মোটরসাইকেলের সিসি কি? সিসি মানেই কি বেশি গতি?
This page was last updated on 13-Jul-2024 02:45pm , By Ashik Mahmud Bangla
সিসি শব্দটার সাথে আমরা সবাই পরিচিত। আমরা যারা বাইক ব্যবহার করি আমাদের মধ্যে সিসি নিয়ে রয়েছে অনেক জল্পনা কল্পনা। বাংলাদেশে এখনো এমন অনেক বাইকার আছে যারা মনে করেন তিনি ১৬৫ সিসির বাইক ব্যবহারের ফলে রাস্তায় সবার আগে থাকবেন। কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলেই এমন? সিসি মানেই কি গতি বেশি?
আপনি যদি সুপার বাইক সম্পর্কে কিছুটা জানেন তাহলে আপনি নিশ্চয় জানেন বাইরের দেশের রাস্তায় যেসব সুপার বাইক চলে তাদের অধিকাংশের টপ স্পীড ৩০০। এমনটাই বা কেনো হয়, সিসির সাথে তাহলে গতির সম্পর্ক কি? আজ আমরা সিসি সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
সিসি হচ্ছে কোন কিছুর মাঝে থাকা কোনো পদার্থের পরিমাণ এর আয়তন এর হিসাব । সহজভাবে বলতে গেলে CC দিয়ে বুঝায় Cubic Centimeters বা ঘণ সেন্টিমিটার। সিসি দিয়ে একটি পদার্থ দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর উচ্চতা মিলে কতটুকু জায়গা নিচ্ছে তার হিসেব প্রকাশ করা হয়।
মোটরযানের ক্ষেত্রে এই হিসেবটা হল ইঞ্জিনের সিলিন্ডারের ধারণক্ষমতা। অর্থাৎ ইঞ্জিনের যে সিলিন্ডার থাকে সব কয়টা সিলিন্ডার মিলে ফুয়েল এর জন্যে মোট কতটা জায়গা দিতে পারে তার হিসেব।
মনে করুন আপনি একটি ১৫০ সিসির ৪ স্ট্রোক বাইক ব্যবহার করেন। এর অর্থ হচ্ছে আপনার বাইকের ইঞ্জিন ১৫০ কিউবিক বা ঘন সেন্টিমিটার ফুয়েল টানতে পারে। অর্থাৎ সিলিন্ডারের প্রতি সেকশনে ফুয়েল টানার ক্ষমতা ১৫০(÷)৪= ৩৭.৫ সিসি বা ৩৭.৫ Cubic Centimeters । এই হিসাবটা ইঞ্জিন ভেদে এয়ার এবং ফুয়েলের মিশ্রনে হয়ে থাকে।
কথাটা একটু ভিন্নভাবে বলতে গেলে সিসি হচ্ছে ইঞ্জিনের সিলিন্ডারের প্রতিবারে ফুয়েল শোষণ করার ক্ষমতা। এই শোষণ করার ক্ষমতা এবং তার ব্যবহার আবার ইঞ্জিনের সিলিন্ডার, এর গঠন, ভেতরে থাকা পিস্টন, পিস্টনের গঠন, আকার, ওজন, সিলিন্ডারের কম্বাশ্চন রেট (Combustion rate) ইত্যাদির উপর নির্ভর করে।
এই ব্যাপারগুলোর উপর এটাও নির্ভর করে যে, একটা ইঞ্জিন কতখানি ঘূর্ণন শক্তি উৎপন্ন করে। এই ঘুর্ণনশক্তির হিসাবকে বলা হয় কিলোওয়াট। কিলোওয়াট হিসাবটকে আবার হর্স পাওয়ার এককে ব্যবহার করা হয়।
হর্স পাওয়ার কি?
