Shares 2
মোটরসাইকেলে ঢাকা টু দারুচিনি দ্বীপ
Last updated on 06-Jul-2024 , By Shuvo Bangla
প্রায় তিন বৎসর আগের কথা তারিখটা ছিল ২ রা জানুয়ারি ২০১১ ফিরে আসছিলাম সেন্টমার্টিন থেকে ঠিক সেই সময় একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এই সুন্দর দ্বীপটাতে আবার যখন আসবো তখন মোটরসাইকেল নিয়েই আসবো, "মোটরসাইকেলে ঢাকা টু দারুচিনি দ্বীপ" । এর মাঝে চলে গেলো তিনটা বছর ঘটে গ্যালো অনেক ঘটনা, স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেলো, এর ভেতর একদিন জুন ভাইকে বললাম সেন্টমার্টিন যেতে চাই মোটরসাইকেলে কথাটা শুনে সবাই যেমন অবাক হয় উনি তেমন অবাক হলেন না, খুব স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলেন কোন সমস্যা নাই আমারা যাবো।
মোটরসাইকেলে ঢাকা টু দারুচিনি দ্বীপ
এরও প্রায় মাস চারেক পর উনি জানালেন রাসেল ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ তাদের নতুন মোটরসাইকেল লিফান কেপি ১৫০ বাজারে ছাড়ছেন এবং দুইটি মোটরসাইকেল আর আনুসাঙ্গিক খরচ তারা আমাদের এই ট্যুর এর জন্য দিবেন আর ট্যুর হবে ঢাকা-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-টেকনাফ-সেন্টমার্টিন আর বান্দরবান। এটা জানার পর এতো জোরে একটা চিৎকার দিয়েছলাম যার শব্দে আশেপাশে যারা ছিল তাদের সবার কানে তালা লেগে গিয়েছিলো।
শুরু হল আমাদের মোটরসাইকেল যাত্রার প্রস্তুতি, দেখতে দেখতে চলে আসলো সেই দিন ২৩ শে জানুয়ারি ২০১৪, সকাল ৮:৩০ মিনিট আমরা সবাই রাসেল ইন্ডাসট্রিজ লিঃ এর হেড অফিস লালমাটিয়া, ঢাকা উপস্থিত হলাম। আমরা ৫ জন মোহাম্মদ সাদিকুল্লাহ জুন সাথে লাল রঙের লিফান কেপি ১৫০, আর ডি অমিও সাথে নীল রঙের লিফান কেপি ১৫০, ওয়াসিফ আনোয়ার আর তার প্রিয় হিরো গ্ল্যামার ,মোঃ আসাদুর রহমান শুভ নিয়েছিলেন সাদা নীল রঙের ইয়ামাহা এফ জেড-এস আমি এ,কে,এম, আবিদুর রহমান নিয়েছিলাম টিভিএস এপাচি আর টি আর।
আমাদেরকে বিদায় দেবার জন্য রাসেল ইন্ডাসট্রিজ লিঃ এর পক্ষ্য থেকে উপস্থিত ছিলেন কোম্পানির চেয়ারম্যান আবসার রাসেল ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর সামসুল বাশার। ঘড়ির কাঁটা তখন ৯:৩০ এর ঘরে আমারা রওনা হলাম, ঢাকার জ্যাম পার করে পৌছালাম মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে সেখান থেকে শিতালক্ষ্য নদীর উপর নির্মিত কাচপুর ব্রিজে, ব্রিজ পার হবার পর যে রাস্তা শুরু হল এর মত বাজে রাস্তা আর একটাও নাই। মোটরসাইকেলের জন্য সব থেকে বিপদজনক রাস্তা,ইয়ামাহা এফ জেড এস কিন্তু এই রাস্তায় ঠিকই উৎরে গ্যালো , সামনেই মেঘনা ব্রিজ আমরা সবাই ছুটে চলছি পার হয়ে গেলাম মেঘনা ব্রিজ। সামনেই কুমিল্লা, কুমিল্লায় আমাদের সাথে দেখা হল রোহিত ভাইয়ের সাথে এরপর আমরা দেখা করলাম রাসেল ইন্ডাসট্রিজ লিঃ কুমিল্লার ডিলারের সাথে।
