মোটরসাইকেল নিয়ে কেওক্রাডং অভিযান
This page was last updated on 28-Jul-2024 12:05pm , By Saleh Bangla
২০শে ডিসেম্বর ভোর ৬ টায় আমি Sahadat Hossain Bappy ও আমাদের Noakhali Bikers NKB টিমের ২জন জুনিয়র মেম্বার Mahir Afsher Bishal ও MD Mahbubur Rahman সহ ফেনীর উদ্যেশ্যে রওনা হই। খুব ভোর তাই রাস্তা ফাঁকা ছিল, ৪৫ মিনিটের মধ্যেই আমরা সুন্দরভাবে ফেনী পৌঁছে যাই। সেখানে আমাদের জন্য আগে থেকে অপেক্ষমান ছিল ফেনী বাইকার বয়েজের Ariful Hoque Nayan ভাই ও নারায়নগন্জ থেকে আসা বাইকার Nabil Arafat ভাই । সেখানে আর দেরি না করে খালি পেট নিয়ে আমরা ৫ জন ৫ টা মোটরসাইকেল নিয়ে রওনা হয়ে যাই কেওক্রাডং এর উদ্যেশ্যে। পথিমধ্যে বারইয়ারহাট একটি হোটেলে আমরা সবাই হালকা নাস্তার ব্রেক দিই।
মোটরসাইকেল নিয়ে কেওক্রাডং অভিযান
তারাতারি নাস্তা সেরে আমরা আবার বাইকে চেপে বসি ও যাএা শুরু করে সোজা গিয়ে থামি চট্টগ্রাম নতুন ব্রিজ। আমরা একেক জন ছিলাম পুরাই উৎফুল্ল। মনের মধ্যে অনেক উৎসাহ উদ্দিপনা কাজ করতেছিল। নতুন ব্রিজ দাঁড়িয়ে সবাই ২/৪ টা ছবি ও সেলফি তুলে আবার রওনা হই বান্দরবনের উদ্যেশ্যে। এর মধ্যে MD Sifat ভাইয়ের সাথে ফোনে যোগাযোগ হলো। উনি আমাদের জন্য বান্দরবনে অপেক্ষমান ছিলেন। পথে আর কোথাও না দাঁড়িয়ে কেরানীরহাঁট হয়ে আমরা সুসৃঙ্খল ও সুন্দর ভাবে রাইড করে গিয়ে পৌঁছাই নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রে। নীলাচলে মজা করতে করতে কোনখান দিয়ে আমাদের ২ ঘন্টা সময় পার হয়ে যায় বুঝে উঠতে পারি নি।
ঘড়ি দেখে আর দেরি না করে আমরা রওনা হই বান্দরবন শহরের দিকে। সময় তখন দুপুর ২.৩০ মিঃ। ক্ষুধায় তখন পেট সবার চো চো করছিল। Shifat ভাই সহ আমরা সবাই শহরের আমিরাবাদ হোটেলে দুপুরের খাওয়াটা শেষ করে নিলাম তারপর কিছুটা সময় আড্ডা দিলাম । Shifat ভাইয়ের আপ্যায়ন সত্যি কখনো ভুলা যাবে না। অনেক জোরাজুরির পরে ও ভাই খাওয়ার বিলটা শেষ পর্যন্ত আমাদের দিতে দেয় নি। যাক, ইতিমধ্যে আমাদের অনেক সময় পার হয়েগেছে তখন বিকেল ৪.৩০। সূর্য ডোবার আগেই আমাদের রুমা পৌঁছাতে হবে রাস্তাটা অনেক নির্জন। আর দেরি না করে Shifat ভাই থেকে বিদায় নিয়ে আমরা রওনা হই রুমার উদ্যেশ্যে। পাহাড়ি আঁকা,বাঁকা রাস্তা ধরে সন্ধ্যা ৬.৩০ এর দিকে আমরা রুমা বাজার পৌছাই।
