Lifan KPR 150cc মালিকানা রিভিউ লিখেছেন মাহবুব আলম
This page was last updated on 29-Jul-2024 04:40pm , By Shuvo Bangla
আশা করি সবাই ভালো আছেন। আজ আমি আমার Lifan KPR 150cc বাইকটি নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করবো। ভালো মন্দ মিলিয়ে এটা এক ধরনের রিভিউ-ই বলা চলে। আর, আমার লিখাটা অনেক বড় হবে, তাই সময় নিয়ে পড়ার অনুরোধ রইলো।
Lifan KPR 150cc মালিকানা রিভিউ
বাইক:- Lifan KPR 150cc। কালার :- গ্লোসি রেড। ওডো:-১৬৭০০ কিলোমিটার। ক্রয়:-অক্টোবর ২০১৬। কেপিয়ার বাংলাদেশের মার্কেট এ এভেইলেবল হবার পর থেকেই এই বাইকটার প্রতি আমার আগ্রহ ছিল। তাই বছর খানেক পর আমি আমার ব্যাবহারিত ফেযার বাইকটি বিক্রয় করে কেপিয়ার কেনার সিদ্ধান্ত নেই। এখানে উল্লেখ্য,দীর্ঘ দিন এফযি,ও ফেযার বাইক চালানোর জন্য আমি চাচ্ছিলাম এবার ভিন্ন ধারার একটি বাইকের ফ্লেভার নিতে। আর বাজেট,, লং ড্রাইভ, টপ স্পিড,বেটার এক্সিলারেশন,ইঞ্জিন পারফরমেন্স আর দারুন একটা স্পোর্টস লুক এর জন্য কেপিয়ার ই ছিল আমার বেস্ট অপশন।
তখন এখনকার মত টেস্ট ড্রাইভ দেয়ার মত অপশন ছিল না আর খুব কম মানুষই কেপিয়ার রাইড করতো। তাই কিছু বড় ভাইদের কাছ থেকে ইনফরমেশন,আর অনেকটা নিজের রিস্কেই নিয়ে ফেললাম একটি লাল গ্লোসি Lifan KPR 150cc । বাইক কিনে প্রথম স্টার্ট দেয়ার পরই আমি পুরোপুরিভাবে হতাশ হলাম। এটার রেসিং ইঞ্জিন সাউন্ড আমার কাছে পুরাই ডিসগাস্টিং লাগলো। একচুয়ালি দীর্ঘ দিন ইয়ামাহার স্মুথ সাউন্ডের সাথে অভ্যাস্ত থাকাতে এটা বিরক্ত লাগাটাই আমার কাছে স্বাভাবিক ছিল। আস্তে আস্তে সাউন্ড এর সাথে নিজেকে মিলিয়ে নিলাম, বিরক্তিটাকে ভালো লাগায় পরিনত করলাম।
বাইক কেনার ৩০০ কিলোমিটার পর প্রথম মোবিল পরিবর্তন করলাম।প্রথম বার বাইকের ফুল ট্যাংক লোড করার পর (১৭.৫ লিটার) মাইলেজ পেয়েছিলাম মাত্র ২৬-২৮ কিলো পার লিটার। যেটা আমার কাছে ছিল তীব্র হতাশাজনক। আমি সার্ভিস সেন্টার এ কথা বললে উনারা আমাকে ১০০০/১২০০ কিলো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলল। আর নতুন বাইক, নতুন ইঞ্জিন এমনিতেও একটু বেশি ফুয়েল খায়। অপেক্ষার পর মাইলেজ পাচ্ছিলাম ৩৪-৩৮ কখনো কখনো ৪০।