প্রায় ঘণ্টাখানেক ডিলারের সাথে বিভিন্ন বিসয় নিয়ে আলোচনা করার পর আমরা আবার রওনা হলাম। ঘণ্টা তিনেকবাদ আমরা পৌছে গেলাম বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। ঐ রাতে আমাদের সাথে দেখা হল মনসস্টার রাইডারজ এর সাথে, তার পরদিন মনসস্টার রাইডারজ তাদের স্টান্ট দেখালো লিফান কেপি ১৫০ নিয়ে নেভাল সি বিচ পতেংগাতে,অসাধারন এক সন্ধ্যা ছিল ওটা। সত্যি বলতে কি পরের মোটরসাইকেল নিয়ে স্টান্ট করলে সেটা আরও ভালো হয়।
আমরা সকালে রওনা দিলাম টেকনাফের উদ্দেশ্যে মাঝে বিরতি নিলাম কক্সবাজারে মধাহ্ন্যভোজের জন্য, তারপর আবার আমাদের মোটরসাইকেলগুলার ইঞ্জিন স্টার্ট হল টেকনাফের উদ্দেশ্যে মেরিন ড্রাইভের রাস্তা দিয়ে। ডান পাশে সাগর আর বাম পাশে পাহাড়। আমরা এগিয়ে চলছি আর ঐ দিকে সূর্যটা বিশাল সমুদ্রের মাঝে ডুব দিচ্ছে , কিচ্ছুক্ষণ বাদেই আমরা আমাদের মোটরসাইকেলের হেডলাইট জ্বালিয়ে দিলাম চারদিকে ঘুট ঘুটা অন্ধকার আর এই অন্ধকার চিরে হেডল্যাম্পের আলোয় ছুটে চলছি আমরা ৫ জন হঠাৎ করে আমাদের রাস্তার মাঝে চলে আসলো বিশালকার প্রচিন গাছের সারী আমরা সবাই ঢুকে গেলাম এই শত বছরের নিরব সাক্ষী হয়ে থাকা গাছগুলার মধ্য দিয়ে, অদ্ভুত এক গা ছমছমে অনভুতি তৈরি হয় ঐ স্থানটায়।
আমারা পৌছে গেলাম হোটেল টেকনাফের নে টং এ। না কোন বিশ্রাম নয়...... লিফান কেপি ১৫০ নিয়ে আমি,জুন ভাই,অমিও ভাই ,শুভ ভাই ও ওয়াসিফ রওনা দিলাম কেয়ারি ঘাটে, মোটরসাইকেল ২টা কে শিপে তুলে দেবার জন্য আর আমাদেরকে এই ব্যাপারটায় যে মানুষটা শতভাগ আন্তরিকতা ও ভালবাসা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন তিনি হচ্ছেন তারেক মাহমুদ রনি। জাহাজে মোটরসাইকেল তোলা যত সহজ মনে হচ্ছে ব্যাপারটা আসলে অনেক কষ্টকর ছিল, তারপরও আমরা কাজটা খুব ভালোভাবে শেষ করি।
একটা ঘুম দরকার......সকাল ৯টার সময় আমরা আবার সবাই কেয়ারি ঘাটে, উঠে পড়লাম আমাদের জাহাজ কেয়ারি সিন্দাবাদে ঠিক সিন্দাবাদের ভুতের মত। ৯.৩০ মিনিটে জাহাজের ক্যাপ্টেন ঘোষণা দিলেন জাহাজ ছাড়বার, আমরা রওনা হলাম সেন্টমার্টিন দ্বীপের উদ্দেশ্যে.........জাহাজ ছুটে চলছে বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে আর আমি জাহাজের ডেকে রাখা মোটরসাইকেল লিফান কেপি ১৫০ র উপরে বসে ভাবছিলাম সেন্টমার্টিনদ্বীপটি নিয়ে .................................
