Last updated on 28-Jul-2024 , By Saleh Bangla
আমি আসিফ জাহান (Asif Jahan)। বয়স:২৯ এবং প্রাইভেট কোম্পানিতে ছোট-খাট চাকরিজীবী | আমার একটি বাইকের শখ অনেক ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু স্বাধ্যের মধ্যে কিছুই পাচ্ছিলাম না। তারপর শুনলাম
Runner Bike RT এর কথা। বাইকটি কেনার আগে বন্ধুর সাথে আমার কিছু আলোচনা করেছিলাম।
রানার বাইক আরটি ৮০০ কি.মি মালিকানা রিভিউ
"আমি একটা বাইক কিনতে চাচ্ছি, ৬২ হাজার পরবে
-এক লাখ ৬২?
-না শুধু ৬২
-সেকেন্ডহ্যান্ড ?
-না ব্র্যান্ড নিউ
-কি কস ব্যাটা ! এত কমে তোরে বাইক কে দিব ?
-রানার, তাও আবার কিস্তিতে "
অনেকটা এইরকমই ছিলো আমার আর আমার এক বন্ধুর কথোপকথনটা | আমি নিজেও কিছুটা সন্দিহান ছিলাম যখন আমি বাইকটার ব্যাপারে প্রথম জানি | এত কমে বাইক ! ভালো তো ? অনেক ঘেটেও নেটে রানার বাইক আরটি নিয়ে তেমন আহামরি কোন ইনফরমেশন পেলাম না |
নতুন বাইক, তাই কোন রিভিউ ও নাই বলা চলে; এমনকি রানারের সেলস ডিপার্টমেন্ট এর কাছেও কোন সঠিক ইনফরমেশন পাই নাই কেবল মাত্র এটা ৮৬ সিসির বাইক আর দাম ৬২ হাজার বাদে |
হঠাৎ করেই ছোট বেলার ধামাচাপা দেয়া সখটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল গত বছর আগস্টের দিকে | সাধ ছিল কিন্তু সাধ্য ছিল না | তাই ইউটিউব আর দেশি মোটরসাইকেল সাইটগুলোতে ঘাটাঘাটি করে দুধের সাধ ঘোলে মেটাতাম | এভাবেই একদিন চোখে পরল রানারের আরেকটা বাইকের রিভিউ, দাম ও কম আবার কিস্তিও আছে! আগ্রহ আরো বাড়ল বাইক আরটি এর কথা পড়ে |
বাসায় রাজি করানো, বন্ধুদের রাজি করানো ও মোটামুটি শেষ এখন বাইক পছন্দ করার পালা | মনে মনে রানার চিতা নেয়ার প্লান করেই সেপ্টেম্বরের এক শুক্রবার রানারের কাজিপাড়া শো-রুমে যাই | চিতা স্টকে নাই তাই ফর্ম ফিলাপ করে অন্য বাইকগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম | তখনি নজর কাড়ল রানার বাইক আরটি, আর কাড়বেই বা না কেন ? দেশি ম্যানুফ্যাকচারার গুলোর মধ্যে এত সুন্দর ডিজাইন খুব কমই দেখা যায় |
প্রথমেই বলে নেই, আমি লম্বায় 5'6" হলেও পাটকাঠি টাইপ শুকনো | তাই ভারী বাইকগুলোতে মোটেও কমফোর্টেবল ফিল করিনা | কিন্তু আরটির ব্যাপারটা পুরোটাই অন্যরকম , বসার সাথে সাথেই কেমন যেন নিজের নিজের মনে হল |
ছোটখাট কিউট কিন্তু চড়ে বসলে আলাদা একটা কনফিডেন্স পাওয়া যায় | তো পুরাই কনফিউজড হয়ে বাসায় আসলাম, রিভিউ আর এক্সপার্ট অপিনিয়ন বলে চিতা কিংবা ডিলাক্স আর মন বলে আরটি | শেষমেশ মনেরই জয় হল, নভেম্বর এর ১০ তারিখ আমার সেজো খালা আর বন্ধু রুমিকে গ্যারান্টর হিসেবে নিয়ে গিয়ে নিয়ে আসলাম আমার লালপরিটাকে |
