একটি দুঃসাহসিক মোটরবাইক ভ্রমনের গল্প (২য় পর্ব)
This page was last updated on 06-Jul-2024 08:57am , By Ashik Mahmud Bangla
ভোর ৬ টায় আমাদের গাইড রুস্তম আমাদের নিয়ে যায় মোটরবাইক ট্রিনিং এ। রুমার খুব কাছেই একটা রিস্কি ঢাল এ। আমরা ২ জন প্রথমে একে একে সেই ঢালে উঠা নামা করি যা পাহাড়ি রাস্তার জন্য সঠিক স্টাইল ছিলো না। এর পর ইউ এন এর সেই ভাই আমাদের সঠিক নিয়মে নেমে উঠে দেখান। তার নিয়মে আমরা ২/১ বার ট্র্যায়াল দিয়ে বুঝতে পারি, ট্রেইনিং টা আমাদের অনেক প্রয়োজন ছিলো।
যা হোক সেই এক্সক্লুসিভ ট্রেইনিং এর কিছু টিপস আপনাদের সাথে শেয়ার করছিঃ
১। পাহাড়ের খাড়া ঢালে নামতে/ উঠতে ১স্ট গিয়ার ২। ফুল ব্রেক ছেড়ে দিয়ে বাইক ফ্রী করা যাবেনা ৩। চেইনে গ্রিজ বা মবিল থাকলে তা মুছে ড্রাই করতে হবে ৪। ফুট ব্রেক লুজ করে রাখতে হবে ৫। বেশি খাড়া ঢাল হলে আর পি এম ৪ এর উপরে এডজাস্ট করতে হবে। ৬। কোন কারনে বাইক যদি পড়ে যায় তাহলে যত দ্রুত সম্ভব বাইকের উপরে প্রেসার দিয়ে মাটি পাথরের সাথে চেপে ধরতে হবে।
সকাল ৮ টায় নাস্তা করে আমরা ৫জন (গাইড সহ) বেরিয়ে গেলাম কেওকাড়াডং এর নেশায়। আজকের এই দিনটা আমাদের জ়ীবনে ২য় বার আর আসবে কি না জানিনা। এসব ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চল্লাম। বিশ্বাস করা মুশকিল প্রতি কিমি রাস্তা অতিক্রম করতে আমাদের ১ ঘন্টার মতো সময় লাগছিল। কেই ভাব্বেন না এখানে পিচ ঢালাই বা অন্য ভালো রাস্তা। এই রাস্তা শুধুই, শক্ত মাটি, ছোট/ বড় পাথর, আর মাটি শুকিয়ে পিচ্ছিল পাউডার এর পথ।
কেউকাড়াডং যাবার পথে বগা লেক পড়ে, আমরা যতই সামনে যাচ্ছি রাস্তা ততটাই খারাপ হচ্ছে। এভাবে আমাদের যেতে হবে প্রায় ১৯ কিমি, মানে মিনিমাম ১৫ ঘন্টার পথ। বলে রাখা দরকার যে বগা লেক পর্যন্ত যেতে ৩/৪ টি ঢাল এত বেসী খাড়া যেখানে যে কোন বাইকার কেই থেমে যেতে হবে। এর পর বগা লেক থেকে কোরাডাডং যেতে খুব বেশি খাড়া ঢাল ২ টা। এই ঢাল গুলো সব এ ৬৫-৭০-৭৫ ডিগ্রি খাড়া এবং রাস্তা মস্রিন পাথর আর পিচ্ছিল পাউডার হয়ে যাওয়া মাটি। কোরাডাডং সমতল ভূমি থেকে ৩৩০০ ফিট উচুতে অবস্থিত।
Also Read: একটি দুঃসাহসিক মোটরবাইক ভ্রমনের গল্প (১ম পর্ব)
যা হোক আমরা এভাবে যখন প্রায় বগা লেকের কাছাকাছি, আর একটা ঢাল উঠতে পারলেই বগালেক, এই ঢালে এসে আমাদের মনে হলো, এবার বুঝি পাহাড় জয়ের নেশা আমাদের জীবন শংকায় ফেলে দিতে পারে। এমনিতেই যে পথ আমরা এসেছি সেই পথ আবার ব্যাক করতে হবে, আর সুস্থ ভাবে ঢাকাতেও যেতে হবে, আর আমি যেহেতু বেশী ছুটি ম্যানেজ করতে পারিনি আর এভাবে বাইকে গেলে ১.৫ দিন টাইম লেগে যাবে।