Lifan KPR 150cc প্রথম প্রথম বাইকের ফুয়েল ট্যাংক খুব গরম হয়ে যেতো,প্রায় ২ হাজার কিলো পর অটোমেটিকলি এর সমাধান হলো। সবচেয়ে বেশি যে সমস্যাটা ভুগিয়েছিল আমাকে সেইটা হলো বাইকের স্টার্ট অফ হয়ে যাওয়া। আরপিএম আইডল এ থাকতো না,অটো কমে যেত। হুট হাট রানিং অবস্থায় ইঞ্জিন অফ হয়ে যেত। তখনকার অই লটের প্রায় বেশিরভাগ বাইক গুলোতেই এই সমস্যাটা দেখা দেয়। চট্টগ্রামে সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার না থাকায় প্রায় দীর্ঘ দিন এই সমস্যা নিয়ে আমাকে চলতে হয়। এরপর রাসেল ইন্ডাস্ট্রি থেকে চট্টগ্রাম এর জন্য আলাদা ও স্থায়ীভাবে একজন সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার দেয়ার পর এই সমস্যার সমাধান হয়।
চট্টগ্রাম এ তখন হাতে গোনা কয়েকটা কেপিয়ার ছিল, আর এ কয়েকটা কেপিয়ারের জন্য স্থায়ীভাবে একজন সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দেয়াটা রাসেল ইন্ডাস্ট্রির আফটার সেলস সার্ভিস এর এক দারুন দিক বলে আমার মনে হয়। এছাড়াও বেশি বেশি কক্সবাজার আর চট্টগ্রামের আশেপাশে সি-বিচ গুলোতে বাইক নিয়ে গিয়ে নোনা পানিতে বাইক চালানোর কারনে ১২-১৩ হাজার কিলোতে আমার বাইকের চেসিস এ জং পড়ে।ব্যাপারটা আমি রাসেল ইন্ডাস্ট্রি তে জানালে উনারা আমার সম্পূর্ণ বাইকের চেসিস সাইলেন্সার সহো আবার রি-পেইন্ট করে দেয়।
শহড়ের মধ্যে ধীরে সুস্থে ৯০০ কিলো অনেক কষ্টে ব্রেক ইন পিরিয়ড মানার পর চলে গেলাম প্রথম লং ড্রাইভ এ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার -টেকনাফ এ। প্রায় ৬০০+ কিলো রাইড করে যখন বাসায় ফিরলাম তখন ওডো ১৫০০+। আর Lifan KPR 150cc মূল জিনিস, মানে এর পারফরমেন্স তখন থেকেই দুর্দান্ত ভাবে উপভোগ করতে লাগলাম। আমার বাইকটা শহরের ভেতর তেমন একটা চালানো হয়নি, ওডোর ১৬৭০০ এর মধ্যে ১৩-১৪ হাজার ই ছিল হাইওয়ে তে। লুকস এর ব্যাপারে কেপিয়ার বরাবরই এগিয়ে থাকবে। এর হেডলাইট আর পারকিং লাইট অন্যরকম এর ভালোবাসার সৃষ্টি করে। এটার হেডলাইটের আলো এক কথায় অসাধারন,কিন্তু কুয়াশার মধ্যে এই এল ই ডি প্রোজেকশন হেডলাইট ই আমাকে কুপোকাত করে ছেরেছিলো।
ইন্ডিকেটর লাইট গুলোও খুব শক্ত ও, মজবুত এটা প্রায় ১৬০ ডিগ্রি এঙ্গেল এ বাকা হতে পারে। বডি কিট যথেষ্ট শক্তপোক্ত।