পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার ঘুরে আসলাম দুই বন্ধু এবং একটি বাইক!
This page was last updated on 08-Jul-2024 08:43pm , By Shuvo Bangla
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার ঘুরে আসলাম দুই বন্ধু
আমি, আরিফুল ইসলাম, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স শেষ করে দুই বছর হল রংপুরে পারিবারিক ব্যাবসা দেখাশোনা করছি এবং সেই সাথে একজন বাইক প্রেমিক। তবে, দূরন্ত গতিতে ছুটে চলা, রিস্কি ওভার টেকিং করা বা বাইক নিয়ে স্টান্ট করার মত দুঃসাহসিক ইচ্ছা বা আগ্রহ আমার কখনই ছিল না আর নেই ও। আমার আগ্রহ আমার নিজের প্রিয় বাইকটিকে নিয়ে বেরিয়ে পরা আর সীমান্তের পর সীমান্ত পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানো, তা যত দূর ই হোক না কেন !!
এক কথায় বলতে পারেন আমি ভ্রমনপ্রিয়। নিজের এই আগ্রহকে পূঁজি করেই এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি ছোট-বড় সফরও করে ফেলেছি যার মধ্যে ছিল ডায়াং ৮০ সিসি নিয়ে দুইবার দিনাজপুর, TVS Metro 100 cc নিয়ে বগুড়া ও রাজশাহী, ইয়ামাহা SZR 153 cc নিয়ে সিরাজগঞ্জ, ভুরুংগামারীর ব্রক্ষপূত্র নদের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল, ইয়ামাহা FSZ v1 নিয়ে বাংলাবান্ধা এবং সাথে আরও কিছু মনে রাখার মত ছোট ভ্রমন।
তবে এগুলোর কোনটা নিয়েই লেখা হয়নি, যদিও, সবগুলোর সাথেই স্মৃতি আছে অনেক, সাথে আবেগও। বিশেষ করে TVS Metro 100 cc নিয়ে রাজশাহী সফর করেছিলাম আমার বাবাকে সাথে নিয়ে একটি সরকারী কাজে ২০১৪ সালের মাসব্যাপী অবরোধের সময়!! Can YOU Imagine!! ৬৫ উর্ধ একজন মানুষ দিনে ২০০ কিমি এর অধিক মটর সাইকেলে করে সফর করেছেন !!
আবার ফিরেছেনও সমদূরত্ব। বাবাকে পিছনে নিয়ে রংপুর থেকে ফেব্রুয়ারী মাসের তীব্র শীতের মধ্যে রাজশাহী গিয়ে আবার ফিরে আসার মধ্যে কত যে স্মৃতি !! তাও আবার রওয়ানা দিয়েছিলাম ১৪ ই ফেব্রুয়ারী, আমার বিয়ের পর প্রথম ভালবাসা দিবসের দিন সকাল বেলা !!! এতদিন লিখিনি, তখন বাইক বিডি সম্পর্কে জানা ছিল না। নতুবা, নিজের প্রিয় অনূভূতির কথা সবাইকে বলতে কে না চায়। তাই আজ জানাবো, হয়ত এমন কিছুই না, বাইক বিডির বাঘা বাঘা রাইডারদের তুলনায় তো বটেই!!
