ঢাকা টু পতেঙ্গা, কক্সবাজার, টেকনাফ ট্যুর - তানভীর
This page was last updated on 08-Jul-2024 11:09pm , By Shuvo Bangla
হ্যালো, আমি তানভীর। পড়াশোনা শেষ করে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করছি। ছোটবেলা থেকেই আমি বাইক ভালোবাসি আর ভালোবাসি বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। নিজেকে একজন ‘বাইক ট্রাভেলার’ হিসেবে পরিচয় দিতে ভালো লাগে। আমার বাইক নিয়ে সারাদেশ ঘোরার পরিকল্পনা রয়েছে আর তা শুরু করি দেশের সর্বদক্ষিণ উপজেলা টেকনাফ থেকে। আমি আর আমার ভাই নাহিদ দু’জন মিলে আমার বাইক কিওয়ে আরকেএস ১০০ ভি১ দিয়ে ঢাকা টু পতেঙ্গা-কক্সবাজার-টেকনাফ ট্যুর দেই।
১ দিনে সর্বোচ্চ ৪৭৫ কি.মি আর ৪ দিনে মোট ১১২৫ কি.মি.-এর ট্যুর সম্পন্ন করি। এই ট্যুরের মাধ্যমে আমাদের অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে এবং অনেককিছু শিখতে পেরেছি। ট্যুরে যাওয়ার সময়কার আদ্যপান্ত নিয়ে আমার এই লেখা।
ঢাকা টু পতেঙ্গা, কক্সবাজার, টেকনাফ ট্যুর - ভ্রমন অভিজ্ঞতা
বাইকে করে কক্সবাজার যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম সেই ২০০৮-এ, যখন আমার বাইক-ই ছিলোনা। এক কলেজমেটের কাছে ওর বন্ধুদের নিয়ে ট্যুরের কথা শুনে আমার চোখে দৃশ্যটি ভেসে উঠেছিলো। পরবর্তী ৮বছর সেটি আমার চোখে ভেসে বেরিয়েছে-পাগল করেছে। ২০১৫ সালের মার্চে বাইকটি কিনেই প্রস্তুতি শুরু করি- ১০০, ২০০, ৩০০+ কি.মি. ডে লং ট্যুর দিয়ে শরীরের স্ট্যামিনা বাড়িয়ে নেই।
র্যুট স্টাডি করে রাইডের লক্ষ্য আরেকটু বাড়িয়ে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ করি। ১ বছর প্রস্তুতির পর ২০১৬ সালের মে-তে অফিস থেকে ১ সপ্তাহের ছুটি নিলাম, কো-রাইডার হিসাবে খালাতো ভাই নাহিদ হাসানকে নিলাম, বাইক সার্ভিস করালাম, ব্যাগেজ গুছালাম তারপর বুম!
১০ মে- ট্যুরের আগের রাতে কখনোই আমার ঘুম হয়না আর এবার তো আমার বাইকিং জীবনের প্রথম স্বপ্নের ট্যুর। উত্তেজনায় রাতে মাত্র ৩ ঘন্টা ঘুমিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করি সকাল ৭টায়, মুগদা থেকে। কাচপুর ব্রীজ পার হয়ে নারায়ণগঞ্জের সুগন্ধা হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে আমরা প্রথম বিরতি নেই, নাস্তা সেরে আবার রওনা করি। মুন্সীগঞ্জ পার হয়ে, মেঘনা ব্রীজ পার হয়ে, দাউদকান্দি ব্রীজ; এরপরেই মুলত মজার রাস্তা শুরু।
৪ লেনের ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতে বাইকের থ্রটল ঘুরিয়ে দিলাম, একটানে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে চলে এলাম। আমাদের প্রিয় রেস্ট পয়েন্ট কফি হাউজে বসলাম। ভীষণ পিপাসা লেগেছিলো, ফ্রেশ মাল্টার জ্যুসটি পৃথিবীর সেরা পানীয় মনে হলো! কুমিল্লার পর আমরা ব্রেক নেই ফেনীর মহীপালে। ফ্লাইওভারের কাজের জ্যাম ঠেলে বাস স্ট্যান্ডের একটি হোটেলে ঢুকে লাচ্ছি খেলাম।