কেপিয়ারের ডুয়াল ডিস্ক ব্রেকং সিস্টেম একেবারে অসাধারন না হলেও খুবই ভালো মানের। তবে স্টক এর ব্রেক প্যাড ছিল একদম বাজে কোয়ালিটির যা কিনা নতুন অবস্থায় বাইকের ডিস্ক খেয়ে ফেলতো আর কিচ কিচ শব্দ করতো, যেটা খুবই বিরক্তিকর। ভার্সন ১ এর টায়ার নিয়ে আমার খুব ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। এটার গ্রিপ নাই বললেই চলে,আর বিট গুলো খুবই হারড। অভিজ্ঞ ভাইয়েরা আমাকে টায়ার চেঞ্জ করার পরামর্শ দিলেও আমি এক কথায় জিদ করেই স্টক টায়ার দিয়ে ১৬ হাজার প্লাস চালিয়েছি এবং স্টিল নাও এখনো অনেক যাবে,যেটা কিনা টায়ার এর লং লাস্টিং ক্ষমতার একটা প্রকাশ। সামনের সাসপেনশন নিয়ে কোনো অভিযোগ নাই তবে রেয়ার সাসপেনসন ভাঙা রাস্তায় খুব ভালো কাজ করে না।
Lifan KPR 150cc বাইকের সিটিং পজিশন ঠিক থাকলেও পেছনের ব্যাকসাইড টা একটু বেশিই নিচু মনে হয় আমার কাছে,তবে পিলিয়নের জন্য এটা বেশ আরামদায়ক ই বলতে হবে।কেপিয়ারের টারনিং রেডিয়াস বড়, তাই মাথা একটু কম ঘুরে। আর বাইকের ওজন অন্যান্য বাইকের তুলনায় সামান্য বেশি তাই লং রানে এটার জন্য ভালো সাপোর্ট পাওয়া যায় কোনো ধরনের ভাইব্রেটিং ছাড়া। বাইকের প্রথম ব্রেক প্যাড চেঞ্জ করি যথাক্রমে ৫/১০/১৫ হাজার পরপর,যেখানে স্টকের ব্রেক প্যাড বাদ দিয়ে সামনে এপাচি এবং পিছনে ট্রিগার এর ব্রেক প্যাড ইন্সটল করি। আর এয়ার ফিল্টার চেঞ্জ করি ৮ হাজার কিলো পর। ইউনিকর্ন এর এয়ার ফিল্টার ইজিলি লেগে যায় এতে। কুল্যান্ট ব্যাবহার করি প্রথমে ক্যাস্ট্রল এবং পরে মতুলের।
১৫ হাজার চলার পর স্টক এর চেইন স্প্রোকেট সেট চেঞ্জ করতে হয়। মোবিল মিনারেল ব্যাবহার করি হেভোলিন ৫ হাজার কিলো পর্যন্ত,প্রতি ১০০০ কিলো পর পর,,আর ৫ হাজার চলার পরে মতুল প্রতি ৩ হাজার কিলো পর পর।প্রথম ক্লাচ কেবল চেঞ্জ করি ১২ হাজার কিলো পর,যদিও চেঞ্জ না করলেও চলতো,একদম ফ্রেশ ছিল।আর এক্সিলারেটর কেবল এখনো চেঞ্জ করতে হয়নি।সামনের ব্রেক এর পিস্টন (বকেট) চেঞ্জ করতে হয় ১৫ হাজার কিমি তে। এবার আসি কেপিয়ার এর পারফরম্যান্স এ। এটার আসল ব্যাপার হলো এটার শক্তিশালী ইঞ্জিন। কেপিয়ার ৬ গিয়ার সম্বলিত লিকুইড কুল ইঞ্জিনের একটি অসাধারন পারফরমেন্সড বাইক।
আর এর পাওয়ার হাইওয়েতে না গেলে বোঝা যাবে না।প্রতিটি গিয়ার বাই গিয়ার এটার ইঞ্জিন দারুন শক্তি উতপন্ন করে। লো গিয়ার এ ইঞ্জিন একটু বেশি নয়েজ করলেও হাই গিয়ার গুলোতে বাইক মাখনের মত চলে।আর এর মূল ব্যাপার হলো ৫০-৬০ এর পর এটার স্পিড ভূতের মত উঠতে থাকে এবং কোনো প্রেসার ছাড়াই ১২৪-১২৮ উঠে।আমার ব্যাক্তিগত সরবোচ্চ স্পিড ছিল ১৩৪(ঢাকা চট্টগ্রাম হাইওয়ে)সিংগেল।আর পিলিয়ন সহো ১২৬ (পিলিয়নের ওজন ৮৫ কেজি)। টানা ১৮ ঘন্টা রাইড করেও এটার ইঞ্জিন একটু খানিও পাওয়ার লেস করেন।