রুমা পৌছাতে দেরি হওয়ায় ঔ দিন আমাদের আর সেনাবাহিনী রাতের বেলায় বগালেক যেতে দেয় নি। পড়লাম আরেক বিপাকে রাতে থাকতে হবে রুমায় কিন্তু কোন হোটেলে উঠবো ঠিক করতে পারছিলাম না। তখন আমরা কল দিই আমাদের গাইডকে। গাইডের নাম ছিল রাসেল ছেলেটা অনেক ভালো। গাইডের ব্যপারে Daulat DK ভাই আমাদের সাহায্য করেছিল এবং আগেই তার নাম্বার আমাদের দিয়ে দিয়েছিল তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ দৌলত ভাইকে। গাইড রাসেল এসে আমাদের রুমা বাজার থেকে রিসিভ করে নিয়ে গেল হোটেলে। আমরা উঠেছিলাম সাঙ্গু রিভার ভিউ হোটেলে।। নদীর পাড়ে হোটেলটি। মোটামুটি কোন রকম চলার মত। এত খারাপ ও না। একরাত কোন রকম কাটিয়ে দিলাম সেখানে।
পরদিন (২১-১২-২০১৮) ভোর ৬ টায় আমরা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে আমাদের গাইড সহ সকাল ৮ টার আগেই চলে যাই রুমা বাজার আর্মি ক্যাম্প ও রুমা থানায় ওখান থেকে বগালেক পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি নিয়ে সকল কাজ সম্পুর্ণ করি এবং ৯ টায় রওনা হই বগালেকের উদ্যেশ্যে। বগালেক পৌছানোর আগেই পড়ি আমরা আরেক বিপাকে। খুব সুন্দর রাস্তা আঁকাবাঁকা,খাঁড়া দু দিকে পাহাড় আর পাহাড় বেয়ে যাচ্ছিলাম। বগালেক পৌঁছানোর আগের খাড়া টায় আমাদের (মাহবুব এর) একটা মোটরসাইকেল এর চেইন লক ছুটে যায় এবং কাত হয়ে পড়ে যায়। ভাগ্য ভালো ছিল রাইডারের কোন কিছুই হয় নি। যন্ত্রপাতি সাথে করে নিয়ে যাওয়ায় তারপর কোন মতে চেইনটা ঠিক করে আমরা বগালেক পৌঁছি ও সেখানে বাইকটা রাখি।
মোটরসাইকেল এর সমস্যার কারনে ইতিমধ্যে আমাদের সবাই অনেক এনার্জি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বগালেক পৌছে সেনা ক্যাম্পের সামনে দোকানটায় ক্যালসিয়ামের চা খেয়ে সবাই নিজেকে একটু সতেজ করলাম। তারপর আমাদের সামনে আসলো আরেক বাঁধা। বগালেক থেকে কেওক্রাডং যাওয়া যাবে না মোটরসাইকেল নিয়ে। গত (১৮-১২-২০১৮) ইং থেকে এ আদেশ কার্যকর। মনটা অনেক খারাপ হয়ে গেল শুনে। এতদূর থেকে এসে এভাবে খালি হাতে ফিরে যেতে হবে তা মানতে পারছিলাম না। আমরা থাকা অবস্থায় অনেক বাইকার ভাইরা এসে কেওক্রাডং এর অনুমতি না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে। সবার চোখে মুখে হতাশা। আমরা ও বসে আছি মন খারাপ করে সেনা ক্যাম্প এর সামনে চা দোকান টায়।
