Shares 2
হিরো হাঙ্ক ব্যবহার অভিজ্ঞতা-মওদুদ সোহাগ
Last updated on 04-Jul-2024 , By Shuvo Bangla
আমার কাছে হাঙ্ক একটি আস্থার নাম, একটি পরিতৃপ্তির নাম, একটি ভালোবাসার নাম। আমি মওদুদ সোহাগ। আজ আমি শোনাবো হিরো হাঙ্ক নিয়ে আমার মোটরবাইকিং অভিজ্ঞতার কথা।
হিরো হাঙ্ক ব্যবহার অভিজ্ঞতা-মওদুদ সোহাগ
আমার বাইকিং জীবনের শুরু
আমার বাবা সবসময়ই কেন জানি আমাকে বাইক কিনে দিতে আনিচ্ছুক ছিলেন। বাবা বলেন, এতো বাইক বাইক কর কেন? ক্যারিয়ারের দিকে মনোযোগ দাও। আমি কিছুই বলতে পারিনা, কেননা সেই ছোট বেলা থেকেই বাবাকে বেশ ভয় করি। তবে মনে মনে বলি, আব্বু আমি যখন অনেক ছোট ছিলাম তখন আপনি আমাকে নিয়ে নাটোর শহর থেকে বাইকে করে আমাদের গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে যেতেন। আমি পেছনে বসে শুধু চারিদিকে দেখতাম আর ভাবতাম সবুজ গাছগুলি কেমন পেছনে চলে যাচ্ছে। অদ্ভুত লাগতো কাছের গাছগুলি খুব দ্রুত চলে যেত দুরের গাছগুলির তুলনায়।
Also Read: হিরো হাঙ্ক ৮,০০০ কিঃ মিঃ মালিকানা রিভিউ
আর বাসায় এসে ডাবল স্ট্যান্ড করা আমাদের হোন্ডা এইচ.এস১০০ বাইকটিতে বসে চেষ্টা করতাম পা টাকে কোনভাবে মাটি স্পর্শ করানো যায় কিনা। আর মামাতো সময় পেলেই আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হতেন। হয়তো সেই তখন থেকেই অথবা তারও আগে থেকে বাইকের প্রতি আমার ভালোবাসা… ওহ মনে পড়ে গেল ২-ষ্ট্রোক বাইকের ধোঁয়ার গন্ধটাই যেন আমার প্রথম প্রেম। তাই ৭ম শ্রেনীতে পড়ার সময়ই বাইক চালানো শিখলাম… আর এরপর শুধুই ভ্রুম আর ভ্রুম…..হাহ্ হাহ্ হা..
হিরো হাঙ্ক কেনার মাহেন্দ্রক্ষন
আমার এই বাইকিং জীবনে অনেক বাইকই ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছি। সেই ৮০সিসি থেকে শুরু। আমার হিরো হাঙ্ক কেনার আগে ভেবেছিলাম যে হোন্ডা ইউনিকর্ণ কিনবো। কিন্তু হোন্ডা ইউনিকর্ণ ততদিনে আর বাজারে নেই। বাইকবিডির শুভ্র সেন দাদাকে পরামর্শের জন্য কল দিলাম উনি পরামর্শ দিলেন হাঙ্কের উপর উনার লেখা রিভিউটা পড়ার জন্যে। আর শুভ্রদার কাছ থেকেও হাঙ্কের উপর গ্রিন সিগনাল পেলাম। ব্যাস ডিসিশন ফাইনাল।
