Shares 2

একজন বাইকারের জন্য লম্বাভ্রমণের সময় নামায এর উপকার

Last updated on 03-Jul-2024 , By Shuvo Bangla

একজন বাইকারের জন্য লম্বাভ্রমণের এর সময় নামায এর উপকার

প্রথমেই বলে নেই, আমি কোন মুফতি নই কিংবা স্বাস্থ্য সম্পর্কে আমার বিশেষ জ্ঞান আছে, তাও বলছি না। আমি আপনাদের জন্য যা লিখছি তা স্রেফ আমার ব্যাক্তিগত জীবনের লম্বাভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে বলা। যদি কোন ভুলত্রুটি হয়ে থাকে, তাহলে নিজ গুণে আমাকে ক্ষমা করবেন। তবে হলফ করে বলতে পারি, আমার এই লেখা পড়ে আপনাদের উপকার বৈ অপকার হবে না। প্রথমে আমি আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া উপকারগুলোর কথা বলব, তার পরের প্যারায় প্রয়োজনীয় মাসলা-মাসায়েল নিয়ে কিছুটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করব।

আল্লাহ্‌র নাম স্মরণ করা এবং প্রয়োজনীয় দোয়া পড়াঃ

১। আল্লাহ্‌র নাম স্মরণ করা এবং প্রয়োজনীয় দোয়া পড়াঃ 

সাধারণত, আমাদের রাইডারদের লংট্যুর দেওয়ার আগের দিন থেকে বাইকে বসার আগে পর্যন্ত খুব উত্তেজনা কাজ করে। অনেকর এমনও হয় যে ট্যুর দেওয়ার আগের রাতে পর্যাপ্ত ঘুম হয় না, যেটা পরবর্তী দিনে ড্রাইভিং এর সময় কিছুটা প্রভাব ফেলে। দোয়া পড়লে এবং আল্লাহ্‌র নাম স্মরণ করলে যেটা হয়, উত্তেজনা সাথে সাথেই কেটে যায়; এসময় মানুষ কিছুটা প্র্যাকটিকাল চিন্তাভাবনা করতে শেখে, আর হালকা স্ট্রেসও কাজ করে। মনে রাখবেন হালকা স্ট্রেসে ড্রাইভ করা পক্ষান্তরে ভালো, এতে মাথা নিরাপত্তা নিশ্চিতকরনে খুব কাজ করে। অধিক উত্তেজনা কিংবা অধিক রিলাক্স থাকলে দূর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বেশী।

২। নামাজের আগে অজু করাঃ 

মজার ব্যাপার হল, অজুর সময়ে সেসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ধুতে হয় সেগুলোই সাধারণত যাত্রাপথে সবচেয়ে বেশী ময়লা হয়। হয়তো আপনি জুতা, মোজা, আর্মার-গার্ড, রুমাল পড়ে আছেন। যেগুলো খুলা হয়তো আপনার জন্য বেশ ঝামেলার। একবার খুলেই দেখুন না, দেখবেন হাত পায়ের রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হবে, অসাড়তা কেটে যাবে। আর অজু করার কারনে আপনি আবার সতেজ হয়ে যাবেন। সামান্য ৫ মিনিটের এই কাজের জন্য আপনি নিশ্চিতভাবে আরো অতিরিক্ত দুই ঘণ্টা কাজ করার শক্তি পেয়ে যাবেন।

নামাজ পড়া

৩। নামাজ পড়াঃ 

এটার উপকারিতা নিয়ে বাড়তি কথা বলার তেমন প্রয়োজন হয়তো নেই। কারন নামাজের শারীরিক উপকারিতা সম্পর্কে এত্ত এত্ত সব গবেষণা হয়েছে, যা বিশাল বড় বইয়ের পাতায় লিখে শেষ করা যাবে না। বিশ্বাস না হলে একবার গুগলে সার্চ দিয়ে দেখেন, দেখবেন এক বছরেও আর্টিকেলগুলোর লিখাগুলো পড়ে শেষ করতে পারবেন না।

