামনের দিকে, আর তা পায়ের পাতা দিয়ে চালনা করতে হয়; হয়তো অনেকের কাছে বিষয়টি কিছুটা ঝামেলার মনে হতে পারে। তবে এর হর্ণটা খুবই দুর্বল। আর এর আরেকটি দুর্বল দিক হলো এর ইঞ্জিনে কোন কিকার নেই।

Also Read: ১.৫ লক্ষ টাকার মধ্যে কিওয়ে বাইক এর দাম | বাইকবিডি September 2023

এছাড়া বাইকটির হ্যান্ডেলবারের উপর বসানো সুইচ-প্যানেলগুলো যথেষ্ট চমৎকার, আর এর স্পিড-মিটারটি এককথায় পরিচ্ছন্ন। মিটার প্যানেলটিতে আপনি পাবেন একটি অ্যানালগ রেভ কাউনটার আর ডিজিটাল স্পিডমিটার ডিসপ্লে। এছাড়াও এতে রয়েছে গিয়ার ইন্ডিকেটর, ক্লক আর ফুয়েল গজ।


বাইকটির পেছনের গ্রাব-রেইলটি বেশ বড়, যাতে করে পেছনের যাত্রী আরামে বসতে পারেন আর প্রয়োজনে তা ধরে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারেন। আর এর সিটও যথেষ্ট সুপরিসর ও আরামদায়ক; দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ সহজেই তাতে বসতে পারবেন।

আর বাইকটিতে একটি উল্লেখ করার মতো নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য রযেছে যা কিনা এর সাইড স্ট্যান্ড নামানো থাকা অবস্থায় বাইকটির ইঞ্জিন চালু হতে দেয়না। অনেক সময় দেখা যায় চালক নিজের অজান্তেই বাইকের সাইড স্ট্যান্ড না তুলেই বাইক স্টার্ট দিয়ে পথে নেমে পড়েন, ফলশ্রুতিতে হয়তো কোন এ্যাক্সিডেন্টের সম্মুখীন হতে হয়, যা এই বাইকে হবার সুযোগই নেই।


ব্রেকিং ও নিয়ন্ত্রনযোগ্যতা:

কিওয়ে আরকেএস ১২৫ বাইকটির সামনের চাকায় হাইড্রলিক ডিস্ক ব্রেক আর পেছনের চাকায় ড্রাম ব্রেক সংযুক্ত। আমাদের মনে হযেছে এর ব্রেকগুলো যথেষ্ট ভালো, আর তা বেশ ভালোভাবেই তাদের কাজ করে। তাই বাইকটির ব্রেক নিয়ে আমাদের কোন ধরনের অভিযোগেরও সুযোগ হয়নি। আর টায়ারগুলোও যথেষ্ট ভালো বিধায় এর নিয়ন্ত্রনযোগ্যতাও চমৎকার। এছাড়াও বাইকটির অন্যতম শক্তিশালী দিক হলো এর চেসিস বা কাঠামো; যেটা আসলেই এর উচ্চ গতিতে কর্নারিং ও ব্রেকিং এ বাইকটিকে চমৎকার ভারসাম্যপূর্ন অবস্থায় রাখতে সাহায্য করে, যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।


বাইকটির অন্যতম আরেকটি ভালো বৈশিষ্ট্য হলো এর সাসপেনশন, যেটা এই বাইকটিকে তার শ্রেনীভুক্ত অন্যান্য প্রতিযোগীদের থেকে আলাদা করে। এর সামনের সাসপেনশন টেলিস্কোপিক যার ডায়ামিটার বেশ মোটা, আর পেছনের দুটো কয়েল-স্প্রিং সম্বলিত। উভয় সাসপেনশনই বেশ প্রতিক্রিয়াশীল ও যথেষ্ট ভালোভাবে কাজ করে। আমাদের মনে হয় ১২৫সিসি ক্যাটাগরীতে কিওয়ে আরকেএস ১২৫ এর সাসপেনশন অনেক উন্নতমানের।

কিওয়ে আরকেএস ১২৫ এর সামনের সাসপেনশন প্রায় ১১০মিমি আর পেছনের সাসপেনশন প্রায় ৬০মিমি পর্যন্ত সঞ্চালিত হতে পারে। আর সাসপেনশন সমূহ এমনভাবে কাজ করে যাতে তা শক ও ঝাঁকুনি গুলো সহজেই সয়ে নেয় আর চাকাগুলোকে রাস্তার উপরই আটকে রাখে; আর লং-রাইডে চালককে কোন প্রকার ঝাঁকুনি অনুভব করতে দেয়না।


কার্যক্ষমতা:

কিওয়ে আরকেএস ১২৫ বাইকটি নিয়ে আমরা একটি জায়গায় খানিকটা হতাশা বোধ করেছি যে বাইকটি দ্রুত গতি তুলতে পারেনা। আমরা এর সর্ব্বেচ্চ গতি তুলতে পেরেছিলাম প্রায় ১০৮কিমি/ঘন্টা পর্যন্ত। আমরা স্পিডওজ এর ব্রোশিওর এ এর ওজনের কোন নির্দেশ পাইনি; তবে কিওয়ে এর ওয়েবসাইটে এর ওজন দেয়া আছে ১২১কেজি। আর আমাদের মনে হয় হয়তো বাইকটির বেশী ওজনের কারনেই বাইকটি বেশি দ্রুত গতি তুলতে পারেনা।


আর আরেকটা বিষয় হলো এর নিম্ন মাইলেজ, যা কিনা একটি ১২৫সিসি বাইকের বিচারে তুলনামুলকভাবে বেশ কম। আমরা ঢাকা শহরের ভেতরে গড়পড়তা ৩৮-৪০কিমি/লিটার মাইলেজ পেয়েছি, আর মহাসড়কে তা ছিল প্রায় ৪৫কিমি/লিটার।

তবে বাইকটির ভালোমানের সাসপেনশন আর টায়ারের কারনে এটা চালানোর অভিজ্ঞতা বেশ রোমাঞ্চকরই ছিল। সেইসাথে ইঞ্জিনের ক্ষমতা আর সার্বিকভাবে বাইকটির কার্যক্ষমতা শহরের রাস্তায় ও মহাসড়কে যথেষ্ট উল্লেখ করার মতোই


বাইকবিডির মূল্যায়ন:

কিওয়ে আরকেএস ১২৫ বাইকটি বর্তমান বাংলাদেশের বাজারে ১২৫সিসি ক্যাটাগরীতে অন্যতম দৃষ্টিনন্দন একটি মোটরসাইকেল নিশ্চিতভাবে বলা যায়। মোটরসাইকেলটির গঠনগত মান আমাদের কাছে যথেষ্ট ভালো মনে হয়েছে। আমরা চেষ্টা করেছি যতটুকু সম্ভব এর বৈশিষ্ট্যগুলো বের করে আনতে। এছাড়াও বাইকটি চালিয়ে দেখার সময়ে আমাদের আরো কিছু বিষয় গোচরীভূত হয়েছিল; চলুন দেখা যাক সেসব থেকে আরো পরিস্কার কিছু ধারনা আপনাদের দেয়া যায় কিনা।

ভালো দিক:

  • বাইকটির সার্বিক গঠনগতমান বেশ ভালো।
  • বাইকটির সাসপেনশন অত্যন্ত ভালো।
  • টায়ারগুলো বেশ ভালো মানের।
  • আধুনিক ও সুন্দর ডিজাইন।
  • আরামদায়ক ও সুপরিসর সিট।
  • রাইডিং পজিশন সবধরনের চালকের জন্য উপযোগী।
  • ১২৫সিসি ক্যাটাগরীতে যথেষ্ট ভারসাম্যপূর্ণ বাইক, আর মহাসড়কে চালানোর জন্যও বেশ ভালো।
  • বাইকটির ব্রেকিং ও নিয়ন্ত্রনযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।

দুর্বল দিক:

  • বাইকটির ইঞ্জিনে কোন কিকার নেই; সকালে স্টাটিং এ মাঝে মাঝে ঝামেলা পোহাতে হয়েছে।
  • গিয়ার লিভারে কেবলমাত্র সামনের বাহু রয়েছে। কমিউটার বাইক হিসেবে বয়স্ক চালকদের সুবিধার জন্য পেছনের বাহুও থাকা প্রয়োজন ছিল।
  • ১২৫সিসি বাইক হিসেবে এর মাইলেজ বেশ কম।
  • বাইকটির দাম একটু বেশি মনে হযেছে আমাদের কাছে। আরো ১০,০০০ টাকা কম হলে ভালো হতো।
  • বাইকের টায়ার টিউবলেস নয়, যা খুবই হতাশাজনক।

তো বন্ধুরা আমরা আমাদের পর্যালোচনার একদম শেষে চলে এসেছি। আমরা কিওয়ে আরকেএস ১২৫ বাইকটির সার্বিক বিচারে মোটামুটি বেশ সন্তুষ্ট। তবে এর দাম আর একটু কম হলে তা বেশ ভালো হতো। আমাদের মনে হয় যারা তাদের প্রাত্যহিক কাজে ব্যবহার করার জন্য একটা ভালো মানের ১২৫সিসি বাইক চান তাদের জন্য এই বাইকটি ভালো একটি পছন্দ হতে পারে। আশা করা যায বাইকটি নিয়ে আপনি খুব ভালোভাবেই আপনার দৈনন্দিন কাজ, অফিস বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া আসা সহ সাপ্তাহান্তে বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়ানো খুব ভালোভাবেই সারতে পারবেন। আমাদের মনে হয় বাইকটি উচ্চগতির বিবেচনায় তৈরি না হলেও আপনি আপনার দৈনন্দিন কাজে এর রাইডিং নি:সন্দেহে বেশ উপভোগ করবেন।