Yamaha Fazer fi v2 ৩০০০ কিলোমিটার মালিকানা রিভিউ - বুলবুল চৌধুরী

This page was last updated on 10-Jul-2024 04:04am , By Saleh Bangla

আমার আগের লেখাটি ছিল বাইক কিনার গল্প, আর আজ আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি সেই বাইকের (Yamaha Fazer Fi V2) ৩০০০ কিলোমিটার পাড়ি দেয়ার আরেকটি গল্প। কথা ছিল ২০০০ কিলোর রিভিউ দিব কিন্তু সময় সাপেক্ষে তা ৩০০০ কিলো তে চলে এসেছে। যাই হোক, ২০১৮ সালের ১২ই এপ্রিল বাকইটি কিনার পর থেকে ৩১শে জুলাই পর্যন্ত প্রায় ৩০০০ কিলো অতিক্রম করেছি। অন্য সব বাইকার ভাইদের মত আমিও বাইকটি শোরুম থেকে বের করার পর খুব যত্ন সহকারে ব্যবহার করতাম। তাহলে চলুন দেখে নেই এই ৩০০০ কিলোমিটার আমি কিভাবে পাড়ি দিয়েছি।

 Yamaha Fazer fi v2 ৩০০০ কি.মি. মালিকানা রিভিউ

Yamaha Fazer Fi V2 - সংযোজনঃ শোরুম থেকে বাইক কিনার পর প্রথম যেটা অনুভব করেছি সেটা হচ্ছে বাইক ও বাইকারের  সিকিউরিটি। ভাবছেন বাইকারের আবার সিকিউরিটি কি? আরে ভাই, এটাই তো সবথেকে গুরুতপুর্ন ব্যাপার। সেজন্য আমি ও আমার পিলিওনের জন্য দুইটা ফুলফেস হেলমেট কিনে ফেললাম। আর বাইকের জন্য একটি হাইড্রোলিক লক, একটি এসিড প্রোফ লক, একটি ওয়্যার লক এবং হোন্ডা কোম্পানির একটি সিকিউরিটি এলার্ম লক। সবশেষে একটি ডাস্ট কাভার কিনে নতুন বাইক নিয়ে বাসায় ফিরলাম। ২/৩ দিন এলাকার ভিতর ও আশেপাশে (মেইন রোড ছাড়া) বাইক চালানোর পর বুঝলাম আরো কিছু জিনিস এ্যড করতে হবে, যেহেতু আমার পার্মানেন্ট পিলিওন (বউ) লেডিস তাই লেডিস ফুট রেস্ট ও সাইলেন্সারের উপর একটি পাদানি লাগিয়েছি যেন সাইলেন্সারে দাগ না পরে। 

 আমিও বাইক কিনেছি আর বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। নতুন বাইকে একটু কাদা লাগলেই কেমন যেনো অসস্তি লাগে, পিছনের টায়ারের উপর হাফ মাডগার্ড থাকার কারনে প্রচুর কাদা-মাটি আটকাতো আর সেই সাথে পিলিওনের জামা-কাপড় নোংড়া হতো। এর জন্য প্রতিদিন বাইক পরিষ্কার করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যেতাম। এর থেকে পরিত্রানের জন্য পিছনের টায়ারের হাফ মাডগার্ড খুলে ফুল মাডগার্ড লাগিয়ে নিলাম সাথে সাথেই। সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো, এখন নিশিন্তে বাইক চালাচ্ছি। কিন্তু সমস্যা যেন পিছু ছাড়ছেই না। AHO সিস্টেমের জন্য সারাক্ষন বাইকের হেডলাইট জ্বলে থাকতো, যদিও ব্যাপারটা সিকিউরিটি ইস্যু কিন্তু আমরা বুঝতে নারাজ। ফেযারের ডাবল হেডলাইটে যখন একটা হেডলাইট সাধারন ভাবেই জ্বলে থাকে তখন ব্যাপারটা দেখতে আরো যন্ত্রনাদায়ক হয়ে উঠে। সব কিছু বিবেচনা করে বাইকের চাপা পরিবর্তন করে ফেললাম, ফলে ডাবল হেডলাইট জ্বলা শুরু করল। এবং ভবিষ্যৎ অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা এড়ানোর জন্য শুধুমাত্র পিছনের চাকায় কুইক ফিক্স জেল দিয়েছি। এখন আর কিছুই বাকি রইলো না, সবকিছুই পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। 