রানার বাইক আরটি কেনার আগে বাইক চালানোর অভিজ্ঞতা মাত্র ১০ মিনিটের, কিন্তু সাইকেল চালানোর অভিজ্ঞতা থাকায় কিছুটা সাহস পাচ্ছিলাম মনে মনে | প্রথম ৪০০ কিলো এলাকাতেই চালিয়ে হাত পাকিয়ে নেই, এর পর আস্তে আস্তে ঢাকার রাস্তায় ওঠার সাহস হয় |
প্রথম ১০০ কিলোমিটার তেমন কোন প্রব্লেম না হলেও ফিল করছিলাম হাতের ব্রেকটার রেস্পন্স তেমন ভালো না আর পায়েরটা ফুট পেগের লেভেল থেকে বেশ খানিকটা ওপরে তাই আনইজি লাগে একটু |
প্রব্লেমটা শুরু হল তিনদিন পর, অফিস থেকে বাসায় এসে দেখি বাইকের নিচে অনেকখানি ফুয়েল পরে আছে | তেলের টাংকি আর ফুয়েল লাইনের জয়েন্ট দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে তেল পরছে | বিপদে পরে গেলাম কারন কোন রকম কাগজপত্র ছাড়া সারভিস সেন্টারে নিয়ে যাওয়া অনেক রিস্কি আর এয়ারপোর্ট থেকে একা একা চালিয়ে যাওয়ার মত দক্ষতা তখনো আসেনি |
তাই এলাকার এক মেকানিকের কাছে নিয়ে গেলাম , সে জোড়াতালি দিয়ে কি করল ঠিক বুঝলাম না | তেল পরা বন্ধ হলেও দেখা দিল নতুন উপসর্গ , চলতে চলতে স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায় এবং ৫/৭ মিনিট সেলফ/কিক কোনভাবেই স্টার্ট নেয় না (পরে বুঝেছি ফুয়েল ফ্লোতে প্রব্লেম এর কারনে এই পেইন পোহাতে হয়েছিল) |
এই ঝামেলার কারনে মাত্র ২৪০ কি.মি.তেই এক বন্ধুকে নিয়ে কোন রকম কাগজ পত্র ছাড়াই চলে গেলাম সাতরাস্তা সারভিসিং এর জন্য | সারভিসিং এর পর প্রব্লেমটা সলভ হলেও পুরোপুরিভাবে গেলোনা | স্টার্ট আগের মত বন্ধ হয় না, ব্রেক গুলো আগের থেকে বেটার কাজ করছে, গিয়ার আগের থেকে স্মুথ কিন্তু তারপরও পুরো সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না| তাই এলাকারই আরেকটা ক্ষুদে মেকানিকের কাছে নিয়ে গেলাম |
মাত্র ৫০ টাকার বিনিময়ে মুশকিল আসান ! ব্রেক পারফেক্ট রেসপন্স করছে,
গিয়ার শিফটিং মাখন আর বাইক সকালে বের করার সময় কিক দিয়ে স্টার্ট দিয়ে ৫ মিনিট ইঞ্জিন গরম করে চালানো স্টার্ট করলে স্টার্ট বন্ধ হবার প্রব্লেমও ৯৫% সলভ (মাঝে সাঝে ক্লাচ/পিকাপ এডজাস্টমেন্টে ভুল হয়ায় স্টার্ট বন্ধ হলেও চলা অবস্থায় সেল্ফ দিলে বাইক আবার স্টার্ট নেয়) |
৮০০ কি.মি. চালানো শেষে রানার বাইক আরটি ভালো দিক আর খারাপ দিকগুলো যা পেয়েছি নিচে তুলে ধরলাম।
রানার বাইক আরটি ভালো দিক :
১. আউটলুক :লুকস বিবেচনায় আমার কাছে বাইকটি ১০/১০ পাবে | একই সাথে ইউনিক,স্টাইলিশ আর নজরকাড়া রং বাইকটিকে এই সেগমেন্টের অন্যান্য বাইক থেকে বেশখানিকটা এগিয়ে রাখে | (কত বার রাস্তায় লোকজন থামিয়ে বাইকটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছে হিসাব নেই | সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছে বাইকটা দেখতে অস্থির !)