ফেনী থেকে রওনা করে আমরা বেশ বোর ফিল করছিলাম, দেখার মতো তেমন কিছু ছিলো না। হঠাৎ দৃশ্যপট চেঞ্জ হয়ে গেলো-রাস্তা হয়ে গেলো পীচ কালো মসৃণ আর দু’পাশের গাছপালা হয়ে গেলো গাঢ় সবুজ। কলাগাছের আধিক্যই বলে দিলো আমরা চট্টগ্রাম ঢুকে গেছি-আমাদের এনার্জি চলে এলো। একটু পড়েই চোখে পড়লো সীতাকুণ্ড পাহাড়! অনেক বছর পর পাহাড় দেখলাম। দুরপাহাড়ের নীলাভ সবুজ রঙে আমরা মুগ্ধ হলাম। একটি খোলা জায়গা দেখে বাইক থামিয়ে বসে পড়লাম, নীরবে কিছুক্ষণ উপভোগ করলাম এর বিশাল সৌন্দর্য...।
চট্টগ্রামের প্রতিটি থানা বিশাল, ঘন্টা লেগে যায় পার হতে। গ্রীষ্মের গরম বাতাসে হাই স্পিডে চলা বাইকেও প্রতিমুহূর্তে ঘেমেছি। একটু পর পর পানি খেয়েছি অথচ টয়লেট চাপেনি! বাজার দেখলেই সাইনবোর্ডে এলাকা চেক করি, মাঝে মাঝে মনে হতো এক এলাকা বুঝি শেষ-ই হবেনা। নতুন এলাকায় আসলেই আবার এনার্জি পাই। এভাবে একের পর এক এলাকা পার হয়ে আমরা চট্টগ্রাম পোর্ট লিংক রোডে এসে পৌছলাম। এই রাস্তাটি দেখে মনে হলো আমাদের কষ্ট সার্থক। পীচকালো মস্রিন রাস্তা, সুবিন্যস্ত গাছের সারি আর সেটা ভেদ করে উঁকি দেয় সাগর! এই রাস্তা ধরে চলে গেলেই পতেঙ্গা, একটু একটু করে গন্তব্যের কাছে পৌছানো আর অবাক হওয়ার যে কি অনুভুতি!!
চট্টগ্রাম পোর্ট দিয়ে শহরে ঢুকলাম, শহরটাকে প্রথম ভালোভাবে দেখলাম। ঢাকার মতোই আধুনিক অবশ্য ঢাকার মতো জ্যামও আছে! জ্যাম ঠেলে আমরা পতেঙ্গা সি বীচ পৌছলাম। ব্লক ফেলা ছোট্ট বীচ দেখে আমাদের আশাভঙ্গ হলো। অনেকের কাছেই এমনটি শুনেছিলাম কিন্তু যেহেতু একটি ট্যুরিস্ট প্লেস সেহেতু লাইফে অন্তত একবার যাওয়া উচিত-এটি ভেবেই গিয়েছিলাম!!
সারাদিন পানি খাওয়ায় ক্ষুধা বলতে কিছু অনুভব করিনি, শুধু আঙ্গুরের জ্যুস খেলাম! প্ল্যান ছিলো পতেঙ্গায় রাত কাটানোর কিন্তু সূর্যাস্ত উপভোগ করতে করতে ভাবছিলাম- মন ভরলো না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ওইদিনই কক্সবাজার চলে যাবো। গোটা কয়েক ছবি আর সেল্ফি তুলে যাত্রা শুরু করলাম...।
সিদ্ধান্তটি কতো বড় ভুল ছিলো তা টের পেলাম চট্টগ্রাম পার হতে গিয়ে। খাতুনগঞ্জের কানা গলিতে বার বার রাস্তা হারাচ্ছিলাম, গুগল ম্যাপেও কুলাচ্ছিলো না। জিজ্ঞেস করে করে ভুল-সঠিক-ভুল রাস্তা হয়ে কর্ণফুলী নদীর শাহ আমানত সেতুতে এসে পৌছালাম। রাত বাজে ৯টা অথচ রাস্তা বাকি ১৪৯কিমি! কিন্তু পথে যখন নেমেছি তখন এর শেষ দেখেই ছাড়বো ভেবে রওনা দিলাম।
রাতের বেলা দুই লেনের ব্যস্ত হাইওয়েতে চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। টানা দুইঘন্টা চালানোর পর যখন দেখি এখনও ১০০+ কি.মি. বাকি তখন মনে হচ্ছিলো এই রাস্তা বুঝি আর ফুরাবেনা। ঘুমহীন শরীরে, সারাদিন রোদ মাথায় রাইড করে আমরা আর পারছিলাম না-মনের জোরে দেহ চালাচ্ছিলাম!!