গত পরশু ২২ এ জুলাই, ২০১৭, আমি আর আমার বন্ধু জিওন মিলে ঘুরে আসলাম জুয়পুরহাট জেলার পাহাড়পুরের বৌদ্ধ বিহার থেকে। সফরটি বেশী দূরের না। যাওয়া আসা মিলে ২৬০ কিমি এর কিছু বেশী। তবে আমার কাছে বেশ তৃপ্তিদায়ক ছিল, কারণ, বেশ কয়েক মাস হল লম্বা কোন সফরে যাওয়া হয়নি। আর বন্ধুদের মধ্যে যারা এর আগে সঙ্গী হয়েছিল তাদের কেউ নতুন বিবাহিত আবার কারও ব্যাস্ততা, সব মিলিয়ে যাওয়ার পরিবেশটা পাচ্ছিলাম না। অবশেষে জিওনকে বললাম।
চাকরির একঘেয়েমি আর সাময়িক অসুস্থতার পর জিওন ও চাচ্ছিল একটু ঘুরে আসতে। ব্যাস, ব্যাটে-বলে এক হয়ে গেল! আমাদের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল হিলি পর্যন্ত যাওয়া। তবে জয়পুরহাট যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম হিলি যাওয়ার পর। আগের দিন সন্ধ্যায় রবার্টসনগঞ্জ স্কুলের মাঠে আমি আর জিওন বসে ঠিক করলাম ভ্রমনের পরিকল্পনা। জিওনের বাসা মন্ডলপাড়া, রবার্টসনগঞ্জ এর সাথেই। আর রবার্টসনগঞ্জ হল আমার নানাবাড়ি।
সুতরাং আমাদের আড্ডাটা রবার্টসনগঞ্জ স্কুলের মাঠে বরাবরই ভালই যমে। সে যাই হোক, ঠিক হল পরের দিন সকাল ৭ টার মধ্যেই আমরা রওয়ানা দিব। আগেই বলেছি, আমি ভ্রমন করতে ভালবাসি, গতির ঝড় তুলতে নয়। সকাল সকাল বেরিয়ে পরার সুবিধা মূলত দুটি। মোটামুটি স্বাভাবিক গতিতে রাইড করে গন্তব্যে পৌছে ফিরে আসা যায়, তেমন একটা হুরোহুরি থাকে না আর পুরো সফরের মধ্যে রিলাক্সড হওয়ার জন্য বিরতি নেয়া যায় আবার চাইলে ছবিও তোলা যায়।
সবকিছু ঠিকঠাক করার পর দুজনে মিলে চা খেলাম। এর মাঝে আরও কিছু প্রয়োজনীয় কাজ শেষে বাড়ি ফিরলাম। রাতেই আমার YAMAHA FZS V1 এর ট্যাঙ্ক ফুল করে নিলাম। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর আমার বিবিকে বললাম আমাদের পরিকল্পনার কথা, যার রি-আকশন টা অনুমিতই ছিল। সুতরাং খুব বেশী কথা না বারিয়ে শুয়ে পরলাম। ভোর ৫.০০ টার দিকে ঘুম ভাঙার পর প্ল্যান অনুযায়ী জিওনকে ফোন দিলাম।
ধরলনা…… তবে কি…… চিন্তা না করে ফ্রেশ হয়ে বউকে ঘুম থেকে তুললাম। বিরক্ত হলেও একটা ফরমালিটি আছে না!! হাজার হউক স্বামী বাহিরে যাচ্ছে (ঘুরতে!!!)। এতদিন পর দুই বন্ধু মিলে ঘুরতে যাচ্ছি, তাই একটু ফ্যাশনেবল হওয়ার জন্য বউয়ের দ্বারস্থ হলাম। যাই হোক, খুব ক্যাজুয়াল পোশাক নির্বাচন করার পরপরই বন্ধু জিওনের মোবাইল। যাক……… ছেলে তাহলে বড় হয়েছে !! সুতরাং আর দেরী না করে ঝটপট রেডি হয়ে বের হলাম।
ও হ্যাঁ, আমার বাবুটা তখন ঘুমাচ্ছিল, তাই আর বাসা থেকে বের হওয়ার সময় পা জড়ায় ধরে কান্নাকাটি করার ঝামেলা নাই, তারপরও মেয়ে বলে কথা! আলতো করে আদর করে আর দেরী করলাম না। আমাদের বাসার চার স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী (!!) পার হয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে সোজা চলে এলাম মন্ডল পাড়া মোড়ে। ৫-৬ মিনিটের মধ্যে জিওন এসে উপস্থিত।