২. স্পিড :
ব্রেকিং পিরিয়ড চলছে তাই স্পিড বেশি তোলা হয় না| তারপরও বলতে দ্বিধা নেই আর টির স্পিড আমাকে বিন্দু পরিমান হতাশ করেনি ! ৫০০ কি.মি. পার হবার পরে প্রায় প্রতিদিনই ৬০+ কি.মি./ঘন্টা বেগে চালানো হয়েছে , টপ স্পিড তুলেছি ৭৫ কিন্তু মনে হচ্ছিলো আরো উঠবে | রাস্তা শেষ হয়ে যাওয়ায় সেদিন আর তোলা হয়নি | ব্রেকইন পিরিয়ড শেষে টপস্পিড চেক করলে ৮০ কি.মি./ঘন্টা পাবো এই ব্যাপারে আমি কনফিডেন্ট |
সাথে আছে রেডি পিকআপ ! ঢাকার রাস্তায় রেডি পিকআপ গুরুত্ব আপনাদের কারো অজানা নেই | আরটি নিয়ে জ্যামের মধ্যে কিংবা পার্শ্বরাস্তায় কখনো রেডি পিকআপ এর জন্য লজ্জায় পরতে হয়নি, বরং আর দশটা ১০০ সি.সি. বাইকের সাথে তুলনা করা যায় এর রেডি পিকআপকে |
৩. কন্ট্রোলিং : নতুন চালক হিসেবে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি আরটি এর মত সহজ আর Easy to control বাইক খুব কমই আছে | বন্ধু-বান্ধব যারা এর আগে বাইক চালায়নি সবাইকে মিনিট দশেকের মধ্যে আরটি দিয়ে চালানো শিখিয়ে দিয়েছি |
ছোটখাট হবার কারনে ঢাকার নিত্যনৈমিত্তিক জ্যামে আরামসে নড়াচড়া করা যায় | সব বাইকেই কম বেশি ভাইব্রেশন হয় বেশি স্পিডে কিন্তু আর টিতে এই ভাইব্রেশনের মাত্রা খুবই কম | কেউ কেউ অভিযোগ করে পিলিয়ন সহ নাকি এটাতে কমফোর্ট পাওয়া যায় না, অত্যন্ত বিনীতভাবে তাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করছি |
পিলিয়নসহ কন্ট্রোলিং এ কোন প্রব্লেম ফেস করি নাই বরং পিলিয়ন থাকলে হাই স্পিডে খুব স্মুথলি চালানো যায় | উচা-নিচা এবড়ো-থেবড়ো রাস্তায় বহুবার চালিয়েছি বিন্দুমাত্র সমস্যা ছাড়া | ফ্লাইওভার বা ব্রিজে কোন ঝামেলা হয়না | আরেকটা কথা বিশেষ ভাবে না বললেই নয়, আর টি নতুন ড্রাইভারদের কে বাড়তি একটা কনফিডেন্স দেয় | মনে হয় যতই ভুল করিনা কেন বাইক কখনো আউট অভ কন্ট্রোল হবেনা!