Yamaha Fazer Fi V2 - সংযোজনকৃত যন্ত্রপাতির দামঃ হেলমেট ২টা (ফুলফেস) - ৫০০০/- একটি হাইড্রোলিক লক -   ২৫০/- একটি এসিড প্রোফ লক -  ১২০০/- একটি ওয়্যার লক- ৪৫০/- হোন্ডা কোম্পানির একটি সিকিউরিটি এলার্ম লক- ১২৫০/- ডাস্ট কাভার- ৩৫০/- লেডিস ফুট রেস্ট- ৩০০/- সাইলেন্সারের পাদানি- ২৫০/- ফুল মাডগার্ড- ১৪০০/- চাপা- ৮০০/- কুইক ফিক্স জেল- ৪৫০/- সর্বমোট ১১,৭০০/-- মেকানিক্সের সার্ভিস চার্য বাবদ-১২,০০০/- এর উপরে গিয়েছে |

Yamaha Fazer Fi V2 - যেভাবে মেনটেইন করেছিঃ বাইক কিনার পর থেকে শোরুম থেকে দেয়া ইন্সট্রাকশন ঠিক সময়মত মেনে চলেছি। প্রথম সার্ভিসিং করিয়েছি ১ মাস পর, তখন বাইক ৪৩৫ কিলোতে ছিল। ১ম সার্ভিসেই অর্থাৎ ৪৩৫ কিলোতে ১ম ইঞ্জিন ওয়েল পরিবর্তন করেছি, ২য় টা ১১০০ কিলোতে, ৩য় টা ১৬০০ কিলোতে এবং ৪র্থ টা ২১০০ কিলোতে। এই রিভিউটা লেখা পর্যন্ত বাইক ২৯০০+ চলছে এতে ম্যনুয়েল বুক রিকমান্ডেড YamahaLub 10w40 মিনারেল ইঞ্জিন ওয়েল মোট চার টা ব্যাবহার করেছি। বাইক কখনও রাফ চালাইনি, কখনো ৩ জন উঠায়নি, ট্রাস্ট থেকে অকটেন নিয়েছি এবং প্রয়োজন অনুযায়ী বাইক ওয়াশ করেছি। 

Yamaha Fazer Fi V2 - ব্রেক ইন পিরিয়ডঃ বাইক চালানোর স্টাইল এক একজনের এক এক রকম। ব্রেক ইন পিরিয়ডও সবাই সবার মত মেন্টেইন করে। বেশীরভাগ বাইকার ভাইদের দেখছি ২০০০ কিলো পর্যন্ত ব্রেক ইন পিরিয়ড মেনে চলে। তাই গতানুগতিক ভাবে আমি ২০০০ কিলো পর্যন্ত মেনে চলার পরিকল্পনা করি। কিন্তু বিধি বাম, ৯০০ কিলোঃ চলার পরই বাইক বিরুপ আচরন শুরু করল। বাইক কর্কশ হয়ে গেলো, মনে হচ্ছে পিছন থেকে কেউ টেনে ধরে রেখেছে। ইঞ্জিন সাউন্ড করা শুরু করলো, আগে বাইক চালালে নিজেই কোন সাউন্ড পেতাম না। এখন সেখানে ইঞ্জিন সাউন্ড বেশী হচ্ছে, ঝন ঝন আওয়াজ করছে। 

৩ দিন টানা সার্ভিস সেন্টারে নিয়ে গেলাম এটা ওটা গুতাগুতি করল, কিন্তু কোন সমাধান পেলাম না। নতুন বাইক ২ মাসও হয়নি এখনি এমন অবস্থা, বাইক এতোটাই রাফ হয়েছিল যে বাইকের থেকে মন উঠে গিয়েছিল। এর মধ্যে আমার বাইকের ১১০০ কিলোঃ সম্পন্ন হয়েছে। কিছুদিন পর আবারো সার্ভিস সেন্টারে গেলাম, Yamaha ACI থেকে একজন টেকনিশিয়ান ক্রিসেন্ট সার্ভিস সেন্টার ফলোআপে এসেছিলেন। তিনি আমার সমস্যাটা দেখেন এবং শুধুমাত্র ক্লাচ এডজাস্ট করে সমস্যা অনেকটাই সমাধান করেছেন কিন্তু পুরোপুরি নয়। ৬০ ফিট ক্রিসেন্টের ম্যানেজার মনির ভাই আমাকে আশ্বস্ত করলেন, আপনি পিকআপ বাড়িয়ে বাইক চালান আশা করি আপনার সমস্যা থাকবে না। উনার কথামত ১১০০ কিলোঃতেই ব্রেক ইন পিরিয়ড শেষ করলাম। এরপর থেকে প্রতিটি গিয়ারে বাইককে উচ্চ পিকাপে চালাতে থাকলাম। তারপর বাইক অনেকটাই ফ্রি হয়ে গিয়েছিল।