অবশেষে ২০১৩ মডেলের লাল রঙের একটা বন্য ষাঁড় (হাঙ্ক) কিনে ফেললাম অনেক প্রত্যাশা নিয়ে। বাইকটার সিটে বসতেই একটা ফিল কাজ করলো যে, এটা বড়.. হ্যাঁ সত্যিই অনেকটা বড় আর বেশ ভারী। বাইকটা চালিয়ে বাসায় ফেরার সময় একটা বিষয় খুবই ভালো লাগলো আর তা হলো এর সাসপেনশন। ছোটখাট গর্ত বা স্পিড-ব্রেকারে ভেবেছিলাম যেমনটা শক্ত ধাক্কা পাব… কিন্তু না এর সাসপেনশন এতো চমৎকার যে ওসব খুব সহজেই পার করে এসেছি। আর কেমন যেন একটা স্মুথ ফিলিংস কাজ করছিল।
Also Read: হিরো জয়রাইড এ অংশ নিন, ৩০% পর্যন্ত সার্ভিস খরচ বাঁচান
বাইক কেনার পরেরদিন সকালবেরা আমার ষাঁড়টাকে সুন্দর করে মুছে গ্যারেজ থেকে বের করলাম। দিনটা ছিল শুক্রবার, ভোর বেলা, মৃদু বাতাস বইছে.. রাস্তা ফাঁকা। ঝাড়ুদার রাস্তা পরিস্কার করে রেখেছে..যেন আমারই জন্যে.. মনে হচ্ছিল যেন আমি রেস ট্র্যাকে নামছি। ইঞ্জিনের মৃদু শব্দ আর হালকা ভাইব্রেশন কেমন যেন সুড়সুড়ি দিচ্ছিলো.. I just felt..I’m in Heaven… এরকমই ফিলিংসের মাঝে কখন যেন ৬,০০০কিমি শেষ করে ফেললাম। ব্রেক-ইন পিরিয়ড ও কমপ্লিট.. এইবার ষাঁড়টাকে বললাম বাছাধন রেডি হন… সামনে ঈদ.. হাইওয়ে আপনাকে ডাকছে। কথা শেষ না হতেই (সার্ভিসিং শেষে) ষাঁড়টা মাথা নাড়া দিয়ে বললো সে পুরো রেডি… Because Muscles Matter.. :)
হাঙ্ক সাথে চলার অভিজ্ঞতা
সেবার যখন ভোরবেলা রওনা দিলাম নাটোরের উদ্দেশ্যে। রাস্তাটা বেশ ফাঁকা ছিল। আমার ফিলিংসটা আগের মতো হলেও ষাঁড়টা অনেক বেশী স্মুথলী চলছিল…প্রায় ৮০, ৯০,১০০ তে। যমুনা সেতুর আগ পর্যন্ত এভাবে চললেও সেতুতে উঠে ষাঁড়টা কেমন যেন স্পিড-আপ করতে চাচ্ছিলো। কি আর করা আমি আমার মাথা হেলমেটসহ ফুযেল ট্যাঙ্কের উপর রাখলাম.. আর ওকে বলামাত্র সে ১১৫কিমি গতিতে ছুটতে শুরু করলো।
তবে কেন যেন এর বেশি আর উঠলো না। তবে এই স্পিড দেখে মনটা খুব একটা খুশি হতে পারলো না.. ভেবেছিলাম ১২০+ উঠবে। কারন আমি জানতাম কেউ কেউ হাঙ্কে ১৩০ ও তুলেছেন। যাহোক ঈদে প্রায় ১২০০+ কিমি ঘুরলাম কোন রকম অসুবিধা ছাড়াই (specially no back pain, no wrist pain, no shoulder pain)। মনটা বলে উঠলো আলহামদুলিল্লাহ।
এভাবে দেখতে দেখতে ২৫,০০০কিমি শেষ করলাম। হাঙ্কের ইঞ্জিনটা এতটাই স্মুথ আর নি:শব্দ যে মাঝে মাঝে মনে হয় যেন ইঞ্জিন অফ করে বাইক চালাচ্ছি। আর মাঝে মাঝে এমনও মনে হয় যে আরো একটু চালাই.. এরকম বহুবার হয়েছে যে বাহির থেকে ফিরে গ্যারেজে বাইক না ঢুকিয়ে আবারো বেড়িয়ে পড়েছি। মন যেন বলে ওঠে যাই আর একটু ঘুরিনা!