আর সবাই মিলে ভাবছিলাম কি করা যায় কি করা যায়। ঠিক তখনি আমাদের Nabil ভাই ও Nayan ভাই বলে আমরা গিয়ে দেখি কি করা যায়। গিয়ে কথা বলতে থাকলো ওখানকার দায়িত্বে থাকা সেই সেনা অফিসারের সাথে। তাদের সরাসরি একটাই কথা যাওয়া যাবে না উপর থেকে নির্দেশ, রাস্তার কাজ চলছে। আগে কয়েকটা বাইকার টিম গিয়ে বিপদে পড়েছে পরে সেনা অফিসাররা গিয়ে উদ্ধার করে এনেছে। এখন তারা আর রিস্ক নিতে চায় না। আমাদের গাইড ও সুপারিশ করলো কিন্তু তারা বলছে হবে না। আমাদের সুপারিশে কোন মতেই কাজ হচ্ছিল না। ঠিক তখন মাথায় আসলো আমাদের নাবিল ভাইয়ের পরিচিত একজন মেজর এর কথা। উনার রেফারেন্স দিলাম। ফোন দিয়ে কথা বলিয়ে দিলাম তবু ও নাকি হবে না। এর পর শুরু হলো আমাদের ইমোশনাল ব্লাকমেইল।
সবাই মিলে গেলাম আবার সেই অফিসারের কাছে। রিকোয়েষ্ট এর একপর্যায়ে একটু নরম হলেন তিনি। দুদিন আগে বৃষ্টি হয়ে পুরো পথ কাঁদা ও পিচ্ছিল হয়ে আছে আমাদের যেতে দিব তবে রিস্ক তাদের না। আমরা গেলে লিখিত নাদাবি দিয়ে যেতে হবে। এ কথা শুনে আমাদের মনে আশার আলো ফুটলো। সবাই যেন আবার প্রান ফিরে পেলাম।। নাদাবি দিলে দিব তবু ও আমরা যাব। তারপর লিখিত দিয়ে আমরা অনুমতিটা নিয়ে ওই নষ্ট হয়ে যাওয়া মোটরসাইকেলটা সেনা ক্যাম্পে রেখে ৪ টা মোটরসাইকেল নিয়ে গাইড সহ আমরা ৬ জন আল্লাহর নামে যাএা শুরু করলাম। সবার মনে খুব আনন্দ অবশেষে যেতে পারছি। ৫ মিনিট পর আমাদের আনন্দটা ভয়ে পরিনত হলো।
প্রথম খাড়া টা শুকনা ছিল তাই মোটরসাইকেল এর কষ্ট হলে ও সুন্দর ভাবে পার হয়ে গেলাম। তারপর থেকে শুরু কাঁদা মাটির খেলা। পুরা রাস্তা কাঁদা ও পিচ্ছিল তার উপর খাঁড়া। রাস্তার মধ্যে যায়গায় যায়গায় পানি জমে আছে । মোটরসাইকেল এর সর্ব শক্তি দিয়ে ও উপরে উঠা যাচ্ছে না। স্লিপ করে নিচে নেমে আসছে বার বার প্রতিটা খাঁড়ায় আর চাকা ফ্রি ঘুরছে। সবাই মিলে ধাক্কা দিয়ে, ধরে ধরে একটা একটা করে মোটরসাইকেল উপরে উঠিয়ে আবার নিচে নেমে আসছিলাম। শরীরের সব শক্তি যেন ফুরিয়ে আসছে। তখন মনে শুধু একটাই কথা আসছিল সেনাবাহিনীরা আসলে আমাদের ভালোর জন্যই যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। শুকনার সময় সমস্যা নেই, বৃষ্টি হয়ে পুরো পথ কাঁদা হওয়ার সমস্যাটা তৈরী হয়েছে। যাক ২.৩০ ঘন্টা যুদ্ধ করে আমরা কোন রকম বাইকের ও শারীরিক সমস্যা বা বিপদ ছাড়াই আল্লাহর রহমতে কেওক্রাডং পৌছালাম।
সবাই অনেক টায়ার্ড কেওক্রাডং এর এখানে মালিক লালা বম এর ওখানে তারাতরি কটেজ ঠিক করে আমরা উঠে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে ঘুরতে বের হলাম কেওক্রাডং। এদিন সেদিক ঘুরাঘুরির পর যখন আমরা চূড়ায় মোটরসাইকেল উঠাতে চাইলাম তখন ওখানের ক্যাম্পের সেনাবাহিনীরা আমাদের বলে সব মোটরসাইকেল উঠানো যাবে না। ৪ টা