নামাজের শারীরিক উপকারিতা সম্পর্কে

তবে আপনি নামাজের তাৎক্ষনিক উপকারিতাটা বুঝতে পারবেন আপনার কোমরে আর হাঁটুতে। আমরা বাইকাররা এই দুই জায়গাটাতে একটু বেশী পেইন পাই, চাপ অনুভব করি। চিন্তা নেই, দুই রাকাত নামায পড়ুন, পেইন ভ্যানিশ। হাত পায়ের আর পুরো দেহের অসাড়তা কেটে যাবে।

আপনাকে নামাজ পড়তে হবে শরীয়তসম্মত ভাবে

তবে শর্ত হল আপনাকে নামাজ পড়তে হবে শরীয়তসম্মত ভাবে, খুব ধীরে ধীরে, ধ্যানের সহকারে এবং সঠিক নিয়মে রুকু এবং সিজদাহ করে। আপনি জানেন, আপনাকে সফরের সময় শুধু কসরের ২ রাকাত নামায পড়লেই হবে। অতএব সময় যে খুব একটা নষ্ট হবে তা কিন্তু মোটেই বলা যায় না। বরং পথে দাড়িয়ে চা খেতেই আমরা এর চেয়ে বেশি সময় নষ্ট করি।

মাগরিব আর ফজরের নামায

৪। মাগরিব আর ফজরের নামাযঃ 

এই দুই ওয়াক্তের নামায আমাদের জন্য খুবই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এসময়টা হল আলোর রূপান্তরনের সময় (light transitional period). এসময় না থাকে আলো, না অন্ধকার। ফলে যেটা হয়, আমাদের দৃষ্টিক্ষমতা অনেক হ্রাস পায়। হাদিস অনুসারে ফজরের নামায পড়ার উত্তম সময় হল আকাশ একটু ফর্সা হওয়ার পর, আর মাগরিব নামাযেরটা হচ্ছে সুর্যাস্তের পর পরই আদায় করে নেওয়া। অতএব, আপনি যদি নিয়ম মোতাবেক এই দুই ওয়াক্তের নামাজ আদায় করে নেন তাহলে দেখবেন এই transitional সময়টা আপনাকে ফেস করতে হবে না। তাছাড়া দিনে এবং রাতের ড্রাইভিং ধরন সম্পূর্ণ আলাদা। অন্ধকার থেকে আলোতে ড্রাইভিং করা সহজ কিন্তু আলো থেকে অন্ধকারে ড্রাইভিং করা তুলনামূলক কঠিন। অতএব একটু ব্রেক নিয়ে চট করে মাগরিব নামাযটা পড়ে আবার রওয়ানা দিন, দেখবেন যে কোন ঝামেলা মনে হচ্ছে না।

নামাজের জন্য এত টাইম পাব কই? !!! (আসলেই টাইম বের করতে হয় কি??? ) 

আমারা সাধারণত লংট্যুর শুরু করি ভোরবেলাতে, তাই যাত্রা শুরুর আগে ফজর নামাজ পড়লেই হয়। দিনের পুরো ১২ ঘণ্টার রাইডিংএ আমরা তিন থেকে চারবার এমনিতেই বিশ্রাম নেই। যদি তাও না নিয়ে থাকি, তাহলে এটলিস্ট দুপুরের খাবারের জন্য থামি। এসময় যোহরের দুই রাকাত কসর নামাজ সহজেই আদায় করতে পারি। আর দুপুরের খাবার পরের রাইডে বিকেলের কাছাকাছি সময়ে সবারই একটু হলেও সাময়িক অবসাদ কাজ করে, আর এসময় সকলেই একটা নিশ্চিতভাবে চা বিরতি নেন। এই সময়টাতে আপনি সহজেই আসরের নামাজ পড়ে নিতে পারেন। আমি নিশ্চিত এতে আপনি সর্বিকভাবে খুবই উপকার পাবেন। অনেকের হয়তো খুব তাড়াহুড়ো থাকতে পারে, হয়তো সন্ধ্যার আগে পৌছতে হবে এমন শর্ত থাকতে পারে, এক্ষেত্রে তবুও নামাজ ছাড়বেননা। নামাজের বিরতি আপনাকে যে স্থিরতা দেবে তাতে আপনি আবার পূর্ন উদ্দমে চালু হয়ে যাবেন, আর তাড়াহুড়া জনিত চাপ আর দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাবেন। এর পর আপনার ট্যুরের তৃতীয়/ চতুর্থ ব্রেকটা মাগরিবের সময় নিন আর নামাজ পড়ে ফেলুন। আর এশার নামাজ তো গন্তব্যস্থলেই আদায় করতে পারবেন।