বাইকটার এই বয়সের মধ্যে আমি মোটামুটি অনেক রকমের পরীক্ষা করেছি.. কাদামাটি, বালির রাস্তা, কাচা রাস্তা, ইট বিছানো রাস্তা, পাথর বিছানো রাস্তা, উঁচুনিচু, হাইওয়ে সব জায়গায চালিয়েছি। অন-রোড বা অফ-রোড কোন জায়গাতে হাঙ্ক আমাকে নিরাশ করেনি।
তবে এপর্যন্ত মিটারে টপ-স্পিড পেয়েছি ১২০কিমি/ঘন্টা, যা তুলনামুলকভাবে অন্যান্য অনেক বাইকের প্রায় ১২৮/১৩০ এর সমান। বিষয়টা আমি পরীক্ষা করে দেখেছি। এছাড়া একটানা কোন বিরতি ছাড়া ২৫০কিমি এবং একদিনে ৪৫০+কিমি চালিয়েছি.. প্রায় ৩০টি জেলাও এই বাইক নিয়ে ভ্রমন করেছি.. কিন্তু কোন সমস্যা অনুভব করিনি।
হিরো হাঙ্ক এর কিছু সাধারন সমস্যা
যাহোক আমার এইটুকু সময়ের মধ্যে হাঙ্ক চালানোর অভিজ্ঞতায় আমি বলবো না যে হিরো হাঙ্ক ১০০% পারফেক্ট বাইক। সব বাইকেই কিছু না কিছু সমস্যা থাকেই। আর হাঙ্কেও আমি কিছু সমস্যা পেয়েছি, যেমন:
- হিরো হাঙ্ক এর ওজনটা তুলনামুলকভাবে কিছুটা বেশি যা শহর এলাকায় বা জ্যামে ভালোভাবে বোঝা যায়। তবে হাইওয়েতে আপনি কিছুই বুঝবেননা..যেন পুরোটাই মাখন।
- সামনের ডিস্ক ব্রেকটা এফজেড বা জিক্সারের মতো অতোটা কার্যকর নয় তবে বেশ ভালোই কাজ করে।
- এর পেছনের ডিস্কটা একটু বেশি সেনসিটিভ মনে হতে পারে, কেননা এর পেছনের চাকাটা একটু চিকন।
- আর পেছনের চাকা হার্ড-ব্রেক করলে চাকা স্কিড করে আর চাকা যেকোন দিকে সরে যায়.. যেটা বেশ বিপদজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।
- হাই-স্পিডে কর্নারিং করাও কষ্টকর, কেননা পেছনের চাকা পিছলে যাবার ভয় থাকে।
- হেডলাইটের আলো আশানুরুপ নয়।
- যেকোন সমস্যায় ভালো মেকানিকের কাছে না দেখালে ভুগতে হবে। বেশ যত্ন নিয়ে সুক্ষভাবে কাজ করাতে হয়। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি মেকানিকের উপর ছেড়ে না দিয়ে নিজে বসে থেকে ভালোভাবে কাজ করিয়ে নিতে হয়। এছাড়া আর তেমন কোন সমস্যা আমি পাইনি।
হিরো হাঙ্ক এর কিছু সমস্যার সমাধান
হিরো হাঙ্ক এর কিছু সমস্যার কথা আগেই উল্লেখ করেছি, তবে সময়ের সাথে তা সমাধানের কিছু্ উপায়ও খুজে পেয়েছি। এবার আসি একটি হাঙ্ক থেকে কিভাবে আপনি আশানুরুপ ফিডব্যাক পাবেন যা কখনো আপনাকে নিরাশ করবেনা..
