Shares 2

একজন শিক্ষানবিশ বাইকারের কক্সবাজার-টেকনাফ ভ্রমন কাহিনি

Last updated on 27-Jul-2024 , By Saleh Bangla

একজন শিক্ষানবিশ বাইকারের কক্সবাজার-টেকনাফ ভ্রমন কাহিনি

ছোটবেলা থেকেই লেখালেখিতে আমি জঘন্য রকমের খারাপ । আমার স্কুল জীবনের বন্ধুদের চেয়ে ভাল এই বিষয়টি কেউ জানেনা ।  তবুও নিতান্তই নিজের ইচ্ছেতে আমার জীবনের সবচেয়ে স্মৃতিময় কক্সবাজার বাইক ভ্রমন কাহিনি শেয়ার করছি । আমাকে কেউ টেক্সট অথবা অনুরোধ করেছে বিধায় লিখছি ভেবে ভুল করবেন না । 

বাইকে কক্সবাজার ভ্রমন

সাল ছিল ২০১১, যখন আমি প্রথমবারের মত বাইক চালিয়ে ঢাকা থেকে কক্সবাজার ভ্রমন করি । তখনকার অবস্থার সাথে বর্তমান পরিস্থিতি চিন্তা করলে নিজেকে বাইরের কোন দেশে আছি বলে মনে হয় । সেই থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত আল্লাহর রহমতে মোট ছয় বার (৬বার) সফলভাবে বাইক দিয়ে কক্সবাজার ভ্রমন করি । এরমধ্যে ৪ বার গ্রুপ করে এবং ২ বার সিংগেলি যাই । আজকে আমি লিখব আমার সর্বশেষ কক্সবাজার- টেকনাফ ভ্রমনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কেঃ আমরা গত ১০ই ফেব্রুয়ারি রাত ১২টায় ঢাকা থেকে কক্সবাজার এর উদ্দেশ্য করে রওনা হই ।

অনেকে হয়ত ভাবছেন রাতে কেন রওনা দিলাম? রাতে যাওয়া রিস্ক? ইত্যাদি । সত্যি বলতে আসলেই রাতে বাইক চালানো রিস্ক তবুও আমাদের জন্য রাতে যাওয়া আরামদায়ক মনে হয়েছে । কেননা এই টাইমে রাস্তায় ভীড় তুলনামুলক কম থাকে এবং হাইওয়ের যানবাহন ছাড়া তেমন চাপ থাকেনা । তবে আমরা সবাইকে রাতে রওনা না দেয়ার জন্য অনুরোধ করব । আমরা দুই বাইকে ৪জন গিয়েছিলাম । বাইক দুইটি হল হোন্ডা সিবি হর্নেট ১৬০আর এবং ইয়ামাহা আর১৫ ভি২ । 


প্রথমেই মাতুয়াইল সান্টু পাম্প থেকে দুই বাইকে ট্যাংক ফুল করি ।  ইয়ামাহা আর১৫ এ ৯৫০ টাকার ও হোন্ডা সিবি হর্নেট এ ১০৫০ টাকার অকটেন নেই । আমরা কাচপুর আর মেঘনা ব্রিজ মোটামুটি জ্যাম থাকলেও বাইক বলেই খুব সহজে পার হতে পেরেছিলাম । 

bike tour group photo

দাউদকান্দি ব্রিজ এর পর রাস্তা তুলনামূলক ফাকাই বলা চলে । আমরা আনুমানিক রাত ২.৩০ এর কাছাকাছি হোটেল হাইওয়ে ইন এ আমাদের প্রথম যাত্রাবিরতি নেই । আমাদের ভাগ্যটা ভাল ছিল এই ভেবে যে আমরা কেউই অতিরিক্ত গরম কাপড় নিতে ভুল করিনি । এখন মাঝে মাঝে ভাবতেই ভয় লাগে যদি গরম কাপড় না নিতাম তাহলে আমাদের কি অবস্থা হত । যাইহোক,আমরা এক ঘন্টা বিরতি নিয়ে পুনরায় যাত্রা শুরু করলাম । 