বাংলাদেশের দক্ষিন অংশের সীমানা বরাবর এই বঙ্গোপসাগরের অবস্থান, দক্ষিন পূর্ব অঞ্চলের মায়ানমার সীমান্ত ছুঁয়ে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার অন্তর্গত সাগরের মধ্যে প্রায় ৩৪ কিলোমিটার পানি পথ পেরিয়ে সেন্টমার্টিন। পূর্বে দ্বীপ থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরত্বে সাগর পাড়ে মায়ানমারের বড় বড় উঁচু পাহাড়ের প্রাচীর। পশ্চিমে প্রায় পাঁচশ কিঃ মিঃ দূরত্বে সুন্দরবনের সাথে ভারত সীমান্ত, আর দক্ষিণে কুল কিনারাবিহিন গভীর সমুদ্র। তারমানে বিশাল সাগরের মাঝে ছোট্ট এই দ্বীপের অবস্থান।
সেন্টমার্টিন দ্বীপের আয়তন প্রায় ৮ বর্গ কিলোমিটার ও উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। এ দ্বীপের তিন দিকের ভিত শিলা যা জোয়ারের সময় তলিয়ে যায় এবং ভাটার সময় জেগে ওঠে। এগুলোকে ধরলে এর আয়তন হবে প্রায় ১০-১৫ বর্গ কিলোমিটার। এ দ্বীপটি উত্তর ও দক্ষিণে প্রায় ৫.৬৩ কিলোমিটার লম্বা। দ্বীপের প্রস্থ কোথাও ৭০০ মিটার আবার কোথাও ২০০ মিটার। দ্বীপটির পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে সাগরের অনেক দূর পর্যন্ত অগণিত শিলাস্তূপ আছে।সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের গড় উচ্চতা ৩.৬ মিটার। সেন্টমার্টিনের পশ্চিম-উত্তর-পশ্চিম দিক জুড়ে রয়েছে প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার প্রবাল প্রাচীর।
ভৌগোলিকভাবে এটি তিনটি অংশে বিভক্ত। উত্তর অংশকে বলা হয় নারিকেল জিনজিরা বা উত্তর পাড়া। দক্ষিণাঞ্চলীয় অংশকে বলা হয় দক্ষিণ পাড়া এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে দক্ষিণ-পূর্বদিকে বিস্তৃত একটি সঙ্কীর্ণ লেজের মতো এলাকা। এবং সঙ্কীর্ণতম অংশটি গলাচিপা নামে পরিচিত। দ্বীপের দক্ষিণে ১০০ থেকে ৫০০ বর্গমিটার আয়তনের ছোট দ্বীপ আছে যা স্থানীয়ভাবে ছেড়াদিয়া বা সিরাদিয়া নামে পরিচিত। এটি একটি জনশূন্য দ্বীপ। ভাটার সময় এই দ্বীপে হেটে যাওয়া যায়। তবে জোয়ারের সময় নৌকা প্রয়োজন হয়।
দেখতে দেখতে আমরা উত্তাল সাগর পেরিয়ে সেন্টমার্টিন চলে এলাম তখন ঘড়ীর কাঁটা ১২.৩০ মিনিট। জাহাজ ঘাঁটে ভিড়ল যাত্রীরা নামতে শুরু করল কিন্তু আমরা অপেক্ষায় থাকলাম সবার নামার, এক এক করে সবাই নেমে গ্যালো এবার আমরা সবাই নামবো সাথে আমাদের মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেল উঠাতে যতটা না কষ্ট হল তার থেকে বেশি হল নামাতে কিন্তু সব কষ্ট এক নিমিষে চলে গেলো যখন আমরা মোটরসাইকেল নিয়ে সেন্টমার্টিন এর জেটিতে নামলাম।
চারদিকে অথৈ নিল সাগর,কিছু নারকেল গাছ,কেয়া বন। সামনে বালুকাবেলা তার উপর এসে নামলাম আমারা পাঁচ জন মোটরসাইকেল চালক সাথে লিফান কেপি ১৫০, আমরা এখানে এসেছি অনেক দূর থেকে উত্তাল সাগর পেরিয়ে............দীর্ঘ যাত্রায় ক্লান্ত সবাই কিন্তু মুখ দেখলে মনে হবে বিশ্ব জয় করে ফেলছি............