আর যাদের সাথে এসেছি তারা সবাই আমার গ্রামের ছোট ভাই, সুতরাং ওদের কারো কোন ক্ষতি হলে জবাব্দিহিটা আমাকেই দিতে হবে, সেই সাথে রোড বাইক অফ রোডে কিভাবে ফাইট করে চলেছে সেটা পাঠকরাও বুঝতে পারছেন। সব দিকে ভেবে ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিই আমরা বাইক রেখে পায়ে হেটে কেওকাড়াডং পর্যন্ত যাবো, আগামিকাল ব্যাক করার সময় এখান থেকেই আবার বাইক নিয়ে রুমা বাজার চলে যাবো।
আমাদের গাইড বাইক দুইটা ওখানকার গ্রাম প্রধানের বাড়িতে রাখেন, আমরা ২টায় বগালেক এ পায়ে হেটে উঠি। বগালেক এ দুপুরের খাবার খেয়ে দ্রুত আমরা বেরিয়ে পড়ি কেওকাড়াডং এর পথে। কেওকাড়াডং পায়ে হেটে ওঠার পথে ২/৩ টি ঝরনা পাই, যার মদ্ধ্যে চিংড়ি ঝরনা তে আমরা গোসল করি।
বলে রাখা দরকার, কেওকাড়াডং ওঠার পথে ওই রেনজ়ের ৩ জন অফ রোড বাইকারের সাথে দেখা হয়, যাদের মদ্ধ্যে কেওকাড়াডং পাহাড়ের মালিক লালা দা এর ছেলে রুবেল কে আমরা পাই। সে আমাদের এই এলাকায় অফ রোড বাইকিং করার আমন্ত্রন জানায়, পাশাপাশি সব সু্যোগের সাপ্পর্ট দেওয়ার আস্বাশ দেয়। পরে আমি তার হোন্ডা এক্স এল ১৮৫ টা পাহাড়েই কিছুক্ষন চালাই।
ডার্ট বাইকের প্রতি আলাদা একটা অনুভুতি আমার আগে থেকেই ছিলো। এই মুহর্তটা যেন সেই টান কে আরো কয়েকগুনে বাড়িয়ে দিলো। ট্রেকিং করার স্বাদ নিতে নিতে ঠিক দিন-সন্ধ্যার মিলনকালে আমরা উঠে পড়ি কেওকাড়াডং এর চুড়াতে।এখান থেকে বাংলাদেশের যে সুন্দর রুপ আমরা দেখি তা চিরস্মরনিয়। এখান থেকে রাত- সকাল দিন প্রতিটা মোমেন্ট ই উপভোগ করার মতো। রাতেই আমাদের মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায় আমরা সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি।
৪র্থ দিনঃ
সকাল ৮ টায় বগা লেকের উদ্দ্যেশ্যে আবার ট্রেকিং শুরু করি, বগা লেকে নামতে আমাদের মাত্র ২ ঘন্টা সময় লাগে। এরপর আমরাসেই বাড়ি থেকে বাইক নিয়ে একই ভাবে পাহাড় বেয়ে নেমে আসি রুমা বাজার।
উপলব্ধিঃ রুমা বাজারে যখন আসি তখন আমাদের এবং আমাদের বাইকের অবস্থা ছিলো দেখার মত। আর সাথে ছিলো কেওকাড়াডং পর্যন্ত বাইকে না যেতে পারার কস্ট। আর ঠিক তার আগের দিন বুঝতে পারলাম রোহিত ভাইয়ের টিম কেনো বগা লেক পর্যন্ত যেতে পারেনি। ডার্ট বাইক আর রোড বাইকের আসল পার্থ্যক্য কি? আর এমন রাস্তা ঘুরে এসে আমাদের বাইক ড্রাইভ করার কনফিডেন্স লেভেল অনেক বেড়ে যায়। আগে রোডে কাদা, পাথর গুড়া, পানি দেখলে ভয় পেতাম, আর এখন এমন কিছু সামনে এলে খুব মজা করে চালাই, আর মনে ভেসে ওঠে রুমার রাস্তার অভিজ্ঞতা।
৪র্থ দিন বিকেলঃ