রাত ১২টা, সাতকানিয়ার কেরানীহাট ত্রিরাস্তা। ডিরেকশনবোর্ড-এ চট্টগ্রাম / বান্দরবানের সাথে ‘কক্সবাজার’ নামটা দেখে মনে হলো আমরা হয়তো পারবো! এরপর রাস্তা আর পরিবেশ সুন্দর হয়ে গেলো। জনবসতীহীন, অন্ধকার, জঙ্গল আর পাহাড়ের মাঝে আঁকা-বাঁকা, উঁচু-নীচু রাস্তাটি ছিলো রোমাঞ্চকর!! ইয়ারফোনে গান লাগিয়ে, ক্রুইজিং স্টাইলে বসে নতুন উদ্যমে বাইক টানছিলাম। তবে এই পর্যায়ে এসে বাইকের স্মুথনেস চলে গেলো। ব্যস্ত হাইওয়েতে ব্রেক ছাড়া চালানোর কারনে সম্ভবত ইঞ্জিন ওয়েলের থিকনেস কমে গিয়েছিলো। যদিও আমি ফুল সিন্থেটিক ওয়েল মবিল-১ ব্যবহার করি, তবুও আমি সন্তুষ্ট ছিলাম কারন এমন পরিবেশে ৪৫০+/- কি.মি. চালানোর পর এটি হতেই পারে।
রামু ত্রিরাস্তার ডিরেকশনবোর্ড-এ কক্সবাজারের ডিরেকশন দেখে পুরোপুরি বিশ্বাস হলো যে আমরা আজ পৌছাতে পারবো! কিছুক্ষণ পর পাশ কাটানো বাসের গায়ে, পার হয়ে যাওয়া দোকানের সাইনবোর্ডে কক্সবাজার নামটা যেন জ্বল জ্বল করে উঠলো, বুঝলাম কক্সবাজারে ঢুকে গেছি!!
এরপর মোহরীপাড়ায় ফাইনাল ডিরেকশন দেখে খুশির সীমা রইলো না, বুঝলাম কলাতলীর কাছাকাছি এসে পড়েছি। আর সইলো না-বাইক থেকে নেমে পড়লাম, বাইকিং লাইফের এই চরম মুহূর্তে প্রবেশের পূর্বে একটু দম নিলাম, পেটে কিছু পানি চালান করলাম, শেষ বারের মতো বাইক হাতবদল করলাম। এরপর কিছুদূর এগিয়ে বিশাল একটি ঢাল বেয়ে নামতেই কক্সবাজার কলাতলী পয়েন্ট!!!