Yamaha R15 V3 Test Ride Review

বাইক ট্যুরঃ বাইক কিনার পর ব্রেক ইন পিরিয়ড শেষে ঢাকা-ময়মনসিংহ-ঢাকা মোট ৩৪০ কিলোঃ রাইড দিয়েছি পিলিওন সহ। এটাই সবথেকে বড় ট্যুর ছিল। আমি ঢাকায় থাকি, বাবা-মা নারায়নগঞ্জ থাকে তাই মাঝে মাঝে যাওয়া আসা সহ ৫০-৫৫ কিলোমিটার হয়। এছাড়া প্রতিদিনই অফিস-বাসা টুকটাক ১২-১৫ কিলো চালানো হয়। 

Yamaha Fazer Fi V2 - ভালো দিকমাইলেজ (৮/১০) - ঢাকায় থেকে প্রতি লিটারে ৪১-৪২ পাচ্ছি। কম্ফোর্ট (৯/১০) - টানা ১ ঘন্টা চালানোর পরও কোন ধরনের হাত/কোমড় ব্যাথা অনুভব করিনি। কন্ট্রোল (১০/১০) - আমার দেখা ও ব্যবহৃত সবথেকে সেরা কন্ট্রোলিং বাইক হচ্ছে ফেযার। কন্ট্রোলটা ফিল করার ব্যাপার, বলে বোঝানো যায় না। অনেক স্মুথ কন্ট্রোল। ব্রেকিং (১০/১০) – কখনো ব্রেক ধরে কনফিউশনে থাকতে হয় না স্কিড করবে কিনা। মোটা চাকার সাথে ফেযারের এমন ব্রেকিং কম্বিনেশনে ABS এর দরকার হয় না। সাস্পেনশন (৮/১০) – যথেষ্ট পরিমানে ভালো। অফরোডিং করিনি কিন্তু শহরের রাস্তায় বৃষ্টির মৌসুমে যে পরিমান গর্ত সৃষ্টি হয় তাতে কোমড়ে কোন চাপ বা ঝাকুনি অনুভব হয়নি। বাম্পার (১০/১০)- এটা ম্যাজিকের মত কাজ করে। বাইকে সরাসরি কোন মাধ্যম থেকে আঘাত পাওয়া বা বাইক পরে গেলে রাস্তায় ঘসা লাগা থেকে রক্ষা করে খুব ভালো ভাবেই। টপ স্পীড (১০/১০)- পিলিওনসহ ৪র্থ গিয়ারে ১০৪ পেয়েছি। ৫ম গিয়ারে ১১০ তুলেছি কিন্তু রাস্তা ফাঁকা না থাকায় আর স্পীড তুলতে পারিনি। গিয়ার সিফটিং (৯/১০)- অনেক স্মুথ। কিন্তু নিউট্রাল করতে সমস্যা হতে পারে কারন আমার ক্ষেত্রে হচ্ছে অন্যদের হয় কিনা জানিনা।

Yamaha Fazer Fi V2 - খারাপ দিকইঞ্জিন সাউন্ড- সবথেকে খারাপ লেগেছে বেশীর ভাগ সময় ইঞ্জিন থেকে ঝন ঝন শব্দ পাওয়া যায়। গুগল ও ইউটিউব ঘেটে আমি ধারনা করছি, এটা fi এর একটা সমস্যা। আগের ভার্সন গুলাতে এমন ঝি ঝি পোকার সাউন্ড হতো না। যদিও fi এর এই সাউন্ডের সাথে বাইকের পার্ফরমেন্সের কোন সম্পর্ক খুঁজে পাইনি কিন্তু এটা এখনো আমাকে ভোগাচ্ছে।     পিলিওন সীট- হাল্কা ব্রেক ধরলে পিলিওন সামনের দিকে চলে আসে। বেশীক্ষন বসে থাকা যায় না। হেড লাইট- হেডলাইটের আলো অনেক কম। এতো দামী বাইকে এমন হেডলাইট আশা করা যায় না। দাম- সবার সাধ্যের মধ্যে নেই। লুক- এর থেকে এই দামে জিক্সার এসএফ এর শুধুমাত্র লুক বেশী ভালো লেগেছে। স্পেয়ার পার্স- শোরুমে দাম বেশী। বাইরে কম দামে পাওয়া যায় তবে অরিজিনাল কিনা জানিনা।