এইবার আমাদের টার্গেট ছিল ফযরের আযানের আগে চট্টগ্রাম পৌছানো । আমরা আল্লাহর রহমতে ফযরের আযান শুনতে পাই চট্টগ্রাম শহরের কাছাকাছি এলাকায় । তখন ছোট ছোট হোটেল গুলো খোলা শুরু করছে । আমরা তেমনই এক হোটেলে থেমে কিছুখন বিশ্রাম নেই । বাইক থেকে নামার পর ঠান্ডায় কেও কথা বলারই শক্তি পাচ্ছিলাম না । এককাপ চা ও যে মাঝে মাঝে জীবন বাচাতে সাহায্য করে সেটা ওইদিন প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম । 

bike user tour review

আমারা আবার যাত্রা শুরু করলাম । এইবার আমরা টার্গেট করলাম যত তাড়াতাড়ি পরের ৫০ কিলোমিটার ক্রস করা যায় । কেননা বেশি বেলা হয়ে গেলে চট্টগ্রাম থেকে পটিয়া ও লোহাগড়া এলাকায় যানবাহন এবং মানুষের চাপ বেড়ে যায় । যার জন্য বাইক চালানো কষ্ট হয়ে যায় । সাধারণত চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাওয়ার পথে কিছুক্ষণ পর পর ছোট, মাঝারি, বড় বিভিন্ন বাজার বসে । তাই দিনের বেলায় রাস্তায় যানবাহন বেড়ে যায় এবং মানুষের চাপও বেশি থাকে । 

তাই ফযরের পর থেকে পরবর্তি ২ ঘন্টার মাঝে লোহাগড়া ক্রস করে বান্দরবান যাওয়ার লিংক রোড পার হতে পারলে তখন আর তেমন কিছু থাকেনা । এরপরে কিছু দুর গেলেই বুঝতে পারবেন আল্লাহ কত সুন্দর করে আমদের এই বাংলাদেশটা সাজিয়েছেন  । গাছগাছালীতে ঘেরা রাস্তার মাঝ দিয়ে বাইক চালানো স্বপ্নের মত মনে হচ্ছিলো । স্বপ্নের সমাপ্তি হল তখন এ যখন দেখলাম আমি নাকি বন্য হাতি চলাচলের পথ দিয়ে বাইক চালাচ্ছি । 

bike bd tour review

মনে মনে দুই-একবার হাতি দেখার সখ হলেও এর বিপরীতে কি বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে তা ভেবে একটা মসজিদের সামনে যাত্রা বিরতি নিলাম । ইতিমধ্যে ঘড়িতে প্রায় ৮ টার বেশি বেজে গিয়েছে । আমরা এখন যে জায়গায় যাত্রা বিরতি নিয়েছি তার নাম চকরিয়া । আর মাত্র ৬০-৭০ কি.মি. এর পথ বাকি । ভাবতেই চোখের মাঝে যতঘুম আর ক্লান্তি ছিল সব ৪০০ মাইল বেগে পালিয়ে গেল । বলে রাখা ভাল আমরা যখন কক্সবাজার থেকে ২০ কি.মি. দূরে তখন দুই বাইকেই ৫০০ টাকার অকটেন নিয়েছি । 

যানিনা কেন যতবারই কক্সবাজার এর কাছাকাছি চলে আসতে থাকি ততবার ই মনে হয় আমি হয়ত কিছু একটা অর্জন করতে যাচ্ছি । কিন্তু বাট আজও বুঝলাম না অর্জন আসলে কি করেছি । অনেক জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আমরা আনুমানিক বেলা ১০ ঘটিকায় কক্সবাজার পৌছালাম. অনেক হয়ত এক ঘুম থেকে উঠল আর আমরা ঘুমের মাঝেই কক্সবাজার । 