রাত ২টা, কলাতলী পয়েন্ট। সব হোটেল বন্ধ (লাক্সারিয়াস হোটেল বাদে)। কাউকে জিজ্ঞেস করে কোন ফল পাচ্ছিনা। ভাবছি সারারাত ব্যাগেজ নিয়ে সি বীচে-ই কাটাতে হবে কিনা! অবশেষে একজন নাইটগার্ড একমাত্র খোলা হোটেলটি দেখিয়ে দিলো। ডায়নামিক রিসোর্ট-২৪ঘন্টা এবং ভালো মানের হোটেল। আমাদের মন আশার আলো দেখলো। ঝটপট সিঙ্গেল বেডের ১টি এসি রুম বুক করে ফেললাম, পার নাইট ১০০০ টাকা। আমাদের হাতে কোন অপশন ছিলোনা নাহলে অফসিজন হিসাবে আরো কমাতে পারতাম হয়তো।
রুমে ঢুকেই আমরা হাসলাম, আনন্দের হাসি, পাগলামির হাসি; বিশ্বাসই হচ্ছিলো না যে আমরা বাইকে করে ঢাকা থেকে কক্সসবাজার চলে আসছি!! ভীষণ নোংরা হয়ে গিয়েছিলাম। ধুলা-ঘাম মিলেমিশে চামড়ার ওপরে লেয়ার পড়ে গিয়েছিলো আর জামা-কাপড়ের কথাতো বাদই দিলাম! লম্বা সময় ধরে আরামের গোসল সারলাম, ময়লা জামা-কাপড় ওয়াশ করতে দিলাম। তারপর ডিনার করতে বেরোলাম (এড্রিনালিন রাশের কারনে আমাদের তখনো পর্যন্ত ঘুম পায়নি)।
বাসস্ট্যান্ড পাশেই তাই এখানকার অধিকাংশ রেস্টুরেন্টই ২৪ ঘন্টা খোলা। আমরা কলাতলী রেস্তোরায় বসলাম। শুটকি ভর্তা, রূপচাঁদা মাছ আর ডাল দিয়ে উদরপূর্তি করলাম। কফি খেয়ে, পেট হাতিয়ে, ঢেকুর তুলতে তুলতে ভাবলাম এতো কষ্টের পর এখন সাগর না দেখলে ঘুম আসবে না। আবারো যেই ভাবা সেই কাজ, সি বীচের দিকে রওনা দিলাম।
রাত বাজে ৩টা, চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। কলাতলী পয়েন্টে এই প্রথম আসলাম, রাস্তা-ঘাট কিছুই চিনিনা। মোবাইলের ফ্ল্যাশের আলোও খুব একটা কাজে আসছে না, কেবলমাত্র ধারনার ওপরে হাঁটছিলাম। এভাবে কিছুদূর এগুনোর পর সাগরের গর্জন প্রথম যখন কানে এলো তখনকার অনুভুতি ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়-ড্রিম ইস বিকামিং ট্রু!
পায়ের নীচে বালু চলে এলো, স্যান্ডেল খুলে হাতে নিলাম। বালুর উপর কাঁটালতা বেছে হাঁটতে হাঁটতে বীচে চলে আসলাম। ঠান্ডা বাতাস, ভেজা বালু, পানির স্রোত, পায়ের নীচের বালু একটু একটু করে টেনে নিয়ে যাওয়া...কালিগোলা অন্ধকারে আমরা সমুদ্র দেখতে পাচ্ছিনা কিন্তু পুরোপুরি অনুভব করছি-অপার্থিব অনুভূতি!!
সন্ধ্যার পর কখনো সী-বীচে থাকিনি তাই নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। জীবনতো একটাই তাই রিস্ক নিয়েই ছবি আর সেল্ফি তুলতে শুরু করলাম। আলো দেখে কেউ একজন লাইট নিয়ে এগিয়ে আসছে সাথে দুইটা কুকুর, ভয় পাচ্ছি...কাছে আসার পর জানতে পারলাম সে নাইটগার্ড। সারারাত এই পয়েন্ট পাহারা দেয় আবার পেছনে পুলিশ ফাঁড়ি খেয়াল করলাম; দেখে-শুনে আমরা নিরাপদ ও স্বস্তি অনুভব করলাম। দু’জন চেয়ারে গা এলিয়ে রাতের নিস্তব্ধতায় সমুদ্রের গর্জন আর উদ্দাম হাওয়া উপভোগ করলাম। হোটেলে ফিরতে ফিরতে সুবহে সাদিকের পাখির ডাক শুনে বুঝলাম ভোর হতে চলছে, ঘরির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় ৪টা বাজে!