যা পরিবর্তন করেছি; মোট ২৯০০+ কিলো পাড়ি দেয়ার মাঝে ২৮০০ কিলোতে বাইকের পিছনের ড্রাম ব্রেক-সো নষ্ট হয়ে গিয়েছে। অন্যদের সাথে আলোচনা করে দেখেছি কারোটাই ৮,০০০/১০,০০০ কিলোঃর আগে নষ্ট হয় নাই। ৭৬৫ টাকায় ড্রাম ব্রেক-সো কিনে লাগাতে হয়েছে। মাত্র ৩ মাসে পিছনের ব্রেক-সো চলে যাবে ভাবতেই পারিনি। সার্ভিস সেন্টারঃ ৬০ ফিট ক্রিসেন্ট থেকে বাইকটি কিনেছি। যে কোন সমস্যায় ম্যানেজার মনির ভাই এবং উনার সার্ভিস টিম হেল্প করে থাকে। আমার বাইকের স্মুথনেস ও সাউন্ড সম্পর্কিত ব্যাপারে এখনো শতভাগ কোন সমাধান পাইনি। সার্ভিস সেন্টার থেকে বলা হয়েছে ৪০০০ কিলো পরে টেপেড এডজাস্ট ও fi clean করলে আর কোন সমস্যা থাকবে না। আপাতত সেই আশায় বুক বেধে আছি। 

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাঃ ১) Motul 7100 10w40 ফুল সিনথেটিক ইঞ্জিন ওয়েল কিনে রেখেছি, ৩০০০ কিলো থেকে এই ওয়েল ব্যাবহার করবো। যদি পার্ফরমেন্স ভালো পাই তাহলে এটাই কন্টিনিউ করা। ২) বাইকের স্মুথনেস এর ব্যাপারে সার্ভিস সেন্টারের প্রতি এখনো আশাবাদী, অন্যথায় বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহন। ৩) স্টক হেডলাইটের পরিবর্তে LED ব্যাবহার। ৪) ক্রিসেন্ট থেকেই পেইড সার্ভিস নেয়া। Yamaha কে পরামর্শঃ দাম কমান। সবার সাধ্যের মধ্যে থাকার চেষ্টা করুন। LED হেডলাইট স্টক হিসেবে দেয়ার চেষ্টা করুন এবং সবথেকে বড় জিনিস হচ্ছে fi ইঞ্জিনের ঝন ঝন আওয়াজ বন্ধের সমাধানে ব্যবস্থা নিন। 

সারমর্মঃ  যার দাম বেশী তার গুনগত মানটাও বেশী, শুধুমাত্র fi ইঞ্জিনের ঝন ঝন শব্দ ছাড়া এক কথায় খুবই ভালো একটা বাইক। যতই চালাচ্ছি স্মুথনেস আস্তে আস্তে বেড়েই চলছে। যদি বাজেট থাকে তাহলে কিনতে পারেন চোখ বন্ধ করে। Yamaha দাম বেশী রাখবে অন্যদের তুলনায় কিন্তু আপনাকে ঠকাবে না। সব বাইকেরই ভালো মন্দ দিক থাকে। তবে ফেযারের অনেক কম, নেই বললেই চলে। কথায় বলে “ফেযারের হেটার্স নাই’। সর্বদা হেলমেট পরে বাইক চালান ও আপনার পিলিওনকে হেলমেট পরাতে অভ্যস্ত করান। ভালো থাকবেন সবাই। ধন্যবাদ।    

লিখেছেনমোঃ বুলবুল চৌধুরীICT Developer, UCEP Bangladesh     

আপনিও আমাদেরকে আপনার বাইকের মালিকানা রিভিউ পাঠাতে পারেন। আমাদের ব্লগের মাধ্যেম আপনার বাইকের সাথে আপনার অভিজ্ঞতা সকলের সাথে শেয়ার করুন! আপনি বাংলা বা ইংরেজি, যেকোন ভাষাতেই আপনার বাইকের মালিকানা রিভিউ লিখতে পারবেন। মালিকানা রিভিউ কিভাবে লিখবেন তা জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন এবং তারপরে আপনার বাইকের মালিকানা রিভিউ পাঠিয়ে দিন articles.bikebd@gmail.com – এই ইমেইল এড্রেসে।