Also Read: রানার নাইট রাইডার ভি২ ফিচার রিভিউ - রেস টিউনড মেশিন
৪. বিল্ড কোয়ালিটি: ব্যাপারটা হয়ত কারো কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে কিন্তু এটাই সত্যি,আর টির বিল্ড কোয়ালিটি ওভারঅল ভালো | হ্যান্ডেল বার,চেসিস,ফুটপেগ, কিংবা হেডকিট কোনটাই ঠুনকো মনে হয় না | সিটটাও আরামদায়ক আর স্টাইলিশ | সুইচ গুলো চমৎকার কাজ করছে আর অয়ারিংও স্ট্যান্ডার্ড |
৫. ব্রেকিং : ব্রেকিংটা প্রথম দিকে আশানুরূপ না পেলেও টিউনিং করার পরে এখন পারফেক্ট পারফরমেন্স পাচ্ছি | দেখেন বাইকটায় দুইটাই ড্রাম ব্রেক তাই কেউ ডিস্ক ব্রেকের সাথে তুলনা করতে যাবেন না প্লিজ | হাতের ব্রেক-পায়ের ব্রেক মিলিয়ে ধরতে পারলে ইনশাআল্লাহ কখনো কোনদিন বিপদে পরতে হবে না | ইমারজেন্সি ব্রেকিং এ এখন পর্যন্ত নিরাশ হইনি |
রানার বাইক আরটি খারাপ দিক: বাইকটার কিছু খারাপ দিক থাকলেও কোনটাই তেমন গুরুতর না | মানিয়ে নেয়ার ইচ্ছা থাকলে আর অল্প কিছু খরচেই এগুলি দূর করা যায়|
১. ফুয়েল ইন্ডিকেটর প্রাথমিক অবস্থায় কাজ করছিল না, সারভিসিং এর সময় রানারের টেকনিশিয়ান ঠিক করে দিয়ে ছিল | এখন কাজ চালানোর মত রিডিং দেয় |
২. আলাদা কোন রেভ কাউন্টার নেই তাই ইঞ্জিনের আওয়াজ আর হাতের থ্রটল পজিশন থেকেই আরপিএম আন্দাজ করে নিতে হবে | স্পিড মিটারটার লুক আমার ভাললাগেনি |
৩. হেডলাইটের আলো কাজ চালানোর মত হলেও আহামরি কিছু না | (মটো এলইডি লাগাব কিছুদিনের মধ্যে তখন আর প্রব্লেম হবেনা আশা করি)
৪. বাইকটার সাইজ ছোট, তিনজন কম্ফোরটেবলি বসা যায় না |
৫. পিছনের সাসপেনশনটা আরো ভাল হতে পারত |
৬. পিছনের চাকা চিকন তাই কন্ট্রোলিং এ তেমন কোন প্রব্লেম না হলেও ঠিক মত ব্রেক করতে না পারলে স্কিড করবে | ঠিক মত কথাটা ইউজ করার কারন প্রথম দিকে আমার অনেক বেশি স্কিড করত, এখন আর খুব একটা করেনা স্কিড | (এলাকার মেকানিক বলেছে পালসারের পিছের চাকা লাগানো যাবে পরে)
৭. শাড়ি গার্ড কিংবা বাম্পার নাই (অনেক আর টি ইউজার ভাই অলরেডি স্বল্প খরচে লাগিয়ে নিয়েছে দেখলাম)
৮. সাইড কভারটা প্লাস্টিকের , ফেটে যাওয়ার চান্স অনেক বেশি |(প্লাস্টিকের সাইড বক্সটা আর কিছুদিন পরে চেঞ্জ করে স্টিলের একটা লাগিয়ে নিব ঠিক করেছি, তাহলে বিল্ড কোয়ালিটিতে আর কোন ঘাটতি থাকবে না|)
মাইলেজ ৫০ এর মত পাচ্ছি এখন ব্রেকইন পিরিয়ড এর পরে আরেকটু বাড়বে আশা করছি |
পরিশেষে বলতে চাই, আমি কোন বাইক এক্সপার্ট না, রানার বাইক আরটি ই আমার প্রথম বাইক | হ্যা, কিছু প্রব্লেম ফেস করেছি সত্যি কিন্তু এটাও সত্যি ৬২ হাজার (এখন ৬৪ হাজার) টাকায় এমন একটি বাইকের মালিক হব কোন দিন স্বপ্নেও ভাবিনি | ৮০০ কি.মি পরে আজকে যখন রিভিউ লিখতে বসেছি মুখে এক চিলতে হাসি নিয়েই বসেছি; এ হাসি একজন গর্বিত মোটরসাইকেল মালিকের সন্তুষ্টির হাসি |
লিখেছেন - আসিফ জাহান