রুমে ঢুকে ঝটপট শুয়ে পড়লাম। ১১ মে- ১ ঘুমে সকাল গড়িয়ে দুপুর ১২টায় উঠলাম। ফ্রেশ হয়ে নীচে নেমে ওই হোটেলেই গরুর কলিজা, ডাল আর নান দিয়ে নাস্তা করলাম। দু’জন দু’টি ব্রেভার খেতে খেতে বীচে গেলাম। দিনের আলোয় আমাদের চোখে ধরা দিলো বঙ্গোপসাগর। যতদূর চোখ যায় হালকা সবুজ পানি আর বীচের কিনার ধরে পাহাড়-ঝাউবন। প্রায় ৭ বছর পর এলাম আর আমার ভাই জীবনে প্রথম আর বাইক রাইড করে দু’জনেই প্রথম। তাই দু’জনেই আনন্দে আর গর্বে আত্নমগ্ন হয়ে গেলাম।
দু’টি সীট ভাড়া করলাম, দু'জন কোন কথা না বলে ঘন্টা ধরে উপভোগ করলাম সাগর। সাগরের স্বাতন্ত্র্য ব্যাপারটি হচ্ছে এটি প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তনশীল, তাই যতোই দেখা হোক বোর লাগেনা! গতদিনের রাইডের ধকল শরীরে ছিলো তাই পানিতে নামার কোন ইচ্ছা না থাকলেও একসময় না পেরে নেমেই গেলাম। গতবার সাতরে সাগরের ভেতরে অনেকটা গিয়েছিলাম কিন্তু এবার ভাঁটার সময় ঘনিয়ে আসায় আর রিস্কে গেলাম না, তীরের কাছেই সাঁতরালাম। লাফালাফি, ঝাপাঝাপির ছবি ফোটোগ্রাফার দিয়ে তুলিয়ে নিলাম। প্রতি ছবির সফটকপি ৫টাকা তাও অনেক মুলামুলি করে, সেই ব্যবসা!
জলকেলি শেষে পায়ে ফোসকা পরা গরম বালুতে হেঁটে হোটেলে পৌছে গোসল করলাম। আগের হোটেলেই ভাত, খাসীর মাংস, ডাল দিয়ে জম্পেশ লাঞ্চ করলাম। লাঞ্চের পর মিরিন্ডা খেয়ে হোটেলে ফিরে অবসন্ন শরীরে ফেসবুক আপডেট করতে করতে চোখ লেগে গেল...।
সন্ধ্যায় বেড়িয়ে কক্সবাজার শহরটি ঘুরলাম, ছোট একটি শহর। পর্যটন শহর হওয়ার পরও তেমন উন্নত নয়। আব্দুল গনি রেস্তোরায় ভাত, শুটকি ভর্তা, গলদা চিংড়ি আর ডাল দিয়ে ডিনার করলাম। খাবারের মান, পরিবেশ, পরিবেশন সবই ভালো আবার দামেও সস্তা। এখানকার সব হোটেল সম্পর্কেই মোটামুটি এমনটা বলা যায়। অবাক হলাম যে এখানে মুল খাবার হচ্ছে ভাত।
বিরিয়ানী, কাচ্চি এসবের সাথে এদের পরিচয় নেই, ফাস্টফুডের দোকানও রেয়ার! যাইহোক যেখানে যেরকম, সেখানে সেরকম থাকাই আমরা প্রেফার করি তাই আমরা এঞ্জয় করেছি। তবে মিস করেছি সামুদ্রিক খাবার; বিজি শিডিউলের কারনে আমরা এটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম!! ডিনার শেষে সেটি হজম করার জন্য চলে গেলাম লাবনী পয়েন্টে। পয়েন্টটি সুন্দর (আগেরবার এখানেই উঠেছিলাম)।
ভালো ভালো হোটেল, মার্কেট আর রেস্টুরেন্ট দেখে ভালো লাগলো। এখানেও পুলিশ ফাঁড়ি রয়েছে আর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো জোরদার মনে হলো। সী-বীচে লোকজনের সংখ্যাও তুলনামূলক বেশী, নারীরাও স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করেছে।
তবে এডভার্টাইসের জন্য জায়ান্ট স্ক্রিন খুবই বিরক্ত লেগেছে। বীচে বসলে আলো পেছন থেকে এসে রাতের সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয়। প্রকৃতিকে যথাসম্ভব তার নিজের রূপে রেখে তারপর বিনোদন-ব্যবসার কথা চিন্তা করা উচিত। বীচে বসে সাগরকে উপভোগ করার পরিবর্তে সানসিল্কের বিজ্ঞাপন নিশ্চয়ই ভালো লাগার কথা নয়!