আমাদের দুজনের দেখা হলে, খুব বেশী ভারী পরিবেশ না হলে, প্রথমেই একে অপরকে দেখে নির্ভেজাল বেকুবের মত কিছুক্ষণ হাসাহাসি করি। সেদিন ও তার ব্যাতিক্রম হল না। অতঃপর দু-চারটা ছবি তুলে দিলাম রওয়ানা, মানে হিলির পথে যাত্রা শুরু। সকাল ৬.১৫, আবহাওয়াটা খুব আরামদায়ক (আগের দিন বেশ বৃষ্টি হয়েছিল)। আমাদের যাত্রা ঠিক আমাদের প্লান অনুযায়ীই শুরু হল।
মন্ডল পাড়া দিয়ে বের হয়ে, রবার্টসনগঞ্জ মসজিদ মার্কেটের সামনে মোড় ঘুরে, বাবুপাড়া রেলক্রসিং পার হয়ে ডানে মোড় নিয়ে সোজা আশরতপুর দিয়ে বের হয়ে ঢাকা-রংপুর হাইওয়েতে উঠলাম। মডার্ণ মোড় ক্রস করে সোজা মিঠাপুকুরের দিকে বাইক ছুটালাম। এই বছর ভারী বৃষ্টিপাতের পর ঢাকা-রংপুর হাইওয়ের অবস্থা খুবই শোচনীয়। কিছুদূর পরপরই এবড়ো-থেবড়ো রাস্তা আর তার সাথে খানা-খন্দ।
সুতরাং খুব কেয়ারফুলী বাইক চালাতে হয়। তারপরও সকাল বেলায় রাস্তায় বড় গাড়ীর তেমন একটা চাপ না থাকায় ৬০-৬৫ গতিবেগে বাইক চালাচ্ছিলাম। বাইকের মবিলটা একটু পুরনো হওয়াতে low RPM মেইনটেইন করার একটা চেষ্টা ছিল। আর তাছাড়া হাতে যথেষ্ট সময় ও ছিল। সুতরাং আমরা দুজনেই বেশ ফুরফুরে মেজাজে ছিলাম। সকাল ৭ টা নাগাত আমরা মিঠাপুকুর পৌছালাম। সেখানে ১০ মিনিটের মত বিরতি নিয়ে ফুলবাড়ী রোড ধরলাম।
Now, it is called the thrill of a real bike tour with a moderate speed and a fantastic weather. বাংলাদেশের যে কয়েকটা সুন্দর রাস্তা আছে তার মধ্যে এইটা অন্যতম। এমনিতেই এই রাস্তায় গাড়ী খুব একটা চলে না শুধু ভারী ট্রাক ছাড়া, তার উপর সকাল বেলা রাস্তা একেবারেই ফাঁকা। সুতরাং, ৭৫-৮০-৮৫ গতিবেগের মধ্যেই বাইক রাইড করতে লাগলাম। আমি আসলে খুব জোড়ে বাইক চালাতে খুব একটা পছন্দ করি না, কারণ এতে খুব Attention ধরে রাখতে হয়, আর তাতে চার-পাশের মজাটা নেওয়া যায় না।
তাই ৭৫-৮০-৮৫ গতিতেই চালাচ্ছিলাম, আর এতে চার-পাশের গাছের সারি আর সবুজ ক্ষেত আর তার মাঝ দিয়ে ঝকঝকা রাস্তা দিয়ে ফুরফুরে মেজাজে বাইক চালিয়ে অসম্ভব আনন্দ লাগছিল। আর সাথে জিওনের গুনগুন কন্ঠের গান। ওহ ! ফাইন !! সকালে নাস্তা করে বের হইনি। আর জিওনের একটু সমস্যা হছিল। তাই আমাকে দাঁড়ানোর জন্য বললেও আমি একটানে ফুলবাড়ী এসে ব্রেক দিলাম।
মিঠাপুকুর থেকে ফুলবাড়ী ৩৩ কিমি। আর আমাদের আসতে সময় লাগল ২৫ মিনিটের মতন। ঘড়ির কাটা তখনও ৮ টা পার করেনি। হাইওয়ের বাম পাশে মিলন হোটেলে ঢুকলাম নাস্তার জন্য। এইটা তেমন কোন বড় হোটেল না, এক কথায় রোড সাইড রেস্টুরেন্ট। কিন্তু এখানে ট্রাক চালকরা দাঁড়ায়, আর আশে পাশে এরকমই আরেকটা ছাড়া আর কোন হোটেল নাই শহরের ভিতর ছাড়া।
তাই, রোড সাইড হলেও রান্নার মান অত্যন্ত ভাল স্বাদের দিক দিয়ে। এক্কেবারে প্রবেশ মুখেই কড়াইয়ের উপর গরুর গোস্ত। আর পাশে তাওয়ার উপর চলছে গরম পরাটা ভাজার কারবার। আরে মামু, আর যায় কোথায়। পটাপট হাত-মুখ ধুয়ে অর্ডার দিলাম গরম পরাটা আর গরু ভুনা। শুনেই খেতে ইচ্ছে করছে না !! জি, আমাদেরও ক্ষিদে দ্বিগুণ হয়ে গেল। আর রোড সাইড বলেই হয়ত হোটেল মালিকের আপ্যায়ন করার মানসিকতাটা ভাল!!