"রাস্তার মধ্যে নামাজ পড়বটা কইগ্রুপের কেউ নামাজ পড়ছে নাআমি কী করব? "

রাস্তার মধ্যে নামাজ পড়বটা কই গ্রুপের কেউ নামাজ পড়ছে না, আমি কী করব

বিদেশে মুসলিম বাইকাররা সাধারণত জায়নামাজ তাদের সাথেই রাখেন, আর অজু করার জন্য স্যাডেল ব্যাগের সাথে আলাদা পানির ট্যাঙ্কি জুড়ে দেন। আমাদের সাত কপালের ভাগ্য যে আমরা এমন এক দেশে বাস করি যেখানে এমন কোন জায়গা পাওয়া যাবে না, যেখানে নামাজ পড়ার জন্য মসজিদ আর অজুর জন্য পানি পাওয়া যায় না। এদেশের প্রতিটা পথে প্রান্তরে মসজিদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সবচেয়ে সুবিধাজনক ব্যাপার হল এশার নামাজটা বাদে বাংলাদেশের সকল মসজিদে একই সময়ে জামাতে নামাজ আদায় করা হয়। অতএব যাত্রাপথে আপনি চাইলে জামাতের সাথে নামাজটা আদায় করে নিতে পারেন। এতে আপনার সময় খুব একটা নষ্ট হবে না। এদেশের মানুষ অনেকেই হয়তবা নিয়মিত নামাজ আদায় করেন না, কিন্তু আরেকজনের নামাজ আদায়ের সুযোগ করে দেওয়ার ব্যাপারে অনেক আগ্রহ দেখায়।  আপনি বাংলাদেশের যেকোন জায়গায় যেয়ে কোন দোকানের সামনে অথবা কোন লোককে বলবেন, "ভাই আমি নামাজটা পড়ব, আমার বাইকটা একটু দেখবেন?", দেখবেন শতকরা ১০০ ভাগ লোকই বলবে, "চিন্তা কইরেন না ভাই, যান নামাজটা পইড়া আসেন।"

Also Read: ঈদে বাইকে ভ্রমণের জন্য মেইনটেন্যান্স টিপস ও প্রস্তুতি

২য়ত, গ্রুপ লিডার যদি নিজে নামাজি হন, আলহামদুলিল্লাহ্‌। তা না হলে তারা যখন ব্রেক নেয় তখন খেয়াল করলে দেখবেন যোহর এবং আসরের নামাজের আশেপাশে সময়েই তা পড়ে যায়; আর তখনই আপনি আপনার নামাজ সেরে নিন। মাগরিবের জন্য আলাদা টাইম চেয়ে নিন। বাংলাদেশ হচ্ছে এমন একটা জায়গা, যেখানে স্বয়ং রাষ্ট্রপতিও আপনার নামাজ পড়ার ব্যাপারে বাঁধা দিবেন না নিশ্চিত থাকতে পারেন। তবে নামাজের জন্য সময় চাওয়ার সময় "একটু নামাজ পড়তে চাই" না বলে বলুন, "চলেন, নামাজ পড়ে আসি" এই কথাটার ফযিলত অনেক।

"কাপড় নোংরাঅতএব নামাজ পড়তে পারবো না।।!! "