লাবনী থেকে কলাতলী ব্যাক করলাম, রাস্তাটা সুন্দর তবে সরু। কক্সসবাজার দিনকে দিন ডেভেলপ করছে, খুব দেরী নেই এই রোডের জ্যামের কথা শোনার। যাহোক, হোটেলে ফিরে জলদি জলদি শুয়ে পরলাম। আগামীকাল যাবো টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ (বাংলাদেশের মূল ভূখন্ডের সর্বদক্ষিণ প্রান্ত)। ওহ বাইকের কথা বলতে ভুলেই গেছি-সকালে বাইকটা স্টার্ট দিতেই ইঞ্জিন ওয়েলে পূর্বের মতো স্মুথনেস পেয়েছিলাম আর পরিমানেও কমেনি।
মবিল ১'র প্রেমে পরে গেলাম! বাইকে বিন্দুমাত্র সমস্যাও দেখা দেয়নি, তবুও ওয়ার্কশপে নিয়ে চেক করিয়েছিলাম, সবকিছু ঠিক আছে কিনা। ঠিক-ই আছে, এমনকি চেইন টাইট দেয়ার প্রয়োজনও পড়লো না, বাইকেরও প্রেমে পরে গেলাম! ১২ মে- আমরা দু’জনেই আরামপ্রিয়, রিল্যাক্সে ঘোরাঘুরি করাই আমরা পছন্দ করি। তাই আজকেও ঘুম থেকে বেলা করে উঠলাম, ফ্রেশ হলাম। গুগল ম্যাপে রুট দেখে, প্ল্যান করে টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম বেলা ১২টায়।
‘কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভে’-র কথা শুনেছি, বাস্তবে দেখে এর সৌন্দর্যে আমরা মুগ্ধ হলাম। আমার মতে, এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাকৃতিক সুন্দর রাস্তা। একপাশে পাহাড় আর একপাশে সাগর, এরচেয়ে সুন্দর আর কিছু হতে পারেনা! আমাদের দেশটা ছোট হলে কি হবে এর রূপের শেষ নেই, দেশের একেক প্রান্তে একেকরকম সৌন্দর্যের ডালা সাজানো। এসব ভাবতে ভাবতে অল্পস্বল্প যানবাহনের মধ্যে আরামসেই চালাচ্ছিলাম আর ফোটোশুট করছিলাম...।
প্ল্যান ছিলো পথিমধ্যে ভালো কোন লোকেশন/রেস্টুরেন্ট দেখে নাস্তা করার। হিমছড়িতে ঢুকতেই পাহাড়ের পাদদেশে দারুন একটি রেস্টুরেন্ট চোখে পড়লো, নাম ‘স্টোন ফরেস্ট’। নামের মতোই স্বকীয় এর অবস্থান আর নকশা। পাহাড় আর সাগরের সৌন্দর্য একসাথে উপভোগ করতে এর জুড়ি নেই।
পরিবেশ আর খাবারের মান ভালো তাই দামটা একটু বেশী। চিকেন গ্রীল আর আফগান নান অর্ডার করলাম। তবে কাস্টোমার কম বিধায় এদের কাজের ইফিশিয়েন্সি কম, খাবার সার্ভ করতে অনেকক্ষণ লাগলো। যাহোক পাহাড়ের প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা আর সাগরের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের মাঝে দারুন কিছু সময় কাটিয়ে, জম্পেশ নাস্তা করে, ফোটোশুট করে আবার রওনা দিলাম।
বাইক নিয়ে দেশের সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা ধরে এগিয়ে চলছি। পাহাড় আর সাগর সাথে সাথে চলছে। পথে নদী, নৌকা, ঘাট, মোহনা অনেককিছুই পড়লো আর রিসোর্টতো আছেই। দু’চোখ ভরে উপভোগ করছিলাম এসবের সৌন্দর্য আর আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছিলাম। আমি ছোটবেলা থেকেই ভ্রমনপাগল। যখন-যেখানে-যেভাবে পেরেছি ঘুরেছি।
নতুন নতুন জায়গায় যাওয়া, সেখানকার জীবনাচরন, খাবার-দাবার, সংস্কৃতি আমাকে বরাবরই খুব আকর্ষণ করে। বাইকট্রাভেলিং এইজন্যই আমার পছন্দ, এটি মানুষ-পরিবেশ-প্রকৃতির সাথে পরিপূর্ণ সংযোগ ঘটায়। আল্লাহ্তায়ালা এই শখ পূরণ করার তৌফিক দান করেছেন, সহি-সালামত রেখেছেন এরচেয়ে বড় আর কি হতে পারে!