এই বিকেল টা দেখার জন্যে আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। রুমা অঞ্চলের ৩৫ হাজার বিভিন্ন বর্নের/ ধর্মের মনুষের জন্যে সপ্তাহে ১ দিন হাট বসে রুমা বাজারে। সেই হাট ওই এলাকার পর্যটকদের কাছে বিষেশ আকর্ষনের জায়গা। এই হাটে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গহীন অঞ্চলের পাহাড়িরা তাদের কালচারে আসে, তাদের বানানো বিভিন্ন পন্য নিয়ে আসে। হাড়ের অলংকার, হাতে পশুর শিং দিয়ে বানানো হুক্কা, কোমড়ে ধারালো অস্ত্র, কেউ কেউ অর্ধনগ্ন, সব বয়সের পাহাড়িদের একসাথে দেখতে পাবার জন্যে এটা বড় একটা সু্যোগ। আমরা পুরো বিকেল জুরে পাহাড়ি মানুষের জীবনযাত্রা উপভোগ করি।
চারিদিকে ঘুরতে ঘুরতে যখন সবাই ক্লান্ত, এত প্রিয় মোটরবাইক্টাকে দেখেও যখন বিরক্ত লাগছে, এমন সময়ে আমাদের জন্য হোটেল মালিক সাংগু নদিতে রাতের বেলায় নৌকার উপর বার বি কিউ এর আয়জন করে দিলেন। এমন পাহাড়ি অঞ্চলে পাহাড়ি নদির মাঝে বার বি কিউএর সাথে পাহাড়ি সূরা আমাদের নিয়ে গেল অন্য এক ভুবনে। রাতের রুমার রুপ উপভোগ শেষে রাত ২টার দিকে আমরা হোটেলে এসে ঘুমিয়ে পড়ি।
৫ম দিনঃ
আমাদের ফ্রেন্ড তুষারের বিয়ে উপলক্ষে বিডি মোটরসাইক্লিস্ট মেম্বারদের চিটাগাং ক্লাবে (৩রা ফেব্রুয়ারী, ২০১৪) আমন্ত্রন জানানো হয়। কিন্তু ঐ সময়ে বিডি মোটরসাইক্লিস্ট এর মূল প্ল্যান সেইন্টমার্টিন ট্যুর ইতমধ্যে ফাইনাল হয়ে যাওয়ায় আমরা ৪জনের বিডি মোটরসাইক্লিস্ট এর এই দল তুষারের বিয়েতে যাবো সিদ্ধান্ত প্রহন করি। ঐ ট্যুরের পরে অবশ্য বিডি মোটরসাইক্লিস্ট এর সাথে আমাদের রেগুলার এক্টিভিটি বন্ধ হয়ে যায়। আমরা বর্তমানে বাংলাদেশে অফ রোড বাইকিং প্রমোট করতে- আমাদের মুল গ্রুপ “বাংলাদেশ অফ রোড রাইডারস” এ কাজ করছি।
যা হোক, ভ্রমনের শেষের এই দিনে আমাদের ঘুম থেকে উঠতে ১০ টা বেজে যায়। আমরা ঝটপট রেডি হয়ে নাস্তা করে চিটাগাং ক্লাবের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি। আমাদের ফেরার পথের সেই খারাপ রাস্তা এখন অনেক ভালো লাগতে শুরু করলো। এভাবে সাংগু নদি পার হয়ে এসে পাহাড়ী ছোট আনারস খেলাম, চা খেয়ে নিজেদের আরো চাংগা করে বান্দরবনের উদ্দেশ্যে ছুটলাম।
এবার সামনে একটি কাঠের ব্রিজ পেলাম যা ছিল খতিগ্রস্ত, এক পাশের ৩ হাতের মতো রাস্তা ধসে গিয়েছে। দুই পাশে ১০০/১৫০ এর মতো মানুষ দারিয়ে আছে, দুপাশে কিছু আর্মিদের গাড়ি- টুরিস্ট বাস- চান্দের গাড়ি ইত্যাদি দেখা গেলো। আমাদের হাতে বেশী সময় ও নেই, কি করা যায়। কিভাবে পার হবো। ব্রিজের নিচে তাকালে রিতিমতো ভয় লাগে, ১৫০/২০০ ফিট গভির পাহাড়ি খাদ। আমাদের সহযাত্রিরা লাফ দিয়ে পার হয়ে গেল, আমরা বাইক ব্রিজের উপর স্ট্যান্ড করে আমাদের ব্যাগ ওপারে ওদের কাছে পার করে দিলাম।