আমরা বাইকাররা সবাই হর্স পাওয়ার শব্দটার সাথে খুব বেশি পরিচিত। কিন্তু এই হর্স পাওয়ার সম্পর্কে বিস্তারিত আমরা অধিকাংশ মানুষ জানি না। সিসির সাথে যে হর্স পাওয়ারের একটা সম্পর্ক আছে এটা আমরা সবাই কম বেশি বুঝতে পেরেছি, এবার হর্স পাওয়ার নিয়ে একটু জানা যাক। শক্তি পরিমাপের একক হর্স পাওয়ার বা অশ্বশক্তি। অশ্ব বা ঘোড়ার ক্ষমতা কীভাবে শক্তি পরিমাপের একক হলো, তা নিয়ে অনেক রকম মতামত রয়েছে।
US থিওরি অনুসারে, ১ অশ্ব ক্ষমতা হলো, 33,000 foot-pounds-per-minute, এর অর্থ হচ্ছে, আপনি যদি আপনার ঘোড়াতে ৩৩ পাউন্ড ভর রাখেন এবং ঘোড়াটি যদি ১ মিনিটের মধ্যে ৩৩ পাউন্ড নিয়ে ১০০০ ফুট দুরুত্ব অতিক্রম করতে পারে তাহলে সে ক্ষমতা হলো ১ হর্স পাওয়ার। যদি ৩৩০ পাউন্ড ভরকে ১০০ ফুট নিতে পারে ১ মিনিটে তাও তার ক্ষমতা ১ হর্স পাওয়ার। অতীতকাল থেকে হর্স পাওয়ারের হিসাবটা এভাবেই করা হচ্ছে।
ইঞ্জিনের সিসি কম বা বেশি হওয়ায় ইঞ্জিনে কি কি প্রভাব ফেলে?
ইঞ্জিনে সিসির প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে সবার আগে আমাদের ইঞ্জিনের আরও কিছু বিষয় সম্পর্কে জানতে হবে। সবার আগে আমাদের জানতে হবে ইঞ্জিনের সিলিন্ডার সম্পর্কে। কারণ এর মাঝেই ইঞ্জিনের মূল কাজটা সংঘটিত হয়ে থাকে।
সিলিন্ডার ব্লক হচ্ছে পিস্টনভিত্তীক ইঞ্জিনের হৃৎপিণ্ড। এই সিলিন্ডার ব্লকে কয়েক ইঞ্চি ব্যাসের যে গোলগোল খোপগুলো থাকে তার মাঝেই হয় ইঞ্জিনের সব মূল কার্যক্রম। এই খোপগুলোকেই বলা হয় ইঞ্জিনের সিলিন্ডার।
এই সিলিন্ডারের ভেতরই থাকে পিস্টন। যার ওঠানামার মধ্য দিয়ে আপনার বাইকটি গতি পেতে থাকে। প্রতিটা সিলিন্ডারে মানুষের হৃৎপিণ্ডের মতো ভালব থাকে। যার মধ্যে একটা থাকে ইনলেট ভালভ। এই ভালবটি উন্মুক্ত হলে গ্যাস বা পেট্রোল আর বাতাসের মিশ্র জ্বালানী এর মধ্য দিয়ে সিলিন্ডারে প্রবেশ করে। তখন পিস্টনটি সিলিন্ডারের নিচে নামে। সিলিন্ডারে তখন যত ঘন সেন্টিমিটার জ্বালানী এবং বাতাস প্রবেশ করে সেটাই হল তার সিসি।
পিস্টন আবার উপরে উঠলে জ্বালানী কম্বাশ্চন চেম্বারে প্রচন্ড চাপে কমপ্রেস হয় বা সংকুচিত হয়। তখন সিলিন্ডার হেডের উপরে থাকা স্পার্ক প্লাগ স্পার্ক করলে বা স্ফুলিঙ্গ তৈরি করলে তাতে ভেতরে শুরু হয় বিস্ফোরণ। সেই বিস্ফোরণের চাপে পিস্টন নামে।