কক্সবাজার এসেই মনে পরল আমাদের বাইকে করে এইখানে আসার চেয়েও কঠিন কাজ এখনও বাকি আছে. যা হচ্ছে ভাল এবং সিকিউর হোটেল পাওয়া যেখানে বাইকগুলো সেফলি রাখতে পারব । আমরা কক্সবাজার থেকে টেকনাফ এর উদ্দেশ্যে রওনা হই মেরিন ড্রাইভ এর রোড এর সৌন্দর্য বাইক দিয়ে অনুভব করার জন্য । এখন কলাতলি ডলফিন মোড় থেকে মেরিন ড্রাইভ এ ঢোকার রোড বন্ধ । এখন যেতে হয় সাইমন হোটেল এর সামনে দিয়ে বিচ এর সাইড দিয়ে । 

bike tour coxbazar

হয়ত বিচ দিয়ে বাইক রাইডের শখ টাও এই সুযোগে পুরন করে ফেলতে পারবেন । আপনাকে অবশ্যই বাড়তি সতর্কতা অমলম্বন করতে হবে বালিতে বাইক চালানর ব্যাপারে । বিচ এর সাইড দিয়ে বাইক চালান যেমন এক্সসাইটিং তেমনি রিস্কিও । একটু সচেতনতার সাথে ড্রাইভ করলেই বুঝতে পারবেন বাংলাদেশের অন্যতম দৃস্টিনন্দন ভিউপয়েন্টে বাইক রাইডের অনুভুতি । এরপর সোজা মেরিন ড্রাইভ হয়ে আমরা চলে গিয়েছিলাম টেকনাফ এর শেষ প্রান্তে সারবং বাজার । 

ইনানির পর থেকে মেরিন ড্রাইভের দুই পাশের বর্ণনা দেয়ার ভাষা আমার নেই । বলে রাখা ভাল কক্সবাজার থেকে টেকনাফ ৭৫ কি.মি. এই পথে কোন পেট্রোল পাম্প পাবেন না ।  এক জায়গায় খোলা অকটেন বিক্রি করতে দেখেছি, রয়াল টিঊলিপ ক্রস করার পর । ওই রোডে যাওয়ার আগে তেল নিতে ভুলবেন না । অবশ্যই গাড়ির কাগজ ও হেলমেট নিতে ভুলবেন না. এই রোডে সব ধরনের চেকপোস্ট আছে, আর্মি,বিজিবি, পুলিশ সব । 

bike tour bangladesh

তারা অনেক হেল্পফুল ।  তারা সিগনাল দিলে ভুল করেও ক্রস করার চেষ্টা করবেন না । ড্রাইভিং লাইসেন্স আর বাইকের পেপার থাকলে আপনাকে কোন সমস্যায় এ পরতে হবে না আশা করছি । আমরা বেলা ১ টার দিকে টেকনাফ এর উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে ৩টা নাগাদ পৌছাই । ঘন্টাখানেক থেকে আবার ব্যাক করি । ব্যাক করার টাইম চাইলে আপনি কোথাও বাইক পার্ক করে রেস্ট নিতে পারেন কিন্তু নিজের সেফটি এর কথা অবশ্যই খেয়াল রাখবেন । 

Also Read:দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা

আমরা ৫ দিন কক্সবাজারে ছিলাম । আল্লাহর রহমতে অনেক ঘুরেছি । ঢাকা ব্যাক করার সময় হলে সবার মনই খারাপ হয়ে যায় । আমরা দুপুর ১টায় কক্সবাজার থেকে ঢাকার জন্য রওনা হই । এখন চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার এর রোড ভাল. নতুন কাজ করছে. এখনো পুরো কাজ শেষ হয়নি তবুও যা অবস্থা তাতেই আলহামদুলিল্লাহ । 

 tour by bike

আমরা বিকাল ৪ টায় চট্টগ্রাম সিটিগেট পৌছাই । সেখান থেকে হাল্কা লাঞ্চ করে আবার রওনা হই । এরপর ফেনীতে একবার চা বিরতি নেই । পথিমধ্যে মাগরিব নামাযের সময় হয়ে যায় জন্য নামায টাও পরে ফেলি । এরপর রাত ৭.৩০ টায় কুমিল্লা নুরজাহান হোটেলে লাস্ট ব্রেক নেই । যখন আমরা ঢাকা পৌছাই তখন বাজে রাত ১০.১৫. অবশেষে আমদের স্মৃতিময় ট্রিপ এর পরিসমাপ্তি হল । শেষ করার আগে আমার নিজের কিছু ব্যক্তিগত মতামত দিতে চাইঃ 