যেহেতু কাঠের ব্রিজ ছিলো, তাই সেটা মেরামত করতে পাশেই কিছু কাঠের তক্তা জরো করা ছিলো। সেখান থেকে ৪/৫ হাত লম্বা ও ১০ ইঞ্চির মতো চওড়া একটি তক্তা দিয়ে ব্রিজ ও রাস্তার সাথে সংযোগ করি, এবং আল্লাহর নাম নিয়ে একে একে দুজন-ই সুস্থ ভাবে পার হয়ে আসি। আমরা পার হয়ে দাঁড়িয়ে যখন সহযাত্রিদের বাইকে ওঠাচ্ছিলাম তখন আশপাশের মানুষের চোখের যে বিস্ময়ের ভাষা আমরা দেখে এলাম তা জীবনে ভোলার নয়।
ওদের উঠিয়ে আমরা দ্রুত একটু পথ এসে বাইক সাইড করে দাড়াই। সবাই বাইক থেকে নেমে সবার সাথে কোলাকুলি করি, যেন সবাই নতুন এক জ়ীবন পেয়েছি। সবাই একটা কথা বলতে থাকি যে, কন কিছুই আমাদের আটকে রাখতে পারছে না, উপরওয়ালা আমাদের উপরে অনেক বেশী সহায় ছিলেন সেদিন।আর আমাদের আত্মবিশ্বাস আরো বেড়ে যায়। এর পরে আমরা বান্দরবন হয়ে চিটাগাং ক্লাবের পাশে চলে আসি। আমাদের সবার যে অবস্থা তাতে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়া সম্ভব নয়। আমরা একটি ভালো সেলুন দেখে সেখানে সবাই সেভ-ফেসিয়াল ইত্যাদি করাই, পরে ক্লাবের ওয়াশরুমে ড্রেস চেঞ্জ করে বিয়েতে যোগ দিই।
এবার ঢাকা ফেরার পালা, কিন্তু পতেংগার পাশে মেরিন ড্রাইভে মোটরবাইক চালানো এবং সেই সাথে সমুদ্র দেখার নেশায় ছুটে যাই পতেঙ্গাতে। এখানে এসে কর্নফুলি নদী আর সাগরের মোহনার সুন্দর রুপ উপভোগ করে ঢাকার পথে রওনা হই বিকেল ৫ টায়। আমাদের বাইক দুইটা বাংলাদেশে মিডিয়াম ক্যাটাগরির পালসার ১৩৫ এবং এপাচি ১৫০ বাইক, আর দুঃসাহসিক এই পাহাড়ি ভ্রমনের পরে বাইকের পক্ষে আমাদের বহন করে ঢাকা নিয়ে আসা বেশ কস্টকর ছিলো। দুর্বার গতিতে ড্রাইভ করতে থাকি ঢাকার উদ্দেশ্যে এবং আমরা কোন সমস্যা ছাড়াই রাত ১১টার মধ্যে ঢাকা চলে আসি। আলহামদুলিল্লাহ।
সবশেষে বলতে পারি, সাবধানতা, সতর্কতা, সেফ বাইকিং কিট, রাস্তায় বাইক মেইনটেইনেন্স, পরিকল্পনা এবং ভাগ্য সহায় না থাকলে এ ধরনের মোটরবাইক ভ্রমন না করাই ভালো।
এখন পর্যন্ত রুমার স্থানীয় বাইকার ছাড়া বাইরের কোন বাইকার বগা লেক বা কেওকাড়াডং উঠতে পারেনি। আমার মনের ভেতরে কেওকাড়াডং পর্যন্ত বাইকিং করে উঠার একটা বীজ রোপন হয়ে আছে। সময় সুযোগ পেলে হয়ত আবার ছুটে যাবো কোন একদিন। এবং আবার লিখবো সেই জয়ের গল্প। লিখাটা বড়, একটু ডিটেইলে লিখার চেষ্টা করেছি, সময় নিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ, আর এ ধরনের ট্রিপ এর বেপারে কোন হেল্প লাগলে বাইকবিডি-র মাধ্যমে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। ধন্যবাদ।
আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন ফেসবুক এ