তখন অপর ভালভটি খুলে যায় এবং দহন হওয়া জ্বালানী এক্সস্ট আউটলেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ে। এই ভালভসমুহ ইঞ্জিনভেদে এক বা একাধিক হয়ে থাকে এবং এদের ওঠানামা সংঘটিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় এক বা একাধিক ক্যামশ্যাফট দ্বারা যেগুলোকে Single Over Head Camshaft আর Double Over Head Camshaft বলে।
পিস্টনের নীচে থাকা কানেকশন রড দ্বারা এটি নীচের Crankshaft এর সাথে সংযুক্ত থাকে। ফলে পিস্টন ওঠানামা করলে ক্র্যাংকশ্যাফট ঘুরে এবং সেই ঘূর্ণনই কাজে লাগিয়ে গিয়ারের মাধ্যমে আমাদের বাইকের চাকা ঘুরতে থাকে। কিন্তু এই যে ইঞ্জিনে দহন হবার এই প্রক্রিয়া, তা ইঞ্জিনের প্রতি স্ট্রোকে জ্বালানী টেনে নেয়ার ক্ষমতা Compression Ratio এর উপর নির্ভর করে।
কোনো ইঞ্জিন যদি জ্বালানী বেশি টেনে নেয় তাহলে তাতে বিস্ফোরণের ধাক্কাটাও বেশি হয়ে থাকে। ফলে পিস্টনের ওঠানামাও বেশি হবে প্রতি সেকেন্ডে আর Crankshaft এর ঘূর্ণনও প্রতি সেকেন্ডে তুলনামূলক বেশি হবে। চুড়ান্তভাবে ইঞ্জিনটার হর্সপাওয়ার বেশি হবে এবং গতিও হবে বেশি। আর জ্বালানীর ইনটেক রেট মানেই যেহেতু সিসির মাত্রা, তাই এক্ষেত্রে বেশি সিসি বেশি আউটপুট নির্দেশ করে ৷
মূলত এর ফলে ইঞ্জিনের বেলায় CC টা এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমাদের সবার কাছে। কিন্তু শুধু সিসি বেশি থাকলেই যে আউটপুট বেশি হবে এমনটা কিন্তু একদম ঠিক না। অধিক সিসিকে সর্বোচ্চ উৎপন্ন ক্ষমতায় কাজে লাগানোটা ইঞ্জিন পিস্টনের Compression Ratio এর উপর নির্ভর করে।
যেহেতু গোটা ইঞ্জিন চলে বা এত হর্সপাওয়ার নির্ভর করে এর অভ্যন্তরে হওয়া দহনের উপর, আর দহন থেকে উৎপন্ন শক্তি, ধাক্কার পরিমাণ যেহেতু নির্ভর করে জ্বালানীর মাত্রা আর এর সংকোচনের উপর তাই ইঞ্জিন আউটপুটের জন্যে ইঞ্জিনের সিসি আর Compression Ratio, দুটি বিষয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
ইঞ্জিনের বেলাতেও শুষে নেয়া জ্বালানীকে যতটা ভালভাবে কমপ্রেস করা হবে, দহনে তার ধাক্কাটাও তেমনি দুর্দান্ত বেশী থাকবে। এর মানে আপনারা বুঝতেই পারছেন সিসির পাশাপাশি কমপ্রেশন রেটটাও অনেক বেশি জরুরী।
খুব সহজভাবে বলতে গেলে যার হর্সপাওয়ার বেশি তার গতিও বেশি। এই ছিলো সিসি নিয়ে আমাদের আজকের আলোচনা। সুতরাং সিসি নিয়ে আপনাদের যদি কোন ভূল ধারণা থেকে থাকে সেটা আশাকরি এখন দূর হয়ে গেছে। হেলমেট ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রিত গতিতে বাইক রাইড করুন নিজে নিরাপদ থাকুন।
তথ্য সূত্রঃ উইকিপিডিয়া, বিজ্ঞানবর্তিকা