নাহলে, ফুড ভিলেজ, হাই-ওয়ে ভিলা বা এরিস্টোক্রেট এ যা দেয়, অন্তত এই মামু মার্কা হোটেলে তার চেয়ে পরিমাণও প্রায় দ্বিগুণ আর স্বাদও ঢের ভাল। সময় নিয়ে তৃপ্তি সহকারে খেলাম। সকালের নাস্তার বিল ই আসল ৩০০ টাকার কাছাকাছি। তবে, মন থেকে বলছি, শেষ কবে এত মজা করে পরাটা আর গরু ভুনা খেয়েছি আমার মনে নেই। যাই হোক, বাহিরে চা খেয়ে কিছু ছবি তুলে আবার যাত্রা শুরু করলাম। এইবার, চালক বদল।
জিওনকে দিলাম আমার বাইক। যদিও মনে একটু খুত খুত করছিল, কারণ, জিওন রেগুলার বাইক না চালানোতে ওর গিয়ার শিফটিং এ একটু সমস্যা হয়। অতঃপর ফুলবাড়ী থেকে পুনরায় যাত্রা শুরু করলাম। ফুলবাড়ী থেকে বিরামপুর পথের প্রথম ২-৩ কিমি রাস্তা একটু খারাপ, বেশ ঝাঁকি খেলাম। তারপর রাস্তা আবার ভাল। তখনও সকাল সকাল ভাবটা পুরোপুরি কাটেনি, আর এভাবেই আমরা পৌছে গেলাম বিরামপুর।
বিরামপুর থেকে ডানদিকে টার্ণ নিয়ে হিলির দিকে যেতেই বেশ ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করল। জিওন বাইক ব্রেক করল ছবি তোলার জন্য। কয়েকটি ছবি তুলে আবার আমিই বাইক চালানো শুরু করলাম। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা হিলিতে চলে আসলাম।
ঘড়ির কাঁটা তখন প্রায় ৯.৩৫, তাই হিলি বন্দরের ব্যাস্ততা শুরু হতে তখনও বেশ সময় বাকি। আমরা সরাসরি চলে গেলাম হিলি বর্ডারে, যেখানে ইমিগ্রেশন হয়। বাংলাদেশের অন্যতম ব্যাস্ত এবং নামকরা স্থল বন্দরের শেষ সীমান্তে দাঁড়িয়ে আমাদের বেশ ভালোই লাগছিল। আনন্দটা আরও বেশী লাগছিল এত সকাল সকাল চলে আসাতে।
অবশ্য এত সকালেও ভারতের সীমান্তে বিএসএফের কার্যক্রম মোটামুটি শুরু হয়ে গিয়েছিল, তবে বাংলাদেশের সীমান্তে কর্মকান্ড সেই তুলনায় বেশ হালকাই মনে হল। তখনও বিজিবির কোন সদস্যকে আমরা সীমান্তের কাছে পাইনি। তবে, রেললাইনের পাশে দু –তিনটি টহল ঘরে দু-একজনকে দেখা গেল। এত কাছ থেকে দুটি আলাদা দেশ, দুটি আলাদা জাতি, দুটি আলাদা সংস্কৃতির কার্যক্রম আমরা বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছিলাম, বেশ উপভোগও করছিলাম।