ইনানী পয়েন্ট পার হওয়ার পর রাস্তা সাগরের অনেক কাছে চলে এলো আর প্ল্যান অনুযায়ী বাইক বীচে নামিয়ে দিলাম। ঢাকা থেকে যে দৃশ্য কল্পনা করে এতোদূর এসেছি সেটি বাস্তবায়ন করলাম। বাইক নিয়ে সাগরের পানিতে নেমে গেলাম, আহ কি দুর্দান্ত অনুভূতি! সাগরের শক্তি কতখানি তা নতুনভাবে টের পেলাম, ঢেউয়ের তোড়ে বাইকের ডিরেকশন চেঞ্জ হয়ে যায়।
আমার ভাই ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও আমার চাপে পড়ে ভয়ে ভয়ে পানিতে চালালো। এতোকষ্ট করে এতোদূর এসে এই অভিজ্ঞতা না নিলে হয়? এরপর বাইকের কিছু এক্সক্লুসিভ ফোটোশুট করলাম। সাগরের এক অদ্ভুত টান আছে, এর কাছে এলে এতে নামতেই হবে; তাই না চাইতেও আবার নেমে গেলাম!!
এরপরের রাস্তাটা ছিলো একেবারেই ফাঁকা, অনেকক্ষণ পর পর একটা-দুইটা বাইক/অটো রিকশা আসে। ভেজা শরীরে যাত্রা শুরু করায় টেনশনে ছিলাম। হেলমেট খুলে ফেললাম, গ্রীষ্মের রোদের ঝাঁঝে একঘন্টার মধ্যে জিন্সসহ শুকিয়ে গেলাম! এই পর্যায়ে এসে পাকা রাস্তা শেষ হয়ে গেলো। এরপর রাস্তার কাজ চলছে (কাজ শেষ হওয়ার পর ২০১৭-তে রাস্তাটি উদ্বোধন করা হয়েছে)।
বালু-মাটি ফেলা রাস্তায় আমরা যতক্ষন বাইকের চাকা সাপোর্ট করে ততক্ষণ চালালাম। তারপর বাধ্য হয়ে আমাদের মেইন রোড ছেড়ে সরূ গ্রামীণ রাস্তায় আসতে হলো। মানুষকে জিজ্ঞেস করে করে কিছুক্ষণ চালানোর পর আমরা এক রহস্যময় রাস্তায় এসে উঠলাম...।
রহস্যময় বলছি কারন এই রাস্তাটি ম্যাপে খুঁজে পাওয়া যায় না, শুধু ধারনা করতে পারি এটি চন্দ্রকিল্লার কোথাও। আর মানুষজনও সঠিক তথ্য দিতে পারেনা (অশিক্ষিত/অনুন্নত জনপদে এই সমস্যাটি হবেই) তাই অনেক ঘোরা আর ভুল রাস্তায় যাওয়া হচ্ছিলো।
যাহোক, পাহাড়ী রাস্তার স্বাদ পেলাম এই রাস্তায়; উচু-নীচু, আঁকা-বাঁকা, বনের ভেতর দিয়ে রাস্তা। কোথাও কোথাও রাস্তার মাঝেখানে গাছ, গাছ না কেটে তার চারপাশ দিয়ে রাস্তা নিয়ে গেছে! কিছুদূর পর পর পাহাড়ি গ্রাম-বাজার পড়ে। পাহাড়ি মানুষজন আর তাদের জীবনাচরণ দেখতে ভালো লাগছিলো। মোবাইলের লাউড স্পিকারে গান ছেড়ে ছবি তুলতে তুলতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।
অনেক সাধনার পরে আমরা টেকনাফ এসে পৌছলাম। সামান্য পথে এতোকষ্টের কারনে বিরক্ত লাগছিলো (যেটি আমাদের চেহারাতেই ফুটে উঠছে!)। শহরটাকে দেখে আমরা অবাক হলাম, টেকনাফের মতো পর্যটন স্থান থাকার পরও নিতান্তই অনুন্নত একটি শহর।