নামাজ ত্যাগ করার সবচেয়ে বড় অজুহাত এটি। সবার আগে বলে নেই, ওয়াক্তের মধ্যে নামাজ আদায় করা ফরজ। এর ওপর বড় কোন কিছুই নেই। আর কাপড়ের পরিচ্ছন্নতা নামাজের পূর্বশর্তগুলোর মধ্যে একটি। ওয়াক্তের ভিতরে যদি আপনার কাপড় পরিবর্তন করার সুযোগ থাকে, তবে আপনাকে সেটা করতে হবে। একেবারেই নিরুপায় হলে বিশেষ পরিস্থিতিতে নামাজ আদায় করতে হবে। মনে রাখবেন, নামাজ কবুল করার মালিক একমাত্র আল্লাহ্‌, আপনার আশেপাশের লোক নন।

২ইয়ত, ভেজা কাপড়, রাস্তার কাদামাটি ধুলোবালি, ঘাম ইত্যাদি নামাজের অন্তরায় না। আর যদি বেশী ময়লা লেগে থাকে, তাহলে তা স্বল্প পানিতে পরিষ্কার করার মাসালা আছে, আপনার মুফতির কাছে জেনে নিবেন।

এবার আসি মাসলা মাসায়েলের কথা।

১। যাত্রা শুরুর আগে "তায়াক্ক্বালতু আলাল্লাহ" বলুন তারপর এই দোয়াটা পড়ে নিন। سُبْحَانَ الَّذِي سَخَّرَ لَنَا هَذَا، وَمَا كُنَّا لَهُ مُقْرِنِينَ، وَإِنَّا إِلَى رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُون . এরপর আপনি আয়াতুল কুরসি পড়ে ঘর থেকে বের হতে পারেন।

কিছু জানা না থাকলে অন্তত আল্লাহ্‌র নাম মনে করুন, কারন আপনার মনের খবর আপনার থেকে ওপরওয়ালাই বেশী জানেন।

২। আপনি যদি বাসা থেকে ১২ মাইলের (মতান্তরে ৫৭.৫ আবার অনেকে ৪০ মাইলও বলেন; নিশ্চিত হতে সহীহ হাদীস দেখুন) এর বেশী দূরে ভ্রমনে যাবেন এই নিয়্যতে যদি বের হন, তাহলেই আপনি মুসাফির। এমতাবস্থায় ৪ রাকাতের সকল ফরজ নামাজ ২ রাকাত হবে। আর বাকী ওয়াক্তের নামাজগুলো অপরিবর্তিত থাকবে। সুন্নত চাইলে পড়তে পারেন, তবে সফররত অবস্থায় সুন্নতের কোন বাধ্যবাধকতা নেই, তবে বিতর পড়তেই হবে। তবে জামাতে নামাজ আদায় করলে ইমাম সাহেব যেই কয় রাকাআত ফরজ আদায় করবেন, আপনাকেও সেই কয় রাকআত ফরজ আদায় করতে হবে। এর ভেতরে আরো কিছু বিষয় আছে, এজন্য বিস্তারিত জানার জন্য ভালো সহীহ হাদিস জানা একজন আলেম সাহেবকে জিজ্ঞেস করুন অথবা নিজেই সহীহ হাদীস দেখে নিন।

Also read: দেখে এলাম নেপাল – হিমালয় কন্ন্যা

[বিঃদ্রঃ নামাজ আদায় করা ফরজ। মুসল্লিরা নামাজ আদায় করে আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য, নিজের শরীরের ব্যায়ামের জন্য না। যাই হোক, আমার এগুলো বলার উদ্দেশ্য হল, মানুষকে তথা আমার প্রিয় বাইকার ভাইদের নামাজে উৎসাহিত করা। আর এই উপকারগুলো শুধু বাইকারদের জন্য না, দূরের পথের যেকোন প্রকার চালক অথবা যাত্রীর জন্য প্রযোজ্য। আর নামাজের সার্বজনীন উপকারীতা তো আছেই]

[ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]

লিখেছেন- Ahmed Yousuf Jubaer

( ishopnoraj@icloud.com )


Published by Shuvo Bangla