যদিও আমাদের সাথে পাসপোর্ট ছিল না, কিছুটা শীথিলতার সুযোগ নিয়ে আমরা বর্ডারের একেবারে শেষ লাইনে এসে ব্যারিকেডে হেলান দিয়ে দুই সীমান্তে মানুষের আগমন-বহির্গমন দেখছিলাম। এত কাছাকাছি, তারপরও বেশ কিছু ভিন্নতা আমাদের চোখে পড়ল। বিশেষ করে, সীমান্তের ঠিক ওইপারে পাতিরাম পেট্রোল পাম্পের পুরনো বিল্ডিং আর দুটি পুরনো এম্বেসেডর গাড়ী ভারতীয় ঐতিহ্যের কথা বেশ ভালোই মনে করিয়ে দিল।
এভাবেই সীমান্তের কাছে প্রায় এক ঘন্টা কাটানোর পর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম জয়পুরহাট যাব, কারণ সময় আছে অনেক আর জয়পুরহাট মাত্র ২৫ কিমি। আমার প্রিয় বাইকটির সাথে সীমান্তের নিকটে কয়েকটি ছবি তুলে যাত্রা শুরু করলাম জয়পুরহাট অভিমুখে।
হিলি থেকে জয়পুরহাট যেতে প্রথমে পাঁচবিবি পরে। উত্তরবঙ্গের বেশ ব্যাস্ত একটি উপজেলা। এতক্ষণ আমরা হাইওয়েতে ছিলাম। এবার প্রবেশ করলাম লোকাল রোডে, তবে রাস্তা বেশ ভাল। সরু রাস্তার দুইপাশে ঘন সবুজ গাছ আর ক্ষেত। বেশ ভালই লাগছিল বাইক চালাতে। গতিও কিছুটা কমিয়ে ৫৫-৬০ এর মধ্যেই রাখলাম। সকাল ১১ টা নাগাত আমরা চলে আসলাম পাঁচবিবি। জিওনের কিছুটা সমস্যা হওয়াতে ব্রেক দিলাম।
জিওন চা খেল, আমি আর কিছু খেলাম না। ১০ মিনিটের বিরতি দিয়ে একটানে চলে আসলাম জয়পুরহাট শহরে। তখন বাজে ১১.৪৫ টার মতো। জয়পুরহাট বেশ লম্বা শহর। আমরা মেইন রোড দিয়ে রেকি করে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের পিছনের বড় মাঠে এসে দাঁড়ালাম। উদ্দেশ্য, কিছুটা সময় জিরিয়ে নেওয়া। আমি মাঠে ছেলেদের খেলা দেখছিলাম, এরই মাঝে জিওন গাছে হেলান দিয়ে ২০ মিনিটের মত ঘুমিয়ে নিল!!