বাইকের মধ্যে ২টা উঠাতে পারবেন শুধু। হয়ে গেল মন খারাপ ৪ টা এসেছি ২ টা উঠিয়ে কি করবো। পরে তাদের অনেক রিকোয়েস্ট করে ৪ টা মোটরসাইকেল ই উঠাতে সক্ষম হই এবং ৩০ মিনিট সময় নিয়ে কিছু ছবি তুলে মোটরসাইকেল গুলো নামিয়ে আমরা রাত ১০ টা পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে রাতে কটেজে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ি।
পরের দিন (২২-১২-২০১৮) তারিখ আমরা সবাই কেওক্রাডং থেকে ব্যাক করি। উঠাটা যেমন কষ্টকর ছিল কাঁদার মধ্যে নামাটা ও তারচেয়ে কষ্টকর। ইন্জিন ব্রেক দিয়ে, সামনে পিছনের ব্রেক ধরে ও গাড়িকে থামিয়ে রাখা যায় না। প্রতিটা বাইক টেনে ধরে ধরে নামাতে হয়েছে। এভাবে করেই ১.৫০ ঘন্টার মধ্যে আমরা বগালেক নেমে এলাম। বগালেক থেকে এন্ট্রি আউট করে এলাম রুমায়। রুমাতে ও এন্ট্রি আউট করে চলে এলাম সুন্দর ভাবে বান্দরবন। আবার হলো Shifat ভাইয়ের সাথো দেখা। বান্দরবনে হালকা নাস্তা করে চলে এলাম একটানে চট্রগ্রাম নতুন ব্রিজ। সেখানে অপেক্ষায় ছিল রাঙ্গুনিয়ার লিজেন্ড Ahasan Habib ভাইরা। উনাদের সাথে কিছুসময় চা আড্ডা দিলাম, অনেক ভালোলাগলো। তারপর রাত ৯ টায় চট্টগ্রাম থেকে রওনা হয়ে ১১.৩০ এ আমরা সবাই যার যার বাসায় পৌছে যাই।
চলে আসার পর খুব মিস করছিলাম কেওক্রাডং এর ভয়ানক সেই সুন্দর্য কে। এই ট্যুরটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে স্বরনীয় ও রোমাঞ্চকর ট্যুর। ভয়, আবেগ, ভালোলাগা, সৌন্দর্য, শারীরিক কষ্ট কোন কিছুরই কমতি ছিল না। এই ট্যুরে আমার সকল সফর সঙ্গীকে জানাই অনেক অনেক ধন্যবাদ। সবার টিম ওয়ার্কের ফলে এত বাঁধা বিপত্তির পর ও আমরা সফল ভাবে কোন সমস্যা ছাড়া সুন্দর ভাবে ট্যুরটা সম্পুর্ণ করে ফিরতে পেরেছি। যা আমাদের কারোরই একার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ধন্যবাদ নয়ন ভাই, নাবিল ভাই, ছোট ভাই মাহির ও মাহবুব আপনাদের। ধন্যবাদ Daulat DK , Md Sifat ও Ahasan Habib ভাইকে। ধন্যবাদ গাইড রাসেল তুমি ও অনেক কষ্ট করেছ।
আরেকটা কথা, যারা বাইক নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করছেন, বা যাবেন বা যেতে চান তারা গাইড রাসেলকে নিয়ে যেতে পারেন। ছেলেটার ব্যবহার অনেক ভালো। আর লেখায় ভূলত্রুটি থাকলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন সবাই। সবাই মোটরসাইকেল চালানোর সময় হেলমেট ব্যবহার করবেন এবং সেফটি গার্ড ব্যবহার করবেন। ধন্যবাদ।
লিখেছেনঃ Sahadat Hossain Bappy