জীবনমান, অবকাঠামো, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, পরিবহন ইত্যাদির অভাব রয়েছে। আমাদের সরকারের উচিত পর্যটন শিল্পকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা যুক্ত করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত স্থানগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করা। এটি দেশের পাশাপাশি বিদেশী পর্যটকদের আরোও বেশী করে টেনে আনবে। শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন অনেকাংশে বাড়বে।
অনেকখুঁজে একটি হোটেল পেলাম যেখানে উপচেপড়া ভীড়। আরেকটি হোটেল পেলাম যেটি সাধারন, ভাত-মুরগীর ঝোল ছাড়া আর কিছু নেই। অবশ্য খাবার সাধারন হলেও স্বাদ অসাধারন। এখানকার মুরগীর আকৃতি বড় আর মাংস তুলতুলে, পেটপুরে খেয়ে উঠলাম। গুগল ম্যাপে বাকি রাস্তা বুঝতে কষ্ট হচ্ছিলো। বিভিন্নজনের কাছে জিজ্ঞেস করে কনফিউজ হয়ে শেষে এক বাইকার আঙ্কেলকে পেলাম।
তার কাছ থেকে জানলাম কয়েকবছর আগেই শাহপরীর দ্বীপের রাস্তা ভেঙে এটি মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে-মনটাই ভেঙে গেলো। তবে নোয়াপাড়া পর্যন্ত যাওয়া যাবে-বর্তমানে এটাই দেশের মূল ভূখন্ডের শেষপ্রান্ত। উনার বাড়ি আবার ওখানেই তাই উনার পিছুপিছু যেতে লাগলাম...।
Also Read: ২৪ ঘণ্টায় মটরসাইকেলে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া
বেশ কিছুক্ষণ চালানোর পর নোয়াপাড়ায় তার বাড়ি পৌছে ভদ্রলোক বাকি পথ দেখিয়ে দিলেন। গ্রামীণ আঁকা-বাঁকা পথ পেড়িয়ে অবশেষে গন্তব্যে পৌছলাম। টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের নোয়াপাড়া গ্রামের শেষপ্রান্ত, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমানায়! বেড়িবাঁধের উপর বাইক রেখে বিজিবি’র কাছ থেকে অনুমতি নিলাম। জলাভূমির পাশ দিয়ে, ঘেরের পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌছে গেলাম নাফ নদীর পাড়ে-ওই পাড়ে মিয়ানমার!!
ইইয়াআআহহ...চিৎকার করে দু’জন উল্লাস করলাম। ইয়েস আমরা পেরেছি, বাইকে করে বাংলাদেশের একটি প্রান্ত জয় করেছি!!! দু’জন পাড়ে বসে কিছুক্ষণ প্রগাঢ় নীরবতায় উপভোগ করলাম নাফ নদীর অপরূপ দৃশ্য এবং রক্তিম সূর্যাস্ত। এই অভিজ্ঞতা, সেই অনুভূতি ভোলার নয়।
কোন এক মনীষি বলেছিলেন, প্রতিটি মানুষের জীবনে অন্তত একবার লং রাইডে যাওয়া উচিত কারন এটি জীবনের নতুন নতুন রূপ উন্মোচন করে।। এই কথাটি মনে গেঁথে আমি বাইক নিয়ে বেড়িয়েছিলাম, দেশ ভ্রমনের স্বপ্ন দেখেছিলাম। এই ট্যুর করার পর সেটির আকাঙ্ক্ষা বহুগুনে বেড়ে গেছে। আমি আবারো বের হবো, নতুন কোন লক্ষ্য নিয়ে নতুন কোন পথে....
লিখেছেনঃ তানভীর মেহেদী