বেচারার এত সকালে বের হয়ে একটু অসুবিধাই হয়ে গেছে। যাই হোক, সেখান থেকে বেরিয়ে সরকারী ভবনসমূহের চারপাশে চক্কর মেরে চলে আসলাম জয়পুরহাট সরকারী ডিগ্রি কলেজে জিওনের একজন পাড়াত ভাইয়ের সাথে দেখা করতে। উনি কলেজের ইংলিশের শিক্ষক। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর আসলেন উনি। বেশ ভদ্রলোক, পরিপাটি পোশাক আর বন্ধুসুলভ চেহারা। আমাদেরকে নিয়ে গেলেন ওনার বাড়িতে।
হালকা আপ্যায়ন আর গল্পের পর দেরী না করে বেরিয়ে পড়লাম পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের উদ্দেশ্যে। আমরা আসলে বৌদ্ধ বিহারের কথা চিন্তাও করিনি। ওই ভাই বললেন কথাটা, তখন আমাদের খেয়াল হল! অতঃপর পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের পথে যাত্রা শুরু। তখন প্রায় দুপুর ১.৩০ টা। রাস্তা কিছুটা খারাপ থাকায় ১৫ কিমি যেতে আমাদের সময় লাগল প্রায় এক ঘণ্টা। বাইক গ্যারেজে রেখে দেরী না করে আমরা বৌদ্ধ বিহারের প্রবেশ করলাম।
সে এক বিশাল এরিয়া। আমরা প্রথমেই গেলাম যাদুঘরে। সেখান থেকে বের হয়ে হঠাত রোদের ভিশন তেজ। আর শরীরিটাও টানছিল না। তাই দুটি লম্বা বসার বেঞ্চে আমরা পড়লাম শুয়ে। কিছুটা সময় বিশ্রামের পর বিহারের টিলার মত অংশটার কাছে গেলাম। বেশী সময় থাকলাম না কারণ ফিরতে হবে। বের হওয়ার আগে দুজনে মিলে পেয়ারা মাখা খেলাম। বের হয়ে একটা রেস্টুরেন্টে কোল্ড ড্রিংকস খেয়ে ফিরতি যাত্রা শুরু করলাম।
তখন ৩.৩০ টা পার হয়ে গেছে। জিওনের ক্ষিদে লাগলেও ভাঙ্গা রাস্তার কথা চিন্তা করে আমি আর কিছু খেলামনা। ফেরার পথে জিওনের পায়ের সমস্যার কারনে ১০-১৫ কিমি পরপরই থামতে হচ্ছিল। আর তাই হিলি আসতে একটু দেরী হয়ে গেল। বিকাল ৫.৩০ টার দিকে আমরা হিলি আসলাম।
বাজারের ভিতরে কিছুক্ষণ ঘুরে দুজনে খিচুড়ি আর মুরগীর মাংস খেয়ে আবার রওয়ানা দিলাম। সোজা চলে আসলাম বিরামপুর হয়ে ফুলবাড়ী। আমার কিছুটা জড়তা লাগাতে চা খেলাম। তারপর আর সময় নষ্ট না করে মিঠাপুকুরের দিকে ছুটলাম। ততক্ষণে মাগরিবের আযান দিয়ে দিয়েছে। সন্ধ্যার পর অন্ধকারও নামতে শুরু করেছে। এদিকে আমার বাইকেরও একটু সমস্যা হয়ে গেল।
ব্যাটারির সাথে ফিউজের সমস্যার কারণে হেডলাইটের আলো একেবারে কমে গেল আর সাথে হর্ণ ও কাজ করছিল না। সকালের তুলনায় রাস্তার দুপাশে বেশ লোকজনও ছিল, তাই খুব কেয়ারফুলি চালাতে হচ্ছিল। জিওনের পায়ের সমস্যার কারণে দু-তিনবার থামতেও হল। তাই মিঠাপুকুর আসতে রাত ৮ টা বেজে গেল। বেশী দেরী করার সুযোগ ছিল না।
কারণ, একেতো বাইকের হেডলাইটের আলো নিভু নিভু অবস্থা; তার উপর হর্ণ ও একেবারে বাজছিল না। মিঠাপুকুর থেকে রংপুর পর্যন্ত রাস্তাও বেশ খারাপ, দিনের বেলা আসতে তেমন একটা বেগ না পেলেও রাতের বেলা যে ভালই সমস্যা হবে সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম। এসব কিছু মাথায় রেখেই শেষবারের মত বাইক স্টার্ট দিলাম, ও হ্যা, ফিউজ কাজ না করাতে ধাক্কা দিয়ে স্টার্ট করতে হল !!!