১. অবশ্যই যখনি ড্রাইভ করবেন ফুল মনযোগ দিয়ে করবেন । রিলাক্স হয়ে বাইক না চালানই উত্তম । ২. গ্রুপ করে গেলে অবশ্যই একজনকে ফলো করবেন এবং একটু দুরত্ব রেখে চালাবেন যেন সামনের বাইক ইমারজেন্সি ব্রেক করলে আপনি নরমালি ব্রেক করতে পারেন । ৩. বাম পাশে জায়গা রেখে চালান বেটার, তাহলে কেও চাপ দিলে আপনার মুভ করার প্লেস থাকবে । ৪. পসিবল হলে আপনার বাইক টিউবলেস হলেও এক্সট্রা টিউব সাথে রাখবেন । হাইওয়েতে টিউবলেস টায়ার এর মেকানিক পাওয়া কষ্ট । 

bike tour coxbazar bd

৫. যদি বহন করতে সমস্যা না হলে আপনার বাইকের জন্য রিকমেন্ডেন্ট ইঞ্জিন অয়েল নিতে পারেন । ৬. ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং বাইকের পেপার অবশ্যই সাথে রাখবেন । ৭. যেকোনো সময়ে যেকোনো কিছু ঘটতে পারে এটা ভেবে চালাবেন । আপনি কত তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছলেন সেটা বিষয় না, আপনি সেফলি পৌছাতে পেরেছেন কিনা সেটাই বিষয় । ৮. বেশি লম্বা পথ হলে প্রত্তেক ৯০-১০০ কি.মি. এ রেস্ট নেয়া ভাল । চাইলে আগেও নিতে পারেন । 

৯. বাইকের হেডলাইট অবশ্যই চেক করবেন যেন আপনি ঠিকমত রাস্তা দেখতে পারেন, গাছের পাতা না । ১০. সর্বশেষ, আমরা আসলে সব সময়ই নিজেদের অবস্থান থেকে নিজেদের সঠিক বলে মনে করি, সবসময়ই ভাবি বাসওয়ালার ভুল কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখি আমি যদি বাস ড্রাইভার এর পজিশনে থাকতাম তাহলে কি করতাম? 

yamaha r15 v2 and honda cb hornet 160 rear view

যাইহোক, এই ছিল আমার শেষবারের কক্সবাজার ট্রিপ এর অভিজ্ঞতা । জানি সবার কাছে এই লিখা মুল্যহীন,তবুও আমি যদি একজন মানুষকেও সচেতন করতে পারি তাহলে সেটাই হবে আমার সার্থকতা। ভাল থাকবেন সবাই । 

লিখেছেনঃ হাসনাত সাকিব  

আপনিও আমাদেরকে আপনার বাইকের মালিকানা রিভিউ পাঠাতে পারেন। আমাদের ব্লগের মাধ্যেম আপনার বাইকের সাথে আপনার অভিজ্ঞতা সকলের সাথে শেয়ার করুন! আপনি বাংলা বা ইংরেজি, যেকোন ভাষাতেই আপনার বাইকের মালিকানা রিভিউ লিখতে পারবেন। মালিকানা রিভিউ কিভাবে লিখবেন তা জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন এবং তারপরে আপনার বাইকের মালিকানা রিভিউ পাঠিয়ে দিন articles.bikebd@gmail.com – এই ইমেইল এড্রেসে।

Published by Saleh Bangla