- হিরো হাঙ্কের পেছনের চাকাটা ১১০ সাইজের MRF Zappar Q অথবা অন্য কোন ভালো ব্র্যান্ডের লাগালে এর ব্রেকিংটা চমৎকার ইমপ্রুভ করে। আমি একা ও পিলিয়ন নিয়ে ৮০+কিমি স্পিডে কেবলমাত্র পেছনের ব্রেক ব্যবহার করে চাকা লক করে পরীক্ষা করে দেখেছি, এতে খুব ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে। এতে চাকা কেবল সরলরেখায় স্কিড করেছে কিন্তু একটুও ডানে-বামে সরে নাই।
- অবশ্যই দুই চাকার বাতাসের চাপ ম্যানুয়েল অনুযায়ী রাখবেন.. মেকানিকের কথায় কান দেবেননা।
- ম্যানুয়েল অনুযায়ী ইঞ্জিন ওয়েল ব্যবহার করবেন… Grade 10w30...। মেকানিকের বাজে কথায় কান দেবেননা।
- ব্রেক-ইন মেনে বাইক চালালে ৪/৫ হাজার কিমি পর বাইকের স্মুথনেস আরো বেড়ে যায়। আর ইঞ্জিন এর আয়ুস্কাল যে আরো বাড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
- অবশ্যই সময়মত সার্ভিসিং করাবেন। আর ইঞ্জিন ঠান্ডা অবস্থায় সঠিক মানের ফিলার গজ দিয়ে ট্যাপিড এ্যাডজাষ্ট করাবেন।
- কোন পার্টস বদলাতে হলে অরিজিনাল পার্টস ব্যাবহার করূন।
- অবশ্যই ভালো মেকানিক দিয়ে নিজে উপস্থিত থেকে কাজ করিয়ে নেবেন। সম্ভব হলে হিরোর সার্ভিস সেন্টারে কাজ করাবেন।
- হেডলাইটে ভালো আলো পাবার জন্যে ভালো ব্র্যান্ডের (ফিলিপস/অস্রাম) ৩৫ ওয়াট বাল্ব ব্যবহার করতে পারেন।
তো বন্ধুরা আমার এ পর্যন্ত হাঙ্ক চালানোর অভিজ্ঞতা ও আমার সাথের অন্যান্য ব্যবহারকারীদের মতামতের আলোকে মনে হয়েছে যে, হিরো হাঙ্ক একটি শক্তিশালী বাইক। এটি বেশ দ্রুতই অল্প আরপিএম এ তার শক্তি উৎপাদন করতে পারে। আর তুলনামুলকভাবে অনেক দ্রুত ৯০-১০০-১১০ পর্যন্ত স্পিড তুলতে পারে। এর Built Quality বেশ ভালো। আপনি আশা করা যায় নিরাশ হবেন না.. অনেকদিন ধরে কোন ঝামেলা ছাড়াই এটি আপনাকে সার্ভিস দেবে। স্পেয়ার-পার্টসের দাম তুলনামুলকভাবে বেশী মনে হলেও আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি এর দীর্ঘস্থায়িত্ব অনেক বেশী মনে হয়েছে। আর শেষ করার আগে সামান্য কিছু পরামর্শ রইলো সবার জন্যে.. আর ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
বাইকারদের জন্য কিছু পরামর্শ
- সবসময় হেলমেট ব্যবহার করুন (পুলিশের ভয়ে নয়.. নিজের নিরাপত্তার জন্যে)।
- অবশ্যই লুকিং গ্লাস ব্যবহার করুন। কখনোই লুকিং গ্লাস খুলে রাখবেননা।
- অযথা যেখানে সেখানে রেস করতে যানেনা। বিষয়টি আসলেই অপরিপক্কতার নির্দেশক।
- অন্যান্য বাইকারদের সম্মান দিন, নিজে সম্মানিত হবেন।
- ট্রাফিক আইন মেনে চলুন, সড়ক নিরাপদ রাখুন।
পরিশেষে সবাইকে ধন্যবাদ।
লিখেছেন: মওদুদ সোহাগ
T
Published by Shuvo Bangla