অনুমান ভুল ছিল না। কিছুদূর এগোতেই অল্প আলোতে খানা-খন্দে ভরা হাইওয়েতে রাইড করা কতটা কঠিন টের পেলাম। কিছুদূর পরপরই ভালোই ঝাঁকি খাচ্ছিলাম। একেতো দেখতে পারছিলাম না ঠিকমত, তার উপর হর্ণ না থাকায় সামনের ভ্যান, অটোরিক্সার কারণে চালাতেও সমস্যা হচ্ছিল। রাতের বেলা হাইওয়েতে ভারী যানবহনের চাপ ছিল অনেক বেশী। বলে রাখা ভাল, ঢাকা-রংপুর হাইওয়ের এই অংশটুকু খুবই দূর্ঘটণা প্রবণ।
গাড়ীর গতি থাকে অনেক, রাতের বেলা ঢাকামুখী নাইট কোচের বেপরোয়া ওভারটেক আর পিছন থেকে আসা যানবাহনের গর্ত এড়াতে বামে সরে আসা – সবমিলিয়ে কম আলোতে বাইক চালাতে আমার বেশ কষ্ট হচ্ছিল। দুইবার তো নাইট কোচের বামপাশে অস্বাভাবিক সরে আসার কারণে রাস্তা থেকে অনেকটাই নেমে যেতে হয়েছিল। এভাবে প্রায় ১০ কিমি আসার পর বলদিপুকুর থেকে রাস্তা মোটামুটি ভাল।
সুতরাং, এতক্ষণের জড়তা কেটে বাইক কিছুটা ছুটাটে পারলাম। আসলে, মহাসড়ক যতই ব্যাস্ত হোক, রাস্তা ভাল হলে সময় বেশী লাগলেও নির্বিঘ্নে চালান যায়। যাই হোক, রাত ৮.৪৫ নাগাত আমরা রংপুর মডার্ণ এসে পৌছালাম। খারাপ লাগল জিওনকে বাড়ী পৌছে দিয়ে আসতে না পারার জন্য। আসলে ওর পায়ের রগ বার বার টেনে ধরছিল আর মহাসড়কে ব্রেক দেওয়ার মত অবস্থা ছিল না।
তাই, মডার্ণে নেমে জিওন রিক্সা নিয়ে বাড়ী চলে গেল। আমিও আর কোথাও দেরী না করে চলে আসলাম ঠিকাদারপাড়ায় আমার বাসায়।
আমাদের এই ভ্রমণ আমরা বেশ উপভোগ করেছি তাতে কোন সন্দেহ নেই। সকালের সুন্দর আবহাওয়াতে বাইক রাইডিং, ফুলবাড়ী থেকে জয়পুরহাট পর্যন্ত চমৎকার রাস্তা, সকালের মজার নাস্তা, হিলি সীমান্তের কার্যক্রম, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের বিশাল আয়তন – সবই মোটামুটি উপভোগ্য ছিল। আসার সময়টাতেও খারাপ লাগেনি। তবে জিওনের জন্য একটু খারাপ লাগছিল।
ওর পায়ের সমস্যা না হলে পুরো জার্নিটা আরো আনন্দের হত। যা হয়েছে তাও অনেক। জিওন না থাকলে আমি একাতো আর আসতাম না। আমি আশা করি জিওনের এই সমস্যা দ্রুতই সেরে উঠবে। আর সামনে আমরা ইনশাল্লাহ রাজশাহী, নাটোর, যমুনা রিসোর্ট ভ্রমণ করব। আর আমার ইচ্ছে আছে টেকনাফ পর্যন্ত ৭-৮ দিনের একটা লম্বা ট্যুর দেয়ার। জিওন গেলে আরও ভাল।
আমার বাইক প্রেমীক বন্ধু আরও দু-চারজন আছে, কিন্তু, ওরা ইদানিং ব্যাস্ততার কারণে সময় বের করতে পারে না। এদিক দিয়ে জিওনের কোন সমস্যা নেই। পায়ের একটু সমস্যা, ব্যায়াম করে সেটা দ্রুত কাটিয়ে উঠবে আসা করি। তাহলে ওকে নিয়ে আবার বেরিয়ে পরব। আমি চেষ্টা করব। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা । আমার বাইকের কথাতো বলাই হল না। বাইক ঠিকই আছে, এর মধ্যে মবিল পাল্টিয়েছি, ফিউজ ও ঠিক করিয়েছি। আমার বাইক এখন আবার ট্যুর দিতে প্রস্তুত। এখন শুধু সময়, সুযোগ আর সঙ্গীর অপেক্ষা।
লিখেছেনঃ আরিফুল ইসলাম