জেটিতে দেখা হল নেভি,কোস্টগার্ড ও স্থানীয় পুলিশের কর্মকর্তাদের সাথে, উনাদের সাথে সৌজন্য আলাপ সেরে আমরা রওনা দিলাম এই দ্বীপের শেষ প্রান্তে। জেটি থেকে কিছু রাস্তা সিমেন্টের এরপর রাস্তা হল সমুদ্রর পাশ ঘেঁষে বালুর উপর দিয়ে প্রায় ৭ কিঃ মিঃ পথ বালুর উপর দিয়ে আমরা পৌছালাম আমাদের রিসোর্টে, আমাদের রিসোর্টটি সেন্টমার্টিন দ্বীপের একেবারে শেষ প্রান্তে কোলাহল মুক্ত, নির্জন স্থানে। এর কিছুক্ষন পরই শুরু হয়ে গেল সমুদ্রের পাড় ঘেঁসে পানি ও বালিতে মোটরসাইকেল চালানো।
কখন যে সূর্যটা ডুবে গেল আর অন্ধকারটা নেমে এল আমরা বুঝতেই পারলাম না, অনেকদিন এত অন্ধকার ঢাকায় বসে দেখিনি আর আকাশ ভরা তারার মেলা,শুধু আকাশের দিকেই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে কিন্তু ঘাড় ব্যাথার কারনে সেটি আর হয় না। অনেক আনন্দ,মজার মাঝে দেখতে দেখতে রাতটা শেষহয়ে গেল।
আমরা সবাই সূর্য উঠার আগেই সমুদ্র পাড়ে হাজির হলাম, উদ্দেশ্য সূর্য উদয় দেখা, এটা অস্মবভব সুন্দর একটা দৃশ্য যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না এটা দৃষ্টি দিয়ে উপভোগ করতে হয়।
আস্তে আস্তে সময় চলে যাচ্ছে আমাদেরও ফেরার সময় হয়ে যাচ্ছে, আমরা আমাদের রিসোর্ট থেকে রওনা দিলাম,ফিরে এলাম জেটিতে, সবেমাত্র জাহাজ ঘাটে ভিড়ছে যাত্রীরা সবাই নেমে যাবার অপেক্ষায় আছি ,কারন আমাদের মোটরসাইকেল আবার জাহাজে তুলতে হবে এর মাঝে ফোন দিলাম বিডি মোটরসাইক্লিস্ট এর রিয়াজ ভাইকে জানতে পারলাম ওনারাও ১০টা মোটরসাইকেল নিয়ে ট্রলারে করে শাহপরি দ্বীপ থেকে রওনা হয়েছেন। উনাদের অপেক্ষায় থাকলাম ...... সময় হয়ে গেল জাহাজ ছেড়ে দেবার আমরা সবাই আবার জাহাজে, আমাদের জাহাজ এগিয়ে চলছে টেকনাফের কেয়ারি ঘাটের উদ্দেশ্যে আর আমরা পিছনে ফেলে যাচ্ছি সেন্টমার্টিন দ্বীপ আর সাথে নিয়ে যাচ্ছি জীবনের সেরা কিছু মুহূর্ত ও ঐতিহাসিক কিছু স্মৃতি।
বসে আছি জাহাজের ডেকে লিফান কেপি ১৫০ র উপরে সমুদ্র উত্তাল আমার চোখ বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রলারের দিকে খুঁজছি বিডি মোটরসাইক্লিস্টদেরকে, এরই মাঝে একটি ট্রলারে একজনের মাথায় মোটরসাইকেলের হেলমেট দেখতে পেলাম, চিৎকার করে উঠলাম বিডিএম বলে, ফোনটা বেজে উঠলো রিয়াজ ভাইয়ের গলা শুনলাম আবিদ ভাই আপনারা কই ? এরমাঝে জুন ভাই তার ক্যামেরা নিয়ে উনাদের ছবি তুলতে ব্যাস্ত, আমাকে বললেন রিয়াজ ভাইকে বলেন উনাদের সবার হাত তুলতে। দেখতে দেখতে আমাদের জাহাজ ও উনাদের ট্রলার পাশ কাটিয়ে চলে গেল অনেক দূর। আমার জীবনে বিডি মোটরসাইক্লিস্টদের মত দুঃসাহসিক রাইডার আর কখনো দেখিনি, উনারা ট্রালারে করে সেন্টমার্টিন দ্বীপ গিয়েছেন। সাবাস বিডি মোটরসাইক্লিস্ট..................
গাংচিল আর গাংচিল জাহাজের সাথে সাথে উড়ে আসতে থাকলো, সংখ্যায় ওরা শতকের ঘরে, আমাদের জুন ভাইয়ের ক্যামেরা তখন ক্লিক ক্লিক করে এই পাখিদের ছবি তোলায় বাস্ত। টেকনাফের পাহাড় দেখা যাচ্ছে সূর্যটা উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে এই পাহাড়ের ফাঁকে, আমাদের জাহাজ এগিয়ে যাচ্ছে ঘাটের দিকে, কিছুখন বাদেই আমাদের জাহাজ নোঙর ফেলালো কেয়ারি ঘাটে আর শেষ হোল আমাদের ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণ।
আজ এই পর্যন্ত তবে টেকনাফের ভুতের বাড়ির (টেকনাফ থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের উপর আরকানদের পরিতেক্ত বাংলো)গল্প নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো কথা দিলাম আজ শুধু ছবি দিয়ে শেষ করছি।
এ,কে,এম, আবিদুর রহমান
T
Published by Shuvo Bangla