Lifan KPR 150cc এটা লিকুইড কুলিং ইঞ্জিনের এক বড়ো দিক। ইঞ্জিন কে আরো প্রেসার দিতে একবার ঢাকার বসুন্ধরা থেকে কোনো জার্নি ব্রেক ছাড়াই চট্টগ্রাম জিইসির মোড় পর্যন্ত ২৭৫ কিলো রাস্তা চলে এসেছি ৩ ঘন্টা ৫ মিনিট এ। স্পিড ১০৫-১৩০ এর মধ্যে ছিল।কখনই এক্সিলারেশন ড্রপ করতে দেইনি। একই গতিতে দীর্ঘক্ষন চালিয়ে ইঞ্জিন কে চরম পর্যায় এ নিয়ে গিয়েও আমি এটার পারফরমেন্স ড্রপ করাতে পারিনি। কেপিয়ার কখনোই আমাকে হতাশ করেনি। কাদা,,পানি,,একেবারে বিরক্তিকর রাস্তায় অফরোডিং করেও কখনো এটা আমাকে মাঝ রাস্তায় বিপদে ফালায়নি (আলহামদুলিল্লাহ্)।আর এটার টপস্পিড কিছুটা বেশি হওয়াতে বাংলাদেশের প্রায় অনেক ১৫০ সিসি সেগমেন্ট এর বাইককেই পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছি বারে বার (r15,,cbr,,mslaze,,gsx,,without any primium bike)।
আর লং লাস্টিং এর কথা বললে, আমি বলবো বাংলাদেশে কেপিয়ারের প্রথম লটের প্রায় সব বাইক ই এখন ৩০হাজার + কিলোমিটার চলতেসে। কেউ কেউ আবার প্রায় ৪০-৫০ হাজারেও চলে গিয়েছেন। কেপিয়ার ব্যাবহারে অনেকের ই প্রথম প্রথম হাত ব্যাথা,বা কোমড় ব্যাথা করার ব্যাপারটা অস্থায়ী সমস্যা। কিছুদিন পর এটা আর থাকে না। কেপিয়ার নেয়ার পর পর সবচে যেই সমস্যাটার সামনে বেশি পরেছি সেটা হলো কিছু বন্ধু,, বান্ধব,যারা সব সময় এই চায়নিজ বাইক নিয়ে নেগেটিভ মন্তব্য করতে আমাকে ছাড়ে নি,,আমি তাদের অইসব দুষ্টুমি সিরিয়াস ভাবে না নিয়ে নিজের মত নিজের কেপিয়ার চালাতে থাকি।
এতে বেশ কিছুদিনের মধ্যেই আমি আমার পাশে আরো বেশ কিছু রাইডার পাই যারা Lifan KPR 150cc নিতে ইচ্ছুক এবং নিয়েছে।আসলে ২ লাখ টাকার বাজেট এ ওভারল সব দিক বিবেচনা করলে KPR is the value of money আর হ্যা কিছু ক্ষুত কেপিয়ারে আছে,, যেটা কিনা প্রায় সব বাইকেই কমবেশি বিদ্যমান।অই সকল ছোট খাটো সমস্যা আর ব্র্যান্ড নিয়ে খুতখুতে না হলে আমি বলবো দুই লাখ টাকার বাজেট এ এখন বাংলাদেশের সেরা বাইক কেপিয়ার (ব্যাক্তিগত মতামত)। ধন্যবাদ, এতদূর কষ্ট করে পড়ার জন্য। এটা আমার সম্পূর্ণ ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে লেখা তাই ভুল ত্রুটি চোখে পরলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ রইলো। আর "ভালো থাকুন আপনি, ভালো থাকুক আপনার বাইকটি" হেলমেট ব্যাবহার করুন নিরাপদে বাড়ি ফিরুন।
লিখেছেনঃ